Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

চতুদর্শ জাতীয় শিশু কিশোর নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব ২০১৯

শিল্পকলায় জমেছিল শিশুদের মিলনমেলা!

মোহাম্মদ তারেক
শিল্পকলা একাডেমিতে চলছিল শিশুদের নাট্য উৎসব। ঘড়ির কাটা বেজে তখন ৩টা। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রাঙ্গণে ঢুকতেই চোখে পড়ল বিস্তৃর্ন মাঠের দিকে। মিষ্টি রোদে পাখির মতো ছুটাছুটি করছে অসংখ্য শিশু-কিশোর। আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে। একজন ভদ্র মহিলাকে রোদে বসে থাকতে দেখে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার মেয়ে কি কিছু করবে। তিনি বলেন, জ্বি ওর নাটক তো বিকেল ৫টায়। আসুন ভেতরে এসে বসুন, বাইরে প্রচন্ড রোদ। জাতীয় সঙ্গীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্রের ভেতরে বসে কথা হলো ভদ্র মহিলা ও শিশুটির সঙ্গে। ওর নাম মালিহা তাবাসসুম, তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। মা রেহেনা আক্তার একজন শিক্ষিকা। তারা এসেছেন মাগুরা থেকে আগের দিন রাতে। সারারাত মাকে ঘুমাতে দেয়নি।
প্রিয় পাঠক, মালিহা তাবাসসুমের মতো শিশুদের অভিনয়ের প্রতি যে ভালোবাসা এটা পুরো বাংলাদেশে চতুর্দশ জাতীয় শিশু-কিশোর নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব ২০১৯ এর খন্ড চিত্র।
ইতিমধ্যে পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের জাতীয় শিশু-কিশোর নাট্য উৎসব বাংলাদেশের শিশুদের নাটকের জন্য সবচেয়ে বড় প্লাটফর্ম হিসেবে বেশ পরিচিত। এই প্লাটফর্মে এসে শিশু-কিশোররা যেন সবাই রাজা। আমরা সবাই রাজা আমাদেরই রাজার রাজত্বে। শিশু-কিশোরদের পদচারনায় শিল্পকলা একাডেমির কটা দিন যেন শিশুদের রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শিল্পকলা একাডেমির প্রাঙ্গণ পুরোটা দখল করে নিয়েছিল শিশুরা। নেবেই না কেন? শিশুদের অনুষ্ঠান বলে কথা। একাডেমির যে দিকে চোখ গেছে সে দিকেই শিশুদের ছড়াছড়ি। বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও শিশুদের ঘিরে এ রকমের সুন্দর, হৃদয় ছোঁয়া দৃশ্য বোধ করি ফোটেনা।
অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগেই একাডেমির মাঠে একদল শিশু-কিশোরদের আড্ডা দিতে দেখা গেল। তারা এসেছিল চতুর্দশ জাতীয় শিশু-কিশোর নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসবে। তবে এমন দিনে এখানে না এলেই নয়। তাইতো অপেক্ষা প্রহর গুনছে। কখন শিশুদের নাটক দেখবে তারা। আবার কেউ কেউ বাবা-মায়ের হাত ধরে এসেছিল শিল্পকলা একাডেমির প্রাঙ্গণে। বিকেল হতে না হতেই একাডেমির প্রাঙ্গণ উৎসব মুখর হয়ে উঠে শিশুদের কলকাকলিতে। মায়ের সঙ্গে উৎসবে নাটক দেখতে এসেছিল উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ইয়াসমিন আক্তার শিল্পী। সে বলল, আমাদের বাসা মগবাজারের কাজীর গলিতে। প্রায়ই আসি শিল্পকলা একাডেমিতে। সব সময় দেখি বড়দের অনুষ্ঠান। কিন্তু ছোটদের কোনো অনুষ্ঠান থাকে না। এবার ছোটদের বিশাল অনুষ্ঠান দেখে আমার ভালো লেগেছে। উৎসবের পর আমাদের জন্য শুক্র-শনিবারও যদি নাটকের অনুষ্ঠান থাকে তাহলে খুবই ভালো হতো।
সারাদেশ থেকে আগত শিশু-কিশোর শিল্পীরা পরিবেশন করেছিল নাটক, একক অভিনয়, স্কুল থিয়েটার, সঙ্গীত, নৃত্য, আবৃত্তি এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ। আয়োজকরা উৎসবে আগত শিশুদের সনদপত্র ও মঞ্চকুড়ি পদক প্রদান করেন এবং শিশুদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন। দর্শকদের জন্য ছিল অ্যাক্রোবেটিক প্রদর্শনী, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, চলচ্চিত্র কমশালা, নাট্যকর্মশালা, পাপেট থিয়েটার, এতিহ্যবাহী পুতুল নাট্য, পাপেট নির্মাণ কর্মশালা, যাদু প্রদর্শনী, বঙ্গবন্ধু পুস্প কানন নির্মাণ, মঞ্চ কুড়ি পদক, তনয় শিশু নাট্য পদক, শিশু আনন্দ মেলা এবং বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের পরিবেশনা।
২৮ সেপ্টেম্বর। বৃষ্টিতে ভিজে একাকার রাজধানী। ভিজে গেছে শিল্পকলা একাডেমির সবুজ ঘাসের চত্বর। তারপরও বৃষ্টি উপেক্ষা করে উৎসব মুখর পরিবেশে শেষ হলো বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও পিপলস থিয়েটার এসোসিয়েশন এর যৌথ আয়োজনে আট দিন ব্যাপী চতুর্দশ জাতীয় শিশু-কিশোর নাট্য ও সাংস্কৃতিক উৎসব ২০১৯। শিশুদের অংশগ্রহণে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ছিল এ আয়োজনটি। যেখানে দেশের ৬৪ জেলার সংস্কৃতিক দল এবং ৯৬টি শিশু নাট্য নাট্য সংগঠনের দশ হাজারেরও বেশি শিশু এসেছিল। আনন্দময় এই উৎসবে তারা নিয়ে এসেছিল ৯৬টি নাটক।
জাতীয় চিত্র শালার চিত্রকলা স্টুডিওতে দুপুর ২টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত রং তুলি দিয়ে নানা রঙে শিশু-কিশোররা ছবি এঁকেছে প্রতিদিন। জাতীয় সঙ্গীত ও নৃত্যকলা প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গিত পুস্পকানন নির্মাণ করা হয়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার পরীক্ষণ থিয়েটার হল, জাতীয় সঙ্গীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্র মিলনায়তন, স্টুডিও থিয়েটার হল, জাতীয় চিত্রশালা সহ আটটি ভেন্যুতে প্রতিদিন অনুষ্ঠিত হয় ৮৫টি পরিবেশনা। মিলনায়তন ভবনের ভিতরে করিডোরে, বাইরে খোলা প্রাঙ্গণে ছিল দারুন সাজসজ্জা। সন্ধ্যা হতে না হতেই বর্ণিল আলোয় ঝলমল হয়ে উঠেছিল চিত্রশালার প্রাঙ্গণ। সব মিলিয়ে মহোৎসবে পরিণত হয়েছিল একাডেমি প্রাঙ্গণ। প্লিজ… দাদা, একটু দেখবেন আমাদের দলের নাটক কোন হলে পড়েছে। কয়টায় শো শুরু হবে। জাতীয় চিত্রশালার নীচে তথ্য কেন্দ্রে জানতে চাইল ঢাকার বাইরে থেকে আসা খাগড়াছড়ির জেলা শিল্পকলা একাডেমি শিশু নাট্য দলের প্রতিনিধি।

তথ্য কেন্দ্রে বসে থাকা শাহ্ আলম রঞ্জু ল্যাপটপে সূচি দেখে জানিয়ে দিলেন সঠিক সময়। তথ্য ও দপ্তরের আরেক জনের কথা না বললেই নয়। তিনি হলেন আব্দুল্লাহ বিপ্লব। অনুষ্ঠানের খবরাখবর নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত ছিলেন এই দুজন মানুষ। তথ্য কেন্দ্রটি বেশ জাক জমকপূর্ণ ছিল। এখান থেকে বিভিন্ন মিলনায়তনে অংশগ্রহণকারী শিল্পী ও অতিথিদের জন্য শুভেচ্ছা ও সম্মাননা স্মারক চলে যাচ্ছে। নিবন্ধন ও উপহার সামগ্রী দেওয়ার কাজটিও এখান থেকেই হতো। শিল্পকলার নয়টি মহড়া কক্ষও ছিল প্রাণ চঞ্চল। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা শিশু-কিশোররা সেখানে পর্যায়ক্রমে বিশ্রামের সুযোগ পায়। পাশাপাশি প্র্যাকটিস করে নেয় তাদের পারফরমেন্স।
বৃষ্টিতে ভিজে, প্রচন্ড গরমে প্রতিদিন রোভার স্কাউটের ২০ জন তরুণ করেছে উৎসব প্রাঙ্গণে । শিশুশিল্পী ও দর্শনার্থীদের প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দিতে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির একটি দল কাজ করে। ঠাকুরগাঁও এর নিশ্চিন্তপুর থিয়েটারের একজন সদস্যের অভিভাবক মমতাজ উদ্দিন বলেন, এখানে শুধু নাচ, গান, অভিনয় কিংবা ছবি আঁকা নয় এই উৎসবে শিশু-কিশোররা একটা প্লাটফর্ম পেয়েছে, যেখানে তারা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারছে। একজন আরেকজনের কাজ দেখছে। নিজেকে আগামীর জন্য প্রস্তুত করছে।
উৎসবের আয়োজক পিপলস থিয়েটার এসোসিয়েশনের প্রাতিষ্ঠাতা ও শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী বলেন, দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশ শিশু। শিশুদের বাদ দিয়ে শিল্পকলা একাডেমির কোনো কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারে না। শিশুদের নিয়ে বড় সড় আয়োজন ছাড়া শিল্পের বিকাশ সম্ভব নয়। আমরা শিশু বান্ধব সমাজ নির্মাণ করতে চাই।