Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

গিটারই আমার সত্যিকারের প্রেমিকা!-আইয়ুব বাচ্চু

আইয়ুব বাচ্চু তাঁর ভক্তদের কাঁদিয়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। জীবদ্দশায় তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের সাথে বলেছেন নিজের ভালোলাগা-ভালোবাসা আর ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে নানান কথা। সেগুলো কখনো পত্রিকার পাতাজুড়ে পাঠকের সামনে উঠে এসেছে আবার কখনো টিভি চ্যানেলে তাঁর ভক্তদের জন্য সম্প্রচারও হয়েছে। বিশিষ্ট সাংবাদিক সামিয়া রহমান এর উপস্থাপনায় নিউজ টুয়েন্টিফোর চ্যানেলে আইয়ুব বাচ্চুর একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার প্রচার হয়েছিল। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ শিরোনামের সেই অনুষ্ঠানটিতে আইয়ুব বাচ্চু তাঁর ব্যক্তি জীবনের নানান কথা বলেছেন। নিজের আক্ষেপ, পাওয়া-না পাওয়া কিংবা চাওয়া-পাওয়ার হিসাবের কথাও বলেছেন অকপটে। আনন্দ আলো’র পাঠকদের জন্য সেই সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো। লিখেছেন সৈয়দ ইকবাল।

সামিয়া রহমান: আপনার বাচ্চারা কার ভক্ত বেশি, বাবা-নাকি মায়ের?
আইয়ুব বাচ্চু: আমি ছোটবেলা থেকেই আমার বাচ্চাদের অর্ডার করেছি যেনো তারা মায়ের ভক্ত বেশি হয়। কারন একজন মা-ই জানেন দশ মাস দশদিন একজন সন্তানের জন্য তার কী কষ্ট হয়েছিল। তাই সন্তানেরা মায়ের ভক্ত হলে মায়ের মনে অনেক বেশি সুখ কাজ করে। আমি এটা কেনো জানি খুব অনুভব করি।
সামিয়া রহমান: ১৯৭৮ সালে গানের জগতে প্রবেশ করেন। তার আগের আইয়ুব বাচ্চু কেমন ছিল?
আইয়ুব বাচ্চু: আমি যখন বুঝতে পারলাম একটা বনেদী পরিবারে আমার জন্ম হয়ে গেছে তখনও আমার ভেতর কেনো জানি সেই বনেদীপনাটা আমাকে ছুঁতে পারেনি। এটার নানা কারন ছিল। সেইদিকে না যাই। এই বনেদীপনা আমাকে ছুঁতে না পারার ফলে আমি কেমন জানি একটা কোণঠাঁসা হয়ে যাই। তখন জীবন একটা অদ্ভুত প্র্যাকটিসের মধ্যে দিয়ে যেতে থাকলো। তখন আমার মনে হতে থাকলো আমাকে কিছু করতে হবে। আমাকে অনেক বড় হতে হবে এবং আমার এই সংসারটাকে কাঁধে নিতে হবে। সেই সংসারটাকে কাঁধে নিয়ে আজকের এই অবস্থায় চলে এসেছি।
সামিয়া রহমান: মিউজিকটাকে প্যাশনের চাইতে পেশা হিসেবেই বেশি বলে থাকেন…
আইয়ুব বাচ্চু: সত্যি কথা। এটা আমি এখনো বলছি। সঙ্গীত আমার ভালোলাগার চাইতেও পেশাটাই বেশি। আমি এটাকে পেশা হিসেবেই দেখি। এক সময় এটা আমার নেশা ছিল। সেই নেশা থেকে এটা এখন আমার পেশা।
সামিয়া রহমান: আপনি কী এটা করতে বাধ্য হয়েছেন?
আইয়ুব বাচ্চু: একদম সত্যি কথা বলেছেন আপনি। আমি স্ট্রাগল করতে করতে এটা আমাকে পেশার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই তা হলো- যে সময়ে আমি বা আমরা যে কয়জন শুরু করেছিলাম সেই সময়ে মিউজিক করে, রক ব্যান্ড করে কিংবা গিটার বাজিয়ে সংসার চালানোর কথা চিন্তাই করা যেত না। এমনকি সেই সময়ে শুধু এই মিউজিক করে খাওয়া-পরা যাবে সেটা তখন অনেকেই চিন্তা করে নাই।
সামিয়া রহমান: আপনি কখন থেকে এই নেশাকে পেশা বানালেন? আর এই নেশাটাই বা তৈরি হলো কিভাবে?
আইয়ুব বাচ্চু: এজন্য শ্রদ্ধেয় আজম খানের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আজম খানের সাথে একজন গিটারিস্ট বাজাতেন নয়ন মুন্সি। আজম খান লম্বা চুলে গাইতেন আর সেই নয়ন মুন্সি এতো সুন্দর করে বাজাতেন যা আমাকে মুগ্ধ করত। তখন আমার মনের মধ্যে একটাই চিন্তা কাজ করতো- জীবনে আমার আর কিছুই করার নেই, আমাকে শুধু গিটার বাজাতে হবে। এটা একদম যখন থেকে দেখেছিলাম, তখনই চিন্তায় চলে আসে। আমার বাবা আমাকে কখনোই এগুলোতে সায় দিতেন না। পরিবারের মধ্যে শুধু আমি একটা ছেলে এই লাইনে এসেছি। পরিবারের কেউ ব্যবসায়ি, কেউ চাকরিজীবি আবার কেউবা বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। তাই আমার বাবা আমাকে নানান সময়ে গান বাজনা করা নিয়ে নানান ধরনের কথা বলতেন। একটা সময় আমি এই গিটার সঙ্গে নিয়ে সংসার ত্যাগী হয়ে গেলাম। কখন যেনো মনে হলো আমি তো সবার থেকে অনেক দূরে চলে গেছি। আমার সঙ্গী শুধু এই গিটার। গিটার বাজাতে বাজাতে আমি কোথা থেকে কোথায় চলে যেতাম সেটার কোন ইয়ত্তা নেই। দিন আর রাত কখন যে কোথায় কেটেছে আমার খবর ছিল না। কতোদিন বাড়ি ফিরিনি আমি।
সামিয়া রহমান: আপনি যখন বোহেমিয়াম লাইফ শুরু করেছিলেন এই গিটার নিয়ে, পরিবার কী সাপোর্ট করেছিল?
আইয়ুব বাচ্চু: মোটেও না। আমার মায়ের বিশ্বাস ছিল ছেলে গোল্লায় গেছে। আমি ঐভাবে শেষ হয়ে যাবো বলে মায়ের বিশ্বাস ছিল। আর বাবা একদম শুরুতেই একটা কথা বলে দিয়েছে- ‘তুমি তো শেষ’। বাবা বলতেন- গানবাজনা করে আমি টিকতে পারবো না।
সামিয়া রহমান: তখন কী এই গিটার বাজিয়ে ইনকাম করেছিলেন?
আইয়ুব বাচ্চু: আমার জীবনের প্রথম ইনকাম ৩০ টাকা। তখন আমি চট্টগ্রামে একটা ব্যান্ডের সাথে গিটার বাজিয়ে সেই ৩০ টাকা পেয়েছিলাম। এক টাকার নোট ছিল সবগুলো। সেই ৩০ টাকা পেয়ে কি যে আনন্দ তা আমার এখনো মনে পড়ে। ভুল করেছি, সেই টাকা গুলো আমার রেখে দেয়া উচিত ছিল।
সামিয়া রহমান: শুরুর দিকে মিউজিক করা কিভাবে?
আইয়ুব বাচ্চু: রুমি ভাই আমাকে সবসময় গাইড করতেন। এমনও হয়েছে তিনি আমাকে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একটা রুমের মধ্যে আটকে রাখতেন। আমাকে কিছু ইংলিশ গান দিয়ে বলতেন এগুলো গিটারে বাজাতে। আমি তাই করতাম। উনি আসলে আমাকে গিটার বাজানো শিখিয়েছেন। গিটারিস্ট বানিয়েছেন। আমার তখনো কোথাও কোনো ব্যান্ডের সাথে ঢোকা হয়নি। একদিন তিনি আমাকে বললেন অনেকগুলো গান বাজাতে এবং আমি সেটাই করলাম। তখন তিনি বললেন- আমি রেডি এবার। তারপর তিনি আমাকে ফিলিংস এ যোগ দিতে বললেন। বিশ্বজিৎ (কুমার বিশ্বজিৎ) আমার বন্ধুও ছিল ঐ ব্যান্ডে। তখন ও আমাকে নানানভাবে উৎসাহ দিয়েছিল। সবমিলিয়ে যোগ দিলাম সেখানে। ১৯৭৮ সালে ফিলিংস এ যোগ দিয়ে আমি সেখান থেকে ১৯৮০ সালে চলে আসি।
সামিয়া রহমান: এটারও নিশ্চয়ই কোনো কারন আছে?
আইয়ুব বাচ্চু: হঠাৎ করে রুমি ভাই একদিন এসে বললো ব্যান্ডটা ভেঙে দিবেন। উনি কিন্তু ফিলিংস এ থাকার সময়ও সোলসে ছিলেন। যাই হোক রুমি ভাই কোনো একটা অভিমানে এসে বললেন- আমরা কিছুই করতে পারবো না এবং সবাইকে জানিয়ে দিলেন ফিলিংস ভেঙে দিবেন। ভেঙে গেল ফিলিংস। উনার অভিমানের কারনটা কি ছিল সেটা আমার জানা ছিল না। তারপর আমি সোলস এ আমন্ত্রণ পাই। নওয়াজ ভাই, শাহেদ ভাই, নকিব ভাই, তপন দা সহ সকলেই আমাকে সোলস-এ যোগ দিতে বলে। আমার তখন মন খুব খারাপ হয়ে যায় ফিলিংস ভেঙে যাওয়ার কারনে। ওদিকে বিশ্ব (কুমার বিশ্বজিৎ) ঢাকায় চলে যায়। একদিন গুরু রুমি ভাই আমাকে ডেকে বললেন সোলস- এ যোগ দিতে। তখন সোলস মানে আমরা অজ্ঞান। কতো জনপ্রিয়তা। এরপর আমি যোগ দেই সোলস-এ। আমার লাইফে অনেক বড় সুযোগ হয় সোলস- এ যোগ দেয়াটা।
সামিয়া রহমান: আপনাদের মধ্যে সেই সময়ে অনেক বেশি প্রতিযোগিতা ছিল…
আইয়ুব বাচ্চু: সত্যি কথা। তখন কে কার চাইতে বেশি ভালো বাজাবে সেটাই বেশি প্রতিযোগিতা হত। বিষয়টা এমন ছিল না যে আরেকজনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবো। আসলে বিষয়টা ছিল কে কতো ভালো কিছু ক্রিয়েট করতে পারবে সেটাই ছিল মূল প্রতিযোগিতা। এতে করে কিন্তু আমাদের দারুণ দারুণ সব গান-মিউজিক তৈরি হয়