সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2001-2021 - আনন্দ আলো
ধন্দুমার মারপিট, নায়িকার বৃষ্টিভেজা গান এবং শেষ দৃশ্যে পারিবারিক মিলন- এমনই ছিল এক সময় বাংলা চলচ্চিত্রের গল্প। বেকার যুবক, সমাজের প্রতিবাদী নারী কিংবা মাদক চোরাকারবারকারীকে ধরার জন্য সৎ পুলিশ অফিসারের গল্পই ছিল চলচ্চিত্রের মূল উপজীব্য বিষয়। তবে গত কয়েক বছরে চলচ্চিত্রের গল্পে এসেছে বেশ পরিবর্তন। বিকল্পধারা-ভিন্নধারা কিংবা মূলধারার বাইরে গিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের যেন হিড়িক লেগেছে। শুধু তাই নয়- সেসব সিনেমা দর্শকদের নজরও কাড়ছে বেশ। নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার নির্মিত ছবিগুলো দিয়ে দর্শকদের কাছে আলাদা নজর কাড়তে সক্ষম হন। অন্যদিকে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার, টেলিভিশন, পিঁপড়া বিদ্যার মতো সিনেমাগুলো দর্শকরা গ্রহণ করেছেন বেশ। একটু পেছনের দিকে গেলে বলা যায়- তারেক মাসুদের মাটির ময়না, রানওয়েসহ এই নির্মাতার অন্যান্য ছবিগুলোও ভিন্নধারার সিনেমা নির্মাণের নতুন দিক রেখা সৃষ্টি করেন। তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলামসহ জনপ্রিয় নির্মাতারাও দেশের চলচ্চিত্র শিল্পে ভিন্নধারার সিনেমা নির্মাণ করে আলোচিত হন। এবং দেশ-বিদেশে নানা পুরস্কারে ভূষিত হন।
তাই তো হাল সময়ে এমন সিনেমা নির্মাণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। আশার কথা হচ্ছে- এসব সিনেমা চলচ্চিত্রবোদ্ধা থেকে শুরু করে দর্শকদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে। সম্প্রতি অমিতাভ রেজার ‘আয়নাবাজি’র সফলতা চলচ্চিত্রে অন্যরকম আলোচনার সৃষ্টি করে। চিরাচরিত চলচ্চিত্রের গল্পের বাইরে গিয়ে একটি ভিন্ন গল্প বলা হয়েছে ছবিটিতে। তাই তো দর্শকরা গ্রহণ করেছেন বেশ। এর আগে গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ‘মনপুরা’ও জনপ্রিয়তার আকাশ ছুঁয়েছিল। মুরাদ পারভেজের ‘বৃহন্নলা’, তৌকীর আহমেদের ‘অজ্ঞাতনামা’, কামার আহমেদ সাইমনের ‘শুনতে কি পাও, আশরাফ শিশিরের ‘গাড়িওয়ালা, প্রশান্ত অধিকারির ‘হাডসনের বন্দুক’, মাসুদ পথিকের ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’, গাজী রাকায়াতের ‘মৃত্তিকা মায়া’ কিংবা জাহিদুর রহমান অঞ্জনের ‘মেঘমল্লার’, মেহের আফরোজ শাওনের ‘কৃষ্ণপক্ষ’, অনিমেষ আইচের ‘জিরো ডিগ্রি’, প্রসূন রহমান পরিচালিত ‘সূতপার ঠিকানা’-সিনেমাগুলোকে ভিন্নধারার সিনেমায় বলা চলে। এসব ঘরানার সিনেমা চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে বেশ প্রশংসা লাভ করে। এর পাশাপাশি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও জিতে নেয় নানা পুরস্কার। আমাদের দেশে এখন বাণিজ্যিক সিনেমার পাশাপাশি ভিন্নধারার সিনেমা নির্মাণ বেশ জোরালো হয়ে উঠছে। তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলাম কিংবা তারেক মাসুদের পর অনেক প্রতিভাবান-তরুণ তাদের মেধা ও মননশীলতাকে ফুটিয়ে তুলছেন সেলুলয়েডের ফ্রেমে। বর্তমানে সরকারি অনুদান প্রাপ্তসহ বেশ কিছু সিনেমা তৈরির কাজ চলছে। কিছু সিনেমা কাজ সম্পন্ন হয়ে এখন আছে মুক্তির অপেক্ষায়।
আবার কিছু সিনেমার কাজ অর্ধেকেই থেমে আছে। তবে ভিন্নধারার সব সিনেমা যে, রুচিশীল এবং মৌলিক গল্পের দাবিদার, তা কিন্তু না। কলকাতার আর্টফিল্মের আঙ্গিকেও অনেক নির্মাতা অসমপ্রেম-পরকীয়া, সমকামিতা কিংবা যৌনতার বিষয়গুলোকে স্থান দেয়ার চেষ্টা করছেন সেসব সিনেমায়। আবার সরকারি অনুদান পাওয়া সিনেমাগুলো বাণিজ্যিকভাবে মুক্তি দিলেও অনেক সিনেমাই ব্যবসা করতে দেখা যায়নি। প্রেক্ষাগৃহে বেশিরভাগ সিনেমাই টেকেনি সপ্তাহ দুয়েকও। প্রায় ক্ষেত্রেই সিনেমা নির্মাণে অনুদান পেয়েছেন অনভিজ্ঞরা। চলচ্চিত্র গবেষক ও অন্যান্য নির্মাতারা এমন অভিযোগও করেন। ঢাকাই সিনেমার উন্নয়নে ১৯৭৯ সাল থেকে এইখাতে অজস্র টাকা ঢেলে আসছে সরকার।
বর্তমানে ভিন্নধারার ছবির মধ্যে মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে সেলিম আল দীনের ‘যৈবতী কন্যার মন’ অবলম্বনে নারগিস আক্তারের চিত্রনাট্য ও পরিচালনায়-যৈবতী কন্যার মন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘ডুব’, হাসান আজিজুল হকের গল্প ও খান সরফুদ্দিন মোহাম্মদ আকরামের চিত্রনাট্য এবং পরিচালনায় ‘খাঁচা’, শহীদুল জহিরের গল্প ও টোকন ঠাকুরের চিত্রনাট্য এবং পরিচালনায় ‘কাঁটা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প অবলম্বনে টোকন ঠাকুরের ‘রাজপুত্তুর’, রিকিয়া মাসুদের ‘দ্য স্টোরি অব সামারা’, রওশন আরা নিপার ‘মহুয়া সুন্দরী’সহ আরো অনেক সিনেমা। আরো রয়েছে অনিমেষ আইচ-এর ‘ভয়ংকর সুন্দর’, হাসিবুল রেজা কল্লোলের ‘সত্তা’, সাইফুল ইসলাম মান্নুর ‘পুত্র’সহ আরো কিছু সিনেমা মুক্তির অপেক্ষায় আছে। নির্মিত হচ্ছে নাদের চৌধুরীর ‘নদী উপাখ্যান’, ড. সাজেদুল আওয়ালের ‘ছিটকিনি’, জাঁ নেসার ওসমানের ‘পঞ্চসঙ্গী’, মুশফিকুর রহমান গুলজারের ‘লাল সবুজের সুর’, মৃত্তিকা গুণের ‘কালো মেঘের ভেলা’সহ আরো কয়েকটি সিনেমা।