Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

নদীর চোখেও জল নেই -মুকিত মজুমদার বাবু

আগের মতো নদী নেই। নদীতে জল নেই। জলে মাছ নেই। দিন দিন নদীর জল মাছশূন্য হয়ে যাচ্ছে। শুকিয়ে যাওয়া নদীতে মাছ আসবে কোত্থেকে! বিশেষ করে এই গ্রীষ্ম মৌসুম এলে নদীর সর্বনাশা চেহারাটা মানুষের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি নদী একটি দেশকে বাঁচিয়ে রাখে। নদীর জলে আবাদ হয় কৃষিজাত পণ্য। নদীর জলে সংরক্ষিত হয় জীববৈচিত্র্য। স্বপ্নের সেই ছলছল কলকল নদী হারিয়ে এখন খালে পরিণত হয়েছে। আর খাল পরিণত হয়েছে মানুষের বসতি কিংবা হাটবাজারে। দখলের এ নগ্ন চেহারা বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাগুলোতেই কমবেশি দেখা যায়। এখন রঙ-বেরঙের পাল উড়িয়ে মাঝি আর মনের সুখে গায় না- ‘আমি রঙিলা নায়ের মাঝি’। মাঝির মনে আজ সুখ নেই। জেলেরা বারোমাসী অভাবের ভেতর দিনযাপন করছে।  নৌকা চলার উপযুক্ত নদীগুলোতে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে ট্রলার। ভট ভট শব্দ করে জলজ প্রাণীর মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। জলজ প্রাণীর প্রজননে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে ইলিশের প্রজননের ক্ষেত্র। এমনকি আমাদের জলসীমার বাইরে।

বর্তমানে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল কিংবা ছোট ফাঁসের জালের ব্যবহারের কারণে ছোট-বড় সব মাছ ধরা পড়ছে জেলেদের হাতে। যার কারণে নদীর মাছ মানুষের কাছে দিন দিন সোনার হরিণে পরিণত হচ্ছে। দেশে যদি চাষের মাছ না থাকতো তাহলে বিশাল এই জনসংখ্যার আমিষের চাহিদা কীভাবে পূরণ হতো তা ভাবতে গেলেও অবাক লাগে। ছোটবেলায় দেখেছি প্রাকৃতিক উৎস থেকে জন্মানো কৈ, মাগুর, শিং, পাবদা, চাপিলা, টাকি, রুই, বাইন, কাতলা, মৃগেল, চিতল, রিঠা, পাঙ্গাস, শোল, টাকি, মহাশোল, বোয়াল প্রভৃতি সুস্বাদু দেশি মাছ। এখন পিরানহা, আফ্রিকান মাগুর, তেলাপিয়া, থাই সরপুঁটি, পাঙ্গাসের দখলে হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় মাছের বিভিন্ন প্রজাতি।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হলেও স্রোতস্বিনী নদীর আজ বড়ই অভাব। এক সময় বাংলাদেশে সহস্রাধিক নদী জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও এখন জীবন্মৃত হয়ে টিকে আছে অর্ধেকেরও কম। দেশের অনেক স্থানেই নদীতে এখন নৌকা চলে না। চলে যানবাহন। বিকট শব্দ করে এপাড় থেকে ওপাড়ে চলে যায় যাত্রীবাহী বাস, বালু ভর্তি ট্রাক। কোথাও কোথাও হাঁটু পানি ডিঙিয়ে তৈরি হয়েছে মানুষের চলাচলের রাসত্মা। আবার কোথাও নদীর বুকে কৃষকরা ধান রোপণ করে ফসল ফলাচ্ছে। মরা পদ্মায় এখন ড্রেজিং না করলে ফেরি চলে না, লঞ্চ চলে না। ডুবো চরের সৃষ্টি হয়েছে। অথচ এই পদ্মাই এক সময় উত্তাল ছিল। বাংলা সাহিত্যে কতো ভাবেই না তার ধ্বংসাত্মক রূপের বর্ণনা দিয়েছেন কবি সাহিত্যিকেরা। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন সেই বিখ্যাত শ্লোগানের কথা মনে পড়ে-‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’ কিংবা বিখ্যাত সেই কবিতার লাইন- ‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌড়ি বহমান, ততদিন তুমি রবে শেখ মুজিবুর রহমান’। যদিও আজ বহতা পদ্মা আছে তবে তার সে ক্ষুরধার স্রোত আর নেই। পদ্মার বুকে জেগে উঠেছে চর। এপাড় থেকে ওপাড় পর্যনত্ম বাঁশ পুঁতে ছোট-বড় মাছ ছেঁকে তোলা হচ্ছে। আর এটা ঘটছে প্রশাসনের নাকের ডগায়। যমুনার বুকে ঘর বেঁধে বসতি গেঁড়েছে মানুষ। মেঘনার অবস্থাও আজ করুণ।

নদীমাতৃক দেশ থেকে আজ নদী হারিয়ে যাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে নদীর তলদেশে পলি পড়ে ভরাট হওয়ার কারণে দেশে বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রসত্ম হচ্ছে মানুষ। অকাল বন্যায় ভেসে যাচ্ছে কৃষকের স্বপ্ন-সাধ। আবার শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে খরায় পুড়ছে মাঠের পর মাঠ।

 

এক সময় নীলনদকে মিশরের দুঃখ বলা হলেও নীলনদের পানি দিয়ে এখন চাষাবাদ হচ্ছে। অথচ আমাদের জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নদীগুলো দিন দিন শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হচ্ছে। দু’কূল ভাঙা স্রোতস্বিনী আর তাকে কিছুতেই বলা যায় না। আর এর ফলে জীববৈচিত্র্য হয়ে পড়ছে অরক্ষিত।

নদীর করুণ দশার জন্য আমরা নিজেরা যেমন দায়ী তেমনি বৈরী জলবায়ুও কম দায়ী নয়। পরিবেশের কথা না ভেবে অপরিকল্পিতভাবে আমরা নদীকে শাসন করছি। আবার পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের সাথে পানিচুক্তি থাকলেও পুরোপুরি তা কার্যকর নয়। উৎপত্তিস্থল থেকে যদি পানি নিয়ন্ত্রণ করে চুক্তি ভঙ্গ করা হয় তাহলে দেশের জনগণ তার সমাধান করতে পারবে না। সমাধান করতে হবে সরকারকে। দেশের মানুষ বাঁচাতে, প্রকৃতি বাঁচাতে, আমাদের হিসাব আমাদেরই বুঝে নিতে হবে।

লেখক: চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন