Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

চার বন্ধুর এ কিউব লিমিটেড

স্থপতি এহ্সানুল আলম, মামুনুর রশীদ চৌধুরী, কায়ছার হোসেন, সায়মা শারমীন নিপা, ওরা চারজন অনেক ভালো বন্ধু। দেশের ঐতিহ্য সমুন্নত রাখা সংস্কৃতির বিকাশ ও প্রকৃতিকে ভালোবেসে স্থাপত্য শিল্পে কাজ করে চলেছেন চারজনই। সকলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগ থেকে পাস করেছেন। চারবন্ধু মিলে গড়ে তুলেছেন ‘একিউব লিমিটেড’ নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। যা এখন এ দেশের প্রতিষ্ঠিত আর্কিটেকচারাল কন্সালটেন্সি প্রতিষ্ঠান। এ কিউব লিমিটেডকে একটা আস্থার জায়গায় আনার পেছনে রয়েছে এহ্সানুল আলমের নিরলস সংগ্রাম ও পরিশ্রম। ইতোমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার ডিজাইন তৈরি করে অনেকের নজর কেড়েছে। এবার শাহ্ সিমেন্ট সুইট হোমে চার বন্ধুকে নিয়ে প্রতিবেদন লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক
দুই ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় আর্কিটেক্ট এহ্সানুল আলম। তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালি জেলায়। কিন্তু তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। বাবার নাম এবিএম নাজমুল আলম। তিনি কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। মা রুশিয়া নাজমুল গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি ছিল তার প্রচÐ নেশা। বই পড়া, আঁকাআঁকি, ছবি তোলা ছিল তার পছন্দের বিষয়। কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার স্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন ১৯৯৯ সালে। ২০০১ সালে ইস্পাহানি কলেজ চিটাগং থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে। ২০০৯ সালে তিনি বিয়ে করেন। স্ত্রীর নাম সায়মা শারমীন নিপা। তিনিও একজন স্থপতি। এই দম্পতি এক সন্তানের জনক-জননী।
স্থপতি মামুনুর রশীদ চৌধুরীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। মামুনের বাবা মমিনুল হক চৌধুরী সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। চার ভাই বোনের মধ্যে সেঝ আর্কিটেক্ট মামুনুর রশীদ। সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে এসএসসি পাস করেন ১৯৯৯ সালে। ২০০১ সালে বাংলাদেশের রাইফেলস কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে। স্থপতি কায়সার হোসেনের গ্রামের বাড়ি বগুড়া। তার বাবা মো: দেলোয়ার হোসেন ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। মাতা কামরুন নাহার শিক্ষিকা। বগুড়া জেলা স্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন ২০০০ সালে। ২০০২ সালে বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে।
স্থপতি সায়মা শারমীন নিপার গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ। নিপার বাবা আব্দুল বাতেন কায়সার ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। মা সালেহা বেগম গৃহিণী। উদয়ন স্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন ২০০১ সালে। ২০০৩ সালে রাইফেলস পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগে। ২০০৭ সালে এহ্সানুল আলম ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। অপর তিনজনই পাস করেন ২০০৯ সালে। পাস করে বের হওয়ার পরপরই তিনজন যোগ দেন মুস্তাফা খালীদ পলাশের অধীনে ভিস্তারা আর্কিটেকস এ এবং একজন যোগ দেন মাহমুদুল আনোয়ার রীয়াদের ডিডবিøউ এম ফোর আর্কিটেকস এ।
২০১১ সালে প্রথমে এহ্সানুল আলম আর সায়মা শারমীন নিপা মিলে গড়ে তোলেন ‘এ কিউব লিমিটেড’ নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। পরবর্তীতে কায়ছার ও মামুন ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দেন। গুলশান নিকেতনে তারা খুব সুন্দর একটি অফিস সাজিয়েছেন। একই রুমে চার বন্ধু পাশাপাশি বসে অফিস করেন। ইতোমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি কমার্শিয়াল বিল্ডিং, রিসোর্ট, অফিস বিল্ডিংসহ অসংখ্য বিল্ডিংয়ের ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করেছেন। তাদের প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছেÑ উত্তরার এলিট পেইন্টস-এর হেড অফিস, নিকুঞ্জের সিঙ্গেল রেসিডেন্স বিল্ডিং সাকুর রেসিডেন্স, ফার্মগেটের কে এম টাওয়ার, চিটাগং-এর এ কে খান একটাচ পয়েন্টের ইন্টেরিয়র, বারিধারার ফোর স্টার হোটেল, সেগুন বাগিচার ন্যাশনাল হাউজিং অথারিটি ২১ তলা বিল্ডিং, চিটাগং-এর কাউয়ুম রেসিডেন্স বিল্ডিং, অল্টার আর্কিটেক্টস অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস এর সঙ্গে যৌথভাবে কাওরান বাজারের এশিয়ান টাইগার ক্যাপটালসহ অসংখ্য বিল্ডিংয়ের ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করেছেন। এছাড়া বর্তমানে বেশ কিছু নতুন প্রজেক্টের কাজ করছেন তারা। স্থাপনার কাজে এ কিউব লিমিটেডের রয়েছে সাফল্য। প্রতিযোগিতামূলক কাজে অংশ নিয়ে তারা পুরস্কৃত হয়েছেন।
২০১৭ সালে আইএবি-ন্যাশনাল হাউজিং অথারিটি কর্তৃক আয়োজিত আর্কিটেকচার ডিজাইন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করে।
স্থপতি এহ্সানুল আলম বলেন, এ কিউবের স্থাপত্য চর্চা নামটা আসলে এসেছে একটা বর্গ বা বীজগণিতের ‘ধ৩’ থেকে। স্থাপত্যে ত্রিমাত্রিক ক্ষেত্রে যে কোনো কিছুর শুরু হয় একটা কিউব থেকে। একটা বর্গ থেকে যার সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়। সবকিছুই একটু নতুন ভাবে শুরু করা। আমাদের জন্ম এবং বড় হওয়া তৃতীয় বিশ্বের একটা দেশে। স্থাপত্য পড়ার সময় থেকে আজ অব্দি আমাদেরকে সব উন্নত স্থাপত্য অনুধাবন করার চেষ্টা করতে হয়, তেমনি ভাবতে হয় কোথায় আমাদের জন্ম, আমাদের পারিপার্শ্বিক আর্থ সামাজিক অবস্থান এবং কার জন্য কোথায় স্থাপত্যটি বাস্তবায়িত হবে। এটা আমাদের মতো স্বল্প আয়ের দেশে কিছু ক্ষেত্রে নয় অনেক ক্ষেত্রেই অনেক প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ একটা কাজ। একদিকে মডার্নিজম বা আধুনিকায়ন আরেক দিকে আমাদের মতো একটা গরিব দেশ। এই দুইটা বিষয়কে সাদৃশ্য রেখেই চর্চা করাটাকে আমরা আমাদের মুখ্য বিষয় হিসেবে বিবেচনা করি। আমাদের কাছে ছোট হোক বা বড় হোক যে কোনো প্রকল্পকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে না নিয়ে নতুন কিছু করার সুযোগ হিসেবে চিন্তা করি। যেখানে সব সময়েই আমাদের চেষ্টা থাকে সমসাময়িক স্থাপত্য চর্চার মাধ্যমে পৃথিবীর কাছে বাংলাদেশকে অনেক উপরে নিয়ে যাওয়া এবং একই সাথে নতুন ধারা অববাহিত করা।
Shahcement-1ন্যাশনাল হাউজিং অথারিটিরা (জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ) হেড অফিস প্রকল্পটি সম্পর্কে তিনি বলেন, এটি একটি আধুনিক স্থাপত্য এবং ভাস্কর্যের সংমিশ্রণ। এতে রয়েছে ‘ওপেন টু স্কাই এট্রিয়াম’ যা কিনা কানেক্ট হচ্ছে ডায়াগনাল ব্রীজ দিয়ে। পুরো বিল্ডিংটা হলো ২১ তলা যা কিনা সাত তলা করে সর্বমোট তিনভাগে বিভক্ত। প্রতি সাত তলা বøক একে অপরের সাথে সমান্তরাল যা কিনা ‘ওপেন টু স্কাই এট্রিয়াম’ কে ঘিরে গড়ে উঠেছে। প্রতি সাত তলা বøক পরে রয়েছে বাগান, দালানটির ব্যবহারকারীকে মাটির স্পর্শ থেকে কোনো ভাবেই পুরে রাখবে না। বাগানে লাগানো হবে প্রচুর গাছ এবং বাগানগুলো এক ধরনের ব্রিফিং স্পেস হিসেবে ব্যবহৃত হবে। আমাদের আবহাওয়া, জলবায় এবং সংস্কৃতির সাথে মিলিয়ে করা। প্রতি তলা পরপর এই বাগানে বসে অনায়াশেই সুপ্রিম কোর্ট এবং পার্শ্ববর্তী নগরায়নের চমৎকার দৃশ্য দেখা যাবে। বিল্ডিংটিতে রয়েছে অফিস স্পেস, ১০০০ জনের মাল্টি পারপাস হল, ৫০০ জনের হল রুম, ১০০ জনের সেমিনার হল, নামাজ পড়ার জন্য স্থান, ডেকেয়ার সেন্টার, ক্যাফেটেরিয়া এবং অত্যাধুনিক স্থাপত্যের জন্য যাবতীয় প্রয়োজনীয় ফাংশন। প্রতিফ্লোরের উচ্চতা অন্যান্য সাধারণ বিল্ডিংয়ের চেয়ে অধিক রাখা হয়েছে যাতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ এবং অন্যান্য সার্ভিস সংস্থাপন করার পরও ব্যবহারকারীদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা তাকে। যে কেউই মূল সড়ক থেকে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট থেকে নির্দিষ্ট ড্রপ অফ পয়েন্টে নেমে বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করতে পারে অথবা ভেতরে অবস্থিত অভ্যন্তরীণ (পেরিফেরাল) সড়ক দিয়ে প্রবেশ করতে পারে। যে কোনো অফিস ব্যবহারকারীকে দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে অবস্থিত প্লাজা দিয়ে প্রবেশ করতে হবে যেখানে উপরে তাকালে উন্মুক্ত আকাশ দৃশ্যমান হবে এবং বেজমেন্টে যাওয়া কিংবা বৃষ্টির সময় উত্তর-পূর্বকোণে অবস্থানরত ড্রপঅফ দিয়ে নামতে হবে। যেহেতু পুরো অভ্যন্তরীণ রাস্তাটাই একটা লুপে অবস্থিত সেহেতু অগ্নিনির্বাপক গাড়ি অনায়াশেই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার সময়ে প্রবেশ এবং বের হতে পারবে। ন্যাশনাল হাউজিং অথারিটি আমাদের দেশের একটি অন্যতম পুরাতন এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এজন্যই একে একটি আধুনিক স্কাল্পচারাল আর্কিটেকচার রূপে ডিজাইন করা হয়েছে। যা কিনা বিল্ডিংকে এক ধরনের নতুন স্বরূপতা দেবে। ব্যবহারকারী এবং নগরবাসীকে অনুপ্রাণিত করবে।