Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

তবুও তারুণ্যই ভরসা

সৈয়দ ইকবাল
তর্কটা বেশ জমেই উঠেছিল। তর্কের বিষয়, আজকের সময়ের তরুণ অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সিনিয়রদেরকে তেমন একটা পাত্তাই দেয় না। শুটিং স্পটে দেরী করে আসে। আবার এসেই ‘যাই যাই’ শুরু করে। সুটিং হাউসে সাধারনত মেকআপ রুমেই তারকাদের আড্ডা হয়। কারণ সুটিং বাড়ির মেকআপ রুমে এসি থাকে। এসির ঠান্ডা বাতাসে জম্মেশ আড্ডা দিতে বেশ মজা। সুটিং চলাকালে মেকআপ রুমেই গসিপও হয় বেশী। অমুক তেমন অভিনেতাই নন। তমুক কোনো অভিনেত্রী হলো নাকি? অভিনয়ের ‘অ’ও জানেনা। অথবা কে কার সাথে প্রেম করছে, কে কাকে সুটিং এ ফাঁসিয়েছে, কোন সুটিং ইউনিট কেমন? অমুক তো পরিচালকের জাতই না। ক্যামেরা ম্যানের ওপর নির্ভর করে নাটক বানায়Ñ এই ধরনের কথার ফুলঝুরি ছোটে মেকআপ রুমে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তরুণ-অভিনেতা-অভিনেত্রীর সংখ্যা যদি হয় বেশি তাহলেই বাধে বিপত্তি। তখন প্রবীণ অভিনেতাদেরকে বাধ্য হয়ে মেকআপ রুমের বাইরে চলে যেতে হয়। অথবা প্রবীণ অভিনেতা, অভিনেত্রীদের দেখলে তরুণেরাই বাইরে চলে যান।
আড্ডায় এইসব বিষয় নিয়েই কথা হচ্ছিলো। একজন প্রবীণ অভিনেতা বললেন, বর্তমান সময়ের কথা আর বলবেন না। তরুণ ছেলে-মেয়েরা তো প্রবীণদের পাত্তাই দেয় না। মোবাইল সংস্কৃতি চালু হওয়ায় একজনের সাথে অন্যজনের স্বাভাবিক কথাবার্তাও যেন বন্ধ হয়ে গেছে। সবাই এখন আড্ডা আলোচনায় বসলেই পরস্পরের সাথে কথা বলার চেয়ে মোবাইল চর্চায় ব্যস্ত থাকে বেশী। পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও অনেক সময় প্রাণ খুলে কথা বলার সময় হয় না। সবাই হয়তো যার-যার কাজে ব্যস্ত। ঘরে ফিরলেও ব্যস্ততা শুরু হয় মোবাইল নিয়ে।
মোবাইল ব্যস্ততার একটি কাহিনী বলি। বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব হুমায়ূন ফরীদি তখন বেঁচে ছিলেন। একটি নাটকের প্রয়োজনে আউটডোরে সুটিং করতে গেছেন। একজন তরুণ অভিনেতার সাথে অভিনয় পর্ব চলছিল। পরিচালক যখন অ্যাকশন বলেন তখন তরুণ অভিনেতার মোবাইলে ফোন আসে। সাথে সাথে সে ‘এক মিনিট’ বলেই দূরে গিয়ে ফোনে কথা বলে আবার অভিনয়ের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ে। একই সিকোয়েন্স একাধিকবার এই ঘটনা ঘটলো। পরিচালক অ্যাকশন বলা মাত্রই তরুণ অভিনেতার মোবাইলে ফোন আসে। সে ‘স্যরি এক মিনিট’ বলেই দূরে গিয়ে কথা বলে আবার অভিনয়ের জন্য দাঁড়ায়।
হুমায়ূন ফরীদি ব্যাপারটা খেয়াল করছিলেন। তিনি যারপর নাই বিরক্ত হয়ে ওঠেন। মোবাইলে কথা বলে তরুণ অভিনেতাটি সবেমাত্র শর্ট দেয়ার জন্য দাঁড়িয়েছে। পরিচালক অ্যাকশন বলতেই শর্ট শুরু হলো। শর্ট চলছে। হঠাৎ তরুণ অভিনেতার মোবাইলে ফোন আসে। সাথে সাথে হুমায়ূন ফরীদি ফোনটি কেড়ে নিয়ে দূরে একটি ডোবায় ছুঁড়ে ফেলে দেন। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতভম্ব। কিন্তু কেউ কথা বলার সাহস পাচ্ছিলেন না। এক পর্যায়ে তরুণ অভিনেতাটি নিজের ভুল বুঝতে পেরে হুমায়ূন ফরীদির কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। ফরীদিও তাকে মাফ করে দিয়েছিলেন। পরবর্তিতে দুই অভিনেতার মাঝে গভীর বন্ধুত্ব হয়েছিল। বর্তমান সময়ের একজন তরুণ অভিনেতা ঘটনাটি উল্লেখ করে হতাশার সুরে বললেন, ‘মাঝে মাঝে আমিও অভিযোগ শুনি যে, আমরা তরুণেরা নাকি বড়দেরকে তেমন শ্রদ্ধা, সমীহ করি না। কিন্তু বড়রাই কি শুধু শ্রদ্ধা পাবে? ছোটদের ¯েœহ পাবার অধিকার নাই। সময়টা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, আপনি হয়তো অমুক বড় ভাইয়ের সাথে ভালই যোগাযোগ রাখেন। তাকে শ্রদ্ধা সমীহ করেন। এটা শুনে তমুক বড় ভাই হয়তো নাখোশ হন। কিন্তু আমি তো সবার কাছেই শিখতে চাই। যোগাযোগ রাখতে চাই। বড়রা যদি স্পেশ না দেন তাহলে আমরা কি করবো? কোথায় গিয়ে দাঁড়াব? কথায় আছে শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে… আমরা কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এই পরিবেশ পাচ্ছি না।’

আরেকজন তরুণ অভিনেতা বললেন, ‘আমরা তো প্রবীণদের কাছে শিখব, নাকি? তারাই তো আমাদেরকে শেখাবেন। কিন্তু সেই পরিবেশ তো নাই। চিত্র নায়িকা মৌসুমীর নাম উল্লেখ করে তিনি বললেন, কে না জানে মৌসুমী এই দেশের একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী। তাকে যদি তারই কোনো সহকর্মী দম্ভ ভরে জিজ্ঞেস করেÑ আপনি কে? তাহলে তো বড়দের কাছ থেকে শেখার কিছু থাকে না।’ এমনও হয়ে অনেক সময় অনেক শিল্পীর শট আগে নিলে, জুনিয়র কোনো শিল্পী অভিমান করে।
একজন প্রবীণ অভিনেতা বললেন, তরুণদের অভিযোগ, অনুযোগ একেবারেই মিথ্যা নয়। কিন্তু তরুণেরাও অনেক ভুল করছে। তাদের অনেকেই একটু শিখেই মহা পন্ডিত হয়ে যাচ্ছে। অন্যকে যে সম্মান শ্রদ্ধা জানাতে হয় সে কথা ভুলে যাচ্ছে অনেকে। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, বর্তমান সময়ের অধিকাংশ তরুণ অভিনেতা-অভিনেত্রী অভিনয়ের প্রতি মোটেই মনোযোগী নন। অনেকেই স্ক্রীপ্ট না পড়েই সুটিং এ আসে। এসেই অভিনয়ের চেয়ে টেলিফোন চর্চায় বেশী ব্যস্ত হয়ে যায়। ফলে প্রবীণদের সাথে তাদের খুব একটা বন্ডিং গড়ে ওঠে না। তবে তিনি স্বীকার করলেন, সময় পাল্টেছে। কিন্তু আমরা অনেকেই নিজেদেরকে পাল্টাইনি। কিন্তু যুগের প্রয়োজন বলে একটা কথা আছে। সেটাকে তো স্বীকার করে নিতেই হবে।
আমরা আনন্দ আলো পরিবার মনে করি তরুণদের ভালোবেসেই জায়গা করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রবীণদের ভ‚মিকাই অগ্রগণ্য হওয়া উচিৎ। পাশাপাশি তরুণদেরও উচিৎ প্রবীণদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা।
একটা সময় আমাদের চলচ্চিত্র ও টিভি নাটকের কাহিনীতে পরিবারের কথাই গুরুত্ব পেত। বাবা-মা, ভাই-বোন, চাচা-চাচী, খালা-খালু, দাদা-দাদী, চাচা-চাচী, খালাত ভাইবোন মিলে পরিবারের সবার কাহিনীই গুরুত্ব পেত নাটক, সিনেমায়। বর্তমান সময়ে টিভি নাটকে নায়ক, নায়িকা ছাড়া পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কোনো ভ‚মিকাই থাকে না। ফলে নাটকের পরিবারে মায়া-মমতার জায়গাটা বড়ই নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে।
যে যাই বলুক, ভালো কাজের জন্য সুখি পরিবারের কোনো বিকল্প নাই। তরুণেরাই সুখি পরিবারের আলোকবর্তিকা। যেমন আমাদের চলচ্চিত্রে আলো ছড়াচ্ছেন তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি ইয়াশ রোহান, পুজা চেরী সহ আরও অনেকে। টিভি নাটকে দ্যূতি ছড়াচ্ছে তৌসিফ, জোভান, তানজিন তিশা, মেহজাবীন চৌধুরী সহ আরো অনেকে। সঙ্গীতে সম্ভাবনার আলো ফেলেছেন ইমরান, কোনাল, লিজা, পড়শি, কর্নিয়া, ঐশি সহ আরো অনেকে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর জগত আলোকিত করছেন তরুণেরাই। কাজেই তরুণদের প্রতি আরও ভালোবাসা চাই।
অবশ্য তরুণদেরও একটা কথা মনে রাখা উচিৎ। ভালোবাসা পেতে হলে ভালোবাসা দিতেও হয়। প্রবীণদের শ্রদ্ধা করলে তরুণরাই লাভবান হবে। বন্ধুরা মনে রাখবেন, প্রবীণদের ভালোবাসার শক্তি ও মায়া অনেক। জয় হোক ভালোবাসার….