Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

চাই বিশুদ্ধ পানি!

আগামী ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস। ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ সাধারণ সভা ২২ মার্চ তারিখটিকে বিশ্ব পানি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে জাতিসংঘ পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্মেলনের (ইউএনসিইডি) এজেন্ডা ২১-এ প্রথম বিশ্ব পানি দিবস পালনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবটি উত্থাপিত হয়। ১৯৯৩ সালে প্রথম বিশ্ব পানি দিবস পালিত হয় এবং তার পর থেকে এই দিবস পালনের গুরুত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে।

শরীরকে সুস্থ রাখার জন্যে প্রতি দিন পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করা অপরিহার্য। পানি ছাড়া জীবনের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের দাবি, প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি পান করলে বিভিন্ন রোগব্যাধি থেকে মানুষ মুক্ত থাকতে পারে। এক্ষেত্রে যুক্তি হচ্ছে, পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি থেকে মানুষের শরীর যেমন পায় প্রয়োজনীয় শক্তি, তেমনি ছাঁকন প্রক্রিয়ায় শরীর থেকে মূত্র হয়ে বেরিয়ে যায় নানা ক্ষতিকর পদার্থ। এতে শরীর থাকে সুস্থ’, অটুট থাকে শারীরিক সৌন্দর্য। শরীর থাকে সুগঠিত। যারা প্রতিদিন প্রয়োজনীয় বিশুদ্ধ পানি শরীরে গ্রহণ করে তারা সহজে বার্ধক্যে-আক্রান্ত হন না। যার কারণে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি পানের ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টির ওপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সংস্থা গুরুত্ব আরোপ করছে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, একজন সুস্থ মানুষের জন্যে দৈনিক কমপক্ষে ৩ লিটার বিশুদ্ধ পানি পান করা দরকার। অপর্যাপ্ত পানি পানের কারণে অসংখ্য রোগ হানা দেয় মানব শরীরে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে কিডনি রোগ। বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্টে দেখা গেছে প্রতিদিন দেহের জন্যে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি পান না করা বা অন্য কোনো অবহেলার কারণে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ কিডনির পাথর রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। একই কারণে বাড়ছে কিডনিজনিত রোগীর সংখ্যাও।

প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি পান বিষয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের এত সতর্ক বার্তা সত্তে¡ও তা বেশির ভাগ মানুষ আমলে নিচ্ছেন না। এর তিনটি প্রধান কারণ হচ্ছেÑ১. মানুষের নেতিবাচক অভ্যাস চর্চা; ২. স্বাস্থ্য বিষয়ে জনসচেতনতার অভাব ও ৩. বিশুদ্ধ পানির অভাব।

পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি

বিশুদ্ধ পানির অভাবে সম্প্রতি ভয়াবহ হারে বেড়ে গেছে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ। দূষিত পানি পানে নানা জটিল রোগের উৎপত্তি হতে পারে। হেপাটাইটিস, টাইফয়েড, ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, জন্ডিসের মতো মারাত্মক ব্যাধির উৎসে থাকে দূষিত পানি। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের অভিমত, এ রকম দূষিত পানি দীর্ঘদিন পান করতে থাকলে আরো জটিল রোগ, এমনকি মরণ ব্যাধি ক্যান্সারও হতে পারে। কিডনি রোগ, আলসার, রক্তচাপ, অ্যাজমা, য²া ইত্যাদি রোগের প্রকোপ বাড়তে পারে। এক্ষেত্রে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা দিতে না পারলে জনস্বাস্থ্যকে স¤পূর্ণভাবে হুমকিমুক্ত করা যাবে না। বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা বিধান করে বহুরোগ থেকে আত্মরক্ষা করা যায়।

পানিবাহিত রোগের মধ্যে ডায়রিয়া, আমাশয়, পোলিও, হেপাটাইটিস এ ও ই, টাইফয়েড, প্যারাটাইপয়েড ইত্যাদি অন্যতম। এটি দুই ধরনের, তরল ডায়রিয়া এবং আমাশয়। কলেরা মারাত্মক ধরনের ডায়রিয়ার একটি আদিরূপ; এটি ঠরনৎরড় পযড়ষবৎধব নামক জীবাণুর কারণে ঘটে থাকে। আর এক রকমের জীবাণু (ব্যাসিলাসসমূহ) যেমন শিগেলা, আমাশয় সংঘটিত করে থাকে। এটি এক ধরনের ডায়রিয়া যাকে সচরাচর ব্যাসিলারি ডিসেন্ট্রি বলা হয়ে থাকে। সালমোনেলা নামক একদল জীবাণু অন্ত্রে পানির সঙ্গে প্রবেশ করে সংক্রমণের প্রথম পর্যায়ে ডায়রিয়া না ঘটাতেও পারে, কিন্তু তাদের আসল রোগ প্রকাশ পায় এক রকমের জ্বর দিয়ে, যাকে বলে আন্ত্রিক জ্বর বা টাইফয়েড।

শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি জনসংখ্যা কৃষি ভূমিময় বাংলাদেশের গ্রামে বসবাস করে। গ্রামগুলোতে ভালো পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং নিরাপদ পানীয় জলের অভাব আছে। পানিবাহিত রোগের বিস্তার রোধে পরিশ্রæত পানির সরবরাহ একটি পূর্বশর্ত। পরিশ্রæত পানির ব্যবস্থা করে এবং মলের নিরাপদ নিষ্কাশনের মাধ্যমে এসব রোগ সীমিত রাখা যায়। পানিবাহিত রোগের উপর যথেষ্ট প্রভাব শুধু পরিশ্রæত পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করলেই হবে না, এর সঙ্গে সঙ্গে মল নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও খুবই জরুরি।

রাজধানী ঢাকায় দৈনিক পানির দরকার হয় ২২০ থেকে ২৩০ কোটি লিটার।

ঢাকার পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওয়াসা গড়ে দিনের চাহিদার পুরোটাই সরবরাহও করে। তবে নগরবাসীর দীর্ঘ দিনের অভিযোগ, ওয়াসার পানিতে মাত্রাতিরিক্ত দুর্গন্ধ ও ময়লা থাকে। দীর্ঘ সময় ধরে ফোটানো হলেও কিছু এলাকায় সরবরাহকৃত পানি থেকে দুর্গন্ধ যাচ্ছে না, তা পান যোগ্যও করা যাচ্ছে না। কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরবরাহকৃত পানির ১৫ শতাংশ আসে সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার থেকে। শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা থেকে পানি এনে শোধন করে তা নগরবাসীর জন্য সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এ দুই নদীর পানি এতটাই দূষিত যে তা শোধন করেও পানযোগ্য করা যাচ্ছে না। কারণ, নদী দূষণের কারণে নদীর অবস্থা বেশ নাজুক। এসব নদীতে এখনো পানি আছে বটে, কিন্তু সে পানি এতই দূষিত যে তা মানুষের পানের উপযোগী করার জন্য মূল শোধনাগারে নেয়ার আগে একটি প্রাক-শোধনাগারে নিয়ে একবার শোধন করতে হয়। অর্থাৎ এসব নদীর পানি এক দফায় শোধনযোগ্য নয়। দুটি পৃথক শোধনাগারে দুই দফায় শোধন করার পরেই কেবল তা মানুষের পানের উপযোগী হয়।

জেরি-ক্যান কোম্পানিগুলোর অসাধুতা

ঢাকার বেশির ভাগ এলাকায় পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান যে পানি সরবরাহ করে, তা সরাসরি পান করা তো চরম ঝুঁকিপূর্ণ, এমন কি ফুটিয়ে, ফিল্টার করেও গন্ধমুক্ত পানের উপযোগী করা যায় না। আর বিশুদ্ধ খাবার পানির এই সংকটের সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যক্তিরা রমরমা বাণিজ্য করছে। বিশুদ্ধ পানির নামে বোতল জাত পানি অথবা জেরি-ক্যানে বিক্রির ব্যবসা এখন রমরমা। কিন্তু রাজধানীসহ সারাদেশে নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকিরা জেরি-ক্যানে করে যে পানি বিক্রি করে তার বেশির ভাগই বিশুদ্ধ নয়।

ভ‚-গর্ভস্থ পানির স্তরের নিম্নগামিতা এবং পানিতে ভারি ধাতু এবং দূষিত পদার্থের প্রকট উপস্থিতি

পানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. এম আশরাফ আলী বলেন, ‘স্বাভাবিক নিয়মে ভ‚-গর্ভস্থ’ পানির যে স্তরটুকু খালি হয় তা পরবর্তী সময়ে প্রাকৃতিকভাবেই পূরণ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ঢাকাসহ আরো কিছু এলাকায় তা হচ্ছে না। ভ‚-গর্ভের পানি শুধু কমছেই, বাড়ছে না। আগে থেকেই অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে অতি মাত্রায় নলক‚প বসিয়ে ইচ্ছা মতো পানি তুলে ফেলায় অবস্থা এমন হয়েছে যে, এখন আর পানি আমাদের লাগলে পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার বিভিন্নভাবে চেষ্টা করলেও ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট দিয়ে পানি সঠিক মাত্রায় নিরাপদ করা যাচ্ছে না মারাত্মকভাবে নদী দূষণের ফলে।’

