Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

নাজলীর পরিবেশ বান্ধব স্থাপত্য ভাবনা

পরিবেশবান্ধব স্থাপনার কাজ করে যাচ্ছেন নাজলী হোসেন। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্থাপত্য বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। ২০০৯ সালে নাজলী নিজেই গড়ে তোলেন ‘প্র্যাক্সিস আর্কিটেক্টস নামের একটি ফার্ম। ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি বেশকিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করে অনেকের নজর কেড়েছে। এই স্থপতি সব সময় চিন্তা করেন তার কাজটা যেন পরিবেশবান্ধব হয়। সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দনের পাশাপাশি পরিবেশ সহনীয় স্থাপত্য চর্চাই তার অন্যতম লক্ষ্য। এবার শাহ্ সিমেন্ট সুইট হোমে তাকে নিয়ে প্রতিবেদন লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক

স্থপতি নাজলী হোসেনের বাড়ি ফেনী জেলায়। কিন্তু তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। নাজলীর বাবার নাম বেলায়েত হোসেন। তিনি একজন ইঞ্জিনিয়ার। মা চেমনা আফরোজ হোসেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। তিন বোনের মধ্যে নাজলী হোসেন সবার বড়। স্কুলে পড়াকালীন নাজলীর ছবি আঁকাআঁকির প্রতি ছিল নেশা। গান গাওয়া, গল্পের বই পড়া ছিল তার পছন্দের বিষয়। তবে ছবি আঁকার ঝোঁকটা ছিল অনেক বেশি। ছোটবেলা থেকে নাজলীর ইচ্ছা ছিল মেডিক্যালে পড়াশোনা করবে, ডাক্তার হবে। মেডিক্যালে ভর্তি হওয়ার জন্য কোচিং করার সময় আর্কিটেক্টচার বিষয়টি সম্পর্কে উৎসাহিত হন তিনি। নিজের ইচ্ছা থেকেই আর্কিটেক্ট হওয়া তার।

নাজলী হোসেন ভিকারুননেসা নুন স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করেন ১৯৯৮ সালে। ২০০০ সালে একই কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে। এ সময়ে তার সহপাঠী বন্ধুদের মধ্যে আছেন স্থপতি রাসেল, অমি, মুনিম ও মিতু। এরা সবাই প্রতিষ্ঠিত আর্কিটেক্ট। প্রিয় শিক্ষকের তালিকায় আছেন স্থপতি ড. খন্দকার সাব্বির আহমেদ, মাহমুদুল আনোয়ার রিয়াদ।

স্থপতি নাজলী হোসেন ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন ২০০৮ সালে। পাস করে বের হওয়ার পর পরই তিনি তানিয়া করিম এন আর খান এন্ড অ্যাসোসিয়েট ফার্মে কাজ করেন। পাশাপাশি নর্থ সাউথ বিশ^বিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগে শিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি যোগ দেন স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ-এ। সেখানে দেড় বছর শিক্ষকতা করেন। ২০১১ সালে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি থেকে কন্সট্রাকশন ম্যানেজমেন্টের ওপর গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা করেন।

২০০৯ সালে নাজলী নিজে গড়ে তোলেন ‘প্র্যাক্সিস আর্কিটেক্টস’ নামের একটি ফার্ম। কলাবাগানে তিনি খুব সুন্দর একটি অফিস সাজিয়েছেন। তাদের প্রতিষ্ঠানে বেশ কয়েকজন অভিজ্ঞ স্থপতিসহ মোট ৭ জন কর্মী কাজ করছেন। তাদের প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ১২ তলা কমার্শিয়াল বিল্ডিং,  বি এইচ টাওয়ার, এনসিসি ব্যাংকের বিভিন্ন ব্র্যাঞ্চের ইন্টেরিয়র, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ইন্টেরিয়র, নারায়ণগঞ্জের রূপসী টাওয়ার, ধামরাইয়ের মি. মনির উদ্দিনের ভিলা, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের বিভিন্ন ব্র্যাঞ্চের ইন্টেরিয়র, বারিধারায় লাব্বি গ্রপের চেয়ারম্যানের ১১ তলা বিল্ডিংয়ের ডিজাইন, গাজীপুরের শ্রীপুরে ক্লাইমেন্ট টেকনোলজি পার্ক, মতিঝিলের সোস্যাল ইসলামি ব্যাংকের ইন্টেরিয়র, বারিধারার মি. কামাল উদ্দিন ট্রীপ্লেক্স বিল্ডিংয়ের ইন্টেরিয়র, শরিয়তপুরের মি. সাকিদারের ৫ তলা রেসিডেন্স বিল্ডিং, এসবিএসি ব্যাংকের বিভিন্ন ব্র্যাঞ্চের ইন্টেরিয়র, মতিঝিলের সিটিএনএ ব্যাংকের ইন্টেরিয়র, ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় প্রায় ১২০টির মতো ব্র্যাঞ্চের ইন্টেরিয়রসহ অসংখ্য অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করেছেন স্থপতি নাজলী হোসেন। এছাড়াও বেশকিছু নতুন প্রজেক্টের কাজ করছেন তিনি। স্থপতি নাজলী হোসেন তার সব ধরনের কাজ স্থাপত্যনীতি ও রাজউকের নিয়ম মেনেই করেন। ২০১০ সালে তিনি বিয়ে করেন। স্বামীর নাম মুহতাদিন ইকবাল। তিনিও একজন আর্কিটেক্ট।

Nazni_projectস্থপতি নাজলী হোসেন বলেন, একজন স্থপতির মূল পরিচালনায় একদল প্রকৌশল ও স্থপতির সম্মিলিত কাজের ফসল হচ্ছে একটি সফল স্থাপনা। আর যখন এই স্থাপনার সফল নকশায় মূল ভিত্তি হিসেবে পরিবেশবান্ধব বৈশিষ্ট্যকে প্রাধান্য দেয়া হয়, তখন তাকে গ্রীন বিল্ডিং বলা হয়। উন্নত বিশ্বে এই ধরনের পরিবেশবান্ধব গ্রীন বিল্ডিংয়ের ধারণাকে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয় যে কোনো স্থাপনার নকশা প্রণয়নের ক্ষেত্রে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গ্রীন বিল্ডিংকে সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্ব রাখে গ্রীন বিল্ডিং রেটিং সিস্টেম। যার মাধ্যমে একটি কাঠামোর বিভিন্ন প্রাকটিসকে বিশ্লেষণ করে একটা গাইড লাইন তৈরি থাকে। যা অনুসরণ করে স্থাপনার নকশা প্রণয়ন এবং তৈরি করা হলে সেই সকল স্থাপনাকে সার্টিফাইড গ্রীন বিল্ডিং বলা হয়ে থাকে।

বিশ্বে বিভিন্ন জনপ্রিয় এই ধরনের রেটিং সিস্টেমের মাধ্যমে লীড (LEED) সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। যা ইউএস গ্রীন বিল্ডিং কাউন্সিল প্রণয়ন করে থাকে। যে সব প্রফেশনাল ইউএস গ্রীন বিল্ডিং কাউন্সিলের অথরাইজড হিসেবে সার্টিফিকেশনের কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেন তাদের বলা হয় লীড অ্যাকরেডিটেড প্রফেশনাল (LEED AP)। তিনি আরো বলেন, ২০১৪ সালে আমি একজন লীড এপি হিসেবে ইউএস গ্রীন বিল্ডিং কাউন্সিল কর্তৃক স্বীকৃতি পাই। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লীড সার্টিফাইড গ্রীন বিল্ডিং-এর ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে। বিশেষত ইন্ডাস্ট্রিয়াল বিল্ডিং এবং কমার্শিয়াল হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে।

তিনি বলেন নকশা প্রণয়নের ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব স্থাপনার বৈশিষ্ট্যগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। প্রকৃত পক্ষে বাংলাদেশের স্থাপতি হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি বিশ্বের পরিবেশ বিষয়ক ইউনিভার্সেল ডিজাইন আইডিয়াকে আমাদের দেশের স্থাপনাগুলোতে প্রয়োগের আগ্রহ থেকেই ইউএস গ্রীন বিল্ডিং কাউন্সিলিং-এর সঙ্গে প্রফেশনাল হিসেবে কাজ করার অনুপ্রেরণা পাই।

লীড এপি হিসেবে বর্তমানে তিনি বেশকিছু প্রজেক্টের কাজ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজগুলো হলো- গুলশান-১ এ সাউথ ব্রীজ হাউজিং লিমিটেডের কমার্শিয়াল বিল্ডিং সাইথ স্কয়ার, গাজীপুরের অভানত গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিয়াল বিল্ডিং, কুমিল্লায় আমির শার্টস ইন্ডাস্ট্রিয়াল বিল্ডিং। বর্তমানে তার এই প্রজেক্টগুলো ইউএস গ্রীন বিল্ডিং কাউন্সিল-এর মাধ্যমে লীড সার্টিফিকেশনের জন্য রেজিস্ট্যার্ড রয়েছে।

বাংলাদেশের আবহাওয়া, জলবায়ু ও প্রকৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিটি কাজে গুরুত্ব দেন স্থপতি নাজলী হোসেন। এই স্থাপতি তার কাজ সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে করতে ভালোবাসেন। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে স্থপতি নাজলী বলেন, একজন স্থপতি হিসেবে বাংলাদেশে আরো বেশি পরিবেশবান্ধব স্থাপনা তৈরির কাজে নিজেকে যুক্ত থাকা এবং একই সঙ্গে বিশ^ স্বীকৃত লীড প্রফেশনাল হিসেবে বাংলাদেশের নাম উচ্চতর শিখরে নিয়ে যেতে চাই।