Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

টেলিভিশন নাটকের মান উন্নয়ন না অবনমন?

মোস্তফা কামাল সৈয়দ
সৃষ্টির সেরা সৃষ্টি মানুষ। এই সেরা সৃষ্টি মানুষের গল্পই হলো নাটক। বাস্তব জীবনে যেমন একজন মানুষের সাথে আরেকজনের মিল থাকে না তেমনি একটি নাটকের গল্পেও থাকতে হবে চরিত্রের ভিন্নতা আর অভিনবত্ব, প্রথম দৃশ্য থেকে শেষ দৃশ্য পযর্ন্ত দর্শকের আগ্রহ যেন থাকে এবং সে যেন কৌতুহল নিয়ে অপেক্ষা করে। তাই একটি নাটকে থাকে নায়ক নায়িকা, খলনায়ক, খলনায়িকা শিশু সহ একাধিক সহযোগী চরিত্র। একটি ভাল নাটক হতে পারে শিক্ষনীয়, অর্থবহনকারী ও বার্তাবাহক। আনতে পারে আচরন ও দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন, হতে পারে মুল্যবোধ সৃষ্টির উদ্দিপক। হতে পারে জীবনের কোন সমস্যা সমাধানের নির্দেশক। জাগাতে পারে উৎসাহ উদ্দীপনা, জোগাতে পারে ঘুরে দাঁড়াবার প্রেরণা।
একটি নাটকে থাকতে হবে জীবনের নানবিধ উপাদান, প্রেম ভালোবাসা, ¯েœহ, স্বার্থহীনতা, অন্যকে সম্মান করার মনোভাব, কৃতজ্ঞতাবোধ সম্পন্ন, চরিত্র ক্ষমতায়ান, মুল্যবোধ সৃষ্টি, ক্ষমা করার মানসিকতা, প্রেরণা (গড়ঃরাধঃরড়হ চধৎঃহবৎংযরঢ়) সহ শিক্ষনীয় বিষয়ের সমাহার।
নাটকের বিষয়কে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রতিটি চরিত্রের জন্য শক্তিমান অভিনেতা/অভিনেত্রী নির্বাচন বাঞ্ছনীয়। আসলে শিল্পীরা হলেন নাটকের অলঙ্কার। যাকে যত সঠিক স্থানে ব্যবহার করা যাবে সে অলঙ্কারই তত ভাল লাগবে। এক্ষেত্রে চরিত্রের পরিপূর্ন স্ফুটনে/ প্রতিষ্ঠায় অভিনয়ের দক্ষতা নাটকের মানের ক্ষেত্রে অতীব প্রয়োজনীয়। দর্শক যদি নাটকের যে কোন চরিত্রের বিভিন্ন পরিস্থিতির সাথে নিজের কিছুটা মিল ও সঙ্গতি খুঁজে পায় তখনই নাটক আর দর্শকের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরী হয়। তৈরী হয় এক রকমের ঙহিবৎংযরঢ় বা চধৎঃহবৎংযরঢ়। নাটক বিনির্মাণের প্রথম জবয়ঁরৎবসবহঃ হচ্ছে একটি ভাল গল্প। যার মধ্যে রয়েছে জীবনের উপাদান। জীবনের মান উন্নয়নের ইঙ্গিত, হতাশার মাঝেও আশা। সময় ব্যয় করে যে দর্শক নাটক দেখে তার জন্যে নাটক দেখা শেষে থাকতে হবে পরিপূর্ন পরিতৃপ্তির নিশ্চয়তা।
ভালো নাটক নির্মাণের জন্য যেমন যথেষ্ট ও প্রয়োজনীয় অর্থের প্রয়োজন তেমনি শুধুমাত্র অর্থ উর্পাজন নাটক নির্মাণ, অভিনয় ও প্রচারের মূল লক্ষ্য হতে পারে না। বেসরকারী চ্যানেলের সংখ্যাধিক্যের কারনে নাটকের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। কিন্তু সেই অনুপাতে সার্থক গল্প, লেখক, অভিনেতা, নির্মাতার সৃষ্টি হয়েছে কি?
নাটক নির্মাণ করা হয় শুধু কি বিনোদনের জন্যে? নাটক নির্মাণের অর্থব্যয়, নির্মাণের সাথে জড়িত প্রতিটি মানুষের অর্থ্যাৎ স্ব স্ব ক্ষেত্রে জড়িত ব্যক্তির যোগ্যতা, শ্রম, অভিজ্ঞতা, নিষ্ঠা শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য নির্মিত হলে তা কি ব্যয় কার্যকরী (ঈড়ংঃ ঊভভবপঃরাব) হবে?
দর্শক আকর্ষনের মুল বিষয় হচ্ছে টিভির পর্দায় গুণগতমান। ভালো নাটক প্রচারের ক্ষেত্রে সন্মানিত বিজ্ঞাপন দাতাদের একটি শক্ত ভুমিকা থাকা উচিত। আমাদের জানা নেই এই বিষয়ে বিজ্ঞাপনদাতাদের কোন অর্থবহ পলিসি রয়েছে নাকি এ বিষয়টি শুধুমাত্র লজিক নির্ভর, বা অন্য কোন কিছু।
সর্বশেষ পেশাগত মনোভাব না থাকলে কোন ভাবেই গুনগত মান সম্পন্ন নাটক নির্মাণ করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে নাটক নির্মাণ থেকে প্রচারে জড়িত সকল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত উদ্যোগ অনিবার্য।
স্যাটেলাইট টেলিভিশিন চ্যানেলগুলি সম্পূর্নভাবে বিজ্ঞাপন নির্ভর। সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার না হলে তা অপচয়ের পর্যায়েই পড়ে বৈকি। জাতীয় সম্পদের অপচয়ের ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের এখনই সময়। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে কোন কোন ক্ষেত্রে টেলিভিশনে এমন নাটক প্রচারিত হয় যা দেখে দর্শকের মনে চ্যানেলগুলির প্রতি হতাশা তৈরী হয়। একবার ভেবে দেখুন দর্শক কেন হাতে রিমোট নিয়ে বসে থাকেন। বিষয়টি কি শুধুই বিজ্ঞাপন?
বিভিন্ন সময়ে প্রচারিত নাটক দর্শকদের মনে দাগ কাটতে সমর্থ হলেও, স¤প্রতি টেলিভিশন নাটকের কিছুটা অবনমন ঘটেছে। বলা বাহুল্য যেসব ক্ষেত্রে গল্প নির্বাচন, চরিত্রের ধরন অনুযায়ী সঠিকভাবে অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্বাচন, নাটক নির্মাণের ক্ষেত্রে যতেœর এবং পৎবধঃরারঃু এর পরিচয় পাওয়া যায় সেই নাটকগুলোই দর্শকদের অনাবিল বিনোদন দিয়ে থাকে।
ভালো নাটক নির্মাণের ক্ষেত্রে ভালো গল্প নির্বাচন প্রথম শর্ত। গল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিদেশী লেখকের পাশাপাশি বাংলাদেশের গল্প লেখকদের অগ্রাধিকার থাকা বাঞ্জনীয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে ভালো গল্প সংগ্রহের আমাদের এখনো কোন গবেষণা প্রক্রিয়া নেই।
হয়তো ভাবতে অবিশ্বাস্য হবে যে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত লেখক ছাড়াও দেশের আনাচে কানাচে এমন অনেক সৃজনশীল লেখক আছেন যারা বা যাদের গল্প নির্মাতাদের হাত পর্যন্ত পৌঁছানোর প্রক্রিয়া জানা নেই। ট্যালেন্ট হান্ট এর বিভিন্ন প্রক্রিয়া আছে, কিন্তু গল্পকার অন্বেষনে বা ভালো গল্প লেখায় উৎসাহিত ও দক্ষতা বৃদ্ধির কোন উদ্যোগ নেই। অথচ বিভিন্ন চ্যানেলে প্রতিদিন কত নাটক প্রচারিত হচ্ছে। ভালো নাটক নির্মাণের ক্ষেত্রে অভিনেতার অভিনয় দক্ষতা চরিত্রের পূর্ন পরিষ্ফুটনের প্রস্তুতি, প্রয়োজনীয় সময় প্রদান বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। সংশ্লিষ্ট সবাই একবার নিজেকে প্রশ্ন করে জেনে নিন যে আপনি/আমরা কি এই ব্যাপারে তৃপ্ত? আনন্দিত?
একই মুখ প্রায় প্রতিটি নাটকে দেখা যায়। অথচ অনেক সম্ভাবনাময় শিল্পী আছেন যারা সুযোগ পেলে কাঙ্খিত দক্ষতা অর্জন করতে পারবেন অল্প সময়ে।
সমাজ পরিবর্তনশীল। সমাজের বর্তমান সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করে সেই আঙ্গিকে গল্প লেখার বা লেখানোর উদ্যোগ নিন। এসব গল্পে যেন থাকে সমস্যা সমাধানের সম্ভাব্য ইঙ্গিত। যাতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে থাকে ইতিবাচক বার্তা, ইতিবাচক চরিত্র ও ইতিবাচক ঘটনা। তবেই নাটক হবে জীবনধর্মী ও বাস্তব সম্মত। ছুঁয়ে যাবে সমস্যা বিহŸল দর্শকের মন। প্রতিটি চ্যানেলের বিভিন্ন বিভাগ গুলির পাশাপাশি অনুষ্ঠান ও বিপণন বিভাগ দুটি গুরুত্বপূর্ন। উল্লেখিত দুটি বিভাগের কার্যকারিতা চ্যানেলের অস্তিত্ব, প্রচার ও প্রসারের জন্য যেমন গুরুত্ব¡পূর্ন তেমনি বিভাগ দুটির দায়িত্ব সম্পূর্ন আলাদা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সামর্থ্যও ভিন্ন। আবার এও সত্যি যে চ্যানেলের জনপ্রিয়তার প্রশ্নে দুটি বিভাগের সফলতা পরস্পরের জন্য সম্পূরক। শ্রদ্ধাশীল সম্পর্কই চ্যানেলটিকে করে তুলতে পারে একটি ঈড়সঢ়ধপঃ প্রতিষ্ঠান হিসেবে।
নাটকের জন্য আবহ সঙ্গীতের প্রয়োজনীতা অপরিসীম। সঠিক আবহ সঙ্গীতের ব্যবহারে মৌলিকত্ত¡ জরুরি। নাটকের ঝরঃঁধঃরড়হ উবসধহফ করে সেই ক্ষেত্রে অঢ়ঢ়ৎড়ঢ়ৎরধঃব জনপ্রিয় গান ব্যবহার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনের সাথে নাটকের একটি সেতু বন্ধন হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে।
ভালো নাটকের ক্ষেত্রে আলোক (খরমযঃ) এবং শব্দের (ঝড়ঁহফ) ভূমিকা গুরুত্বপূর্ন। ঝকঝকে ছবি আর শব্দ নাটকের গুণগতমান বৃদ্ধি করে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলের যতœশীল হওয়া প্রয়োজন। বর্তমান সময়ে ঞবপযহড়ষড়মু-র যে উন্নয়ন ঘটেছে তার পরিপূর্ন ও যথা সম্ভব প্রয়োগ নির্মাতাকে সফল করতে বিশেষ অবদান রাখতে পারে।
নাটকের নাম বা ঞরঃষব দর্শককে বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট করে বৈকি। এ বিষয়ে নির্মাতাদের দায়িত্ব অপরিসীম। বলা যায় শুরু যার ভালো তার শেষ ভালো। নাটকের শুরু থেকে শেষ প্রতিটি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবার একাগ্রতা থাকতে হবে। থাকতে হবে ভালোবাসা এবং আন্তরিকতা।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য পৃথিবীখ্যাত। যদিও দুরের খড়পধঃরড়হ এ যাওয়া কিছুটা ব্যয় বহুল তবুও প্রয়োজনের অঢ়ঢ়ৎড়ঢ়ৎরধঃব খড়পধঃরড়হ এর ব্যবহার নাটককে করে তুলতে পারে অভিন্ন, অপূর্ব।
বিশেষ দিনগুলোতে স্মরণ করে নাটকের গল্প লেখা, নাটক নির্মাণের প্রয়াসগুলো আরো বাড়ানো দরকার। আমাদের জাতীয় জীবনে এর মুল্য অনস্বীকার্য। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের নাটকগুলি বেশির ভাগই গতানুগতিক। ফর্মূল্যার বাইরে কি আর কোনো ভিন্নধর্মী বিষয়বস্তু নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নাটক নির্মাণ করা যায় না? এখন সময় এসেছে নির্মাতা ও নাট্যকারদের এই বিষয় গভীরভাবে ভেবে দেখার।
কস্টিউম বা পোশাক নাটকের জন্য একটি বিশেষ দিক। চরিত্রের সাথে সঙ্গতি রেখে রুচিশীল, আধুনিক সনাতন আকর্ষনীয় কস্টিউম আমাদের জাতীয় চরিত্রের প্রতিফলনে সহায়ক। এ ব্যাপারে অবহেলার কোন সুযোগ নেই।
রূপসজ্জা বা এর বিষয়টি নাটকের জন্য খুবেই গুরুত্বপূর্ন। চরিত্রের প্রয়োজনে ভালো রূপসজ্জাকারের ভূমিকা শিল্পীর জন্য বিশেষ জরুরী। বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্যতার সাথে সম্পর্কিত। ভালো নাটকের জন্য শুধু ভালো গল্পই যথেষ্ট নয়। সফল নাট্যরূপ গল্পের সফল প্রয়োগের জন্য অতীব জরুরি।
যে জিনিসটি নাটকের জন্য অপরিহার্য তা উল্লেখ না করলেই নয়, তা হল নাটক যন্ত্রস্থ করার আগে মহড়া। এই বিষয়টি আর গোপনীয় নেই যে এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অনেকেই আগ্রহশীল নন অথবা অসহায়। এ অসহায়ত্ব, আগ্রহহীনতা কার ক্ষতি সবচেয়ে বেশী, শিল্পীর, নির্মাতার নাকি প্রতিষ্ঠানের? এ ব্যাপারে সমবেত ভাবে উদ্যোগ নেয়া জরুরি।
তরুণ নির্মাতারা আমাদের জাতীয় সম্পদ। তাদের প্রতিভা, সৃজনশীলতা, সততা, আন্তরিকতা, পেশাগত মনোভাব ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে তারাই স্ব উদ্যোগী। তারপরও অনেক ক্ষেত্রেই তাদের কিছু চাহিদা প্রয়োজনে সহযোগিতার প্রয়োজন হতেই পারে। তাদের মধ্যে ঐবধষঃযু ঈড়সঢ়বঃরঃরড়হ বাড়ানোর জন্য জাতীয় পর্যায়ে কিছু উদ্যোগ গ্রহণের এখনই সময়।
শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানের লাভ নয় নাটক নির্মাণের সাথে জড়িত সর্বক্ষেত্রে স্বীকৃতি না থাকলে ভালো নাটক নির্মাণে আকৃষ্ট করা কঠিন। অনেক ক্ষেত্রেই স্বীকৃতি, পুরস্কার প্রদানের প্রথা চালু হয়েছে কিন্তু টেলিভিশন চ্যানেলে ভালো নাটকের জন্য এই ধরনের প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাব আছে বৈ কি!
বর্তমানে প্রায় সব চ্যানেলে মেগা সিরিয়ালের আধিক্য বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। এ বিষয়ে আমি কোন মন্তব্য করতে চাই না। তবে, প্রখ্যাত অভিনেতা, নির্মাতা ও নাট্যকার আবদুল্লাহ আল মামুনের মেগা সিরিয়াল সম্পর্কিত একটি লেখা ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর মূল্যবান বক্তব্যের কিছু অংশ নির্মাতাদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরে আমার লেখার ইতি টানছি।
‘নির্মাতাদের শুরুটা নয়, শেষটা আগে নির্ধারণ করতে হবে। অথচ হুড়মুড় করে মেগা সিরিয়াল নির্মাণ করছেন অনেকে, নাটক চলতে থাকে এর লেখা হতে থাকে, ফলে একেক পর্যায়ে গিয়ে লেখা একেক রকম হতে থাকে। একটা সময় এসে নাটকের শুরুটা হারিয়ে যায়। যার জন্য নির্মাতাদের শেষটা ঠিক রেখে নাটক শুরু করতে হবে। গল্পকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়াটা খুব সহজ কাজ নয়। এর জন্য থাকতে হবে প্রগাঢ় প্রচেষ্টা ও প্রতিশ্রæতি ঞড়ঃধষষু ফবাড়ঃবফ ধহফ পড়সসরঃঃবফ।’
লেখক: অনুষ্ঠান প্রধান, এনটিভি