এছাড়াও বিভিন্ন দূষিত পদার্থের প্রকট উপস্থিতির কারণে গভীর নলক‚পের পানিও আর নিরাপদ নেই। এতে ঢুকে পড়েছে পানিবাহিত রোগের উপাদান ব্যাকটেরিয়া, সেটাও ভয়াবহ মাত্রায়। এছাড়াও এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথ পরিচালিত ওয়াটার কোয়ালিটি টেস্টিং ল্যাবরেটরির (ডবিøউকিউটিএল) এক গবেষণায় বাংলাদেশের অধিকাংশ নলক‚পের পানিতে ব্যাকটেরিয়া ছাড়াও ম্যাঙ্গানিজ নামের একটি ভারী ধাতুর উপস্থিতিও পাওয়া গেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ভারী এ ধাতুটি স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। গবেষকরা বলছেন, মাটির নিচে পানির স্তরে ভারী ধাতুর উপস্থিতির কারণে তা পানের অযোগ্য হয়ে পড়ছে।

পানি কি শুধু ফোটানোর মাধ্যমে বিশুদ্ধকরণ সম্ভব!

পানিতে মিশে থাকা বিষাক্ত কেমিক্যাল, ভারী ধাতু, মরিচা, সিসা, বিভিন্ন দূষিত পদার্থ ইত্যাদি শুধু ফোটানোর মাধ্যমে দূর করা যায় না। ব্যাকটেরিয়াসহ অন্যান্য ক্ষতিকর জীবাণু ধ্বংসের জন্য পানি সঠিক তাপমাত্রায় ৩০ থেকে ৪০ মিনিট ফোটাতে হয়। কিন্তু সঠিক তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট সময় ধরে পানি ফোটানোর বিষয়টি সবার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। তাই পানি ফোটালেও ঝুঁকি রয়েই যায়। তাই সবাইকে পানি বিশুদ্ধ করণের জন্য বিকল্প পথ বেছে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে তাই বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন, পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ পানির জন্য নির্ভর করা যেতে পারে উন্নতমানের পানি শোধন যন্ত্রের ওপর।

জাতিসংঘের ভাষ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি নয়জনের একজন বিশুদ্ধ ও পরিষ্কার পানির আওতায় নেই। প্রতি তিনজনে একজন সঠিক পয়ঃনিষ্কাশনের আওতার বাইরে। ফলে দেখা দিচ্ছে নানা রোগবালাই। কেবল বিশুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন পানি ব্যবহারের মাধ্যমে দুনিয়াজুড়ে পানিবাহিত রোগ এবং এ কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি ২১ শতাংশ কমানো যেতে পারে।

পানি বিশুদ্ধ করার সঠিক পদ্ধতি কোনটি, এ নিয়ে অনেকেরই আছে বিভ্রান্তি। পানি ফুটিয়ে নেয়া সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি। এতে জীবাণু, পরজীবী এমনকি তার ডিম ও লার্ভাসহ সবই ধ্বংস হয়। পানি ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কমপক্ষে ১০ মিনিট ধরে ফোটাতে হবে। তারপর তা ঠান্ডা করে কলসি, কাচের জগ বা পরিষ্কার পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। রেখে দেয়া ফোটানো পানিতে আবার জীবাণুর আক্রমণ হতে পারে- বিশেষ করে, যদি তা বেশি দিন রেখে দেয়া হয়। তাই রোজকার পানি রোজই ফুটিয়ে নেয়া ভালো। পানি ফোটালে জীবাণু ও পরজীবী ধ্বংস হয় বটে, তবে সব রাসায়নিক উপাদান নষ্ট হয় না। ফোটানো পানিতে কখনো কখনো ক্যালসিয়াম কার্বনেট জাতীয় তলানি পড়ে। এর সবগুলো যে খারাপ, তা নয়। তবে খনিজ উপাদানের কারণে পানি ঘোলাটে বা অপরিচ্ছন্ন দেখালে ছেঁকে নেয়া যেতে পারে। ফোটানো পানি আবার ফিল্টার করা প্রয়োজন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আসে। পানি ফোটানোর মাধ্যমেই ক্ষতিকর জীবাণু দূর করা সম্ভব, তবে সন্দেহ হলে ফিল্টার করা যায়। বেশির ভাগ ফিল্টার আসলে পানির স্বাদ ও গন্ধকেই উন্নত করে। আজকাল বাজারে উন্নতমানের পানি পিওরিফায়ার পাওয়া যায়। তা কিনেও পানি ফোটানোর মতোই বিশুদ্ধ পাওয়া সম্ভব। যা বর্তমানে বেশ জনপ্রিয় হওয়ার পাশাপাশি বিশ্বস্তও হয়েছে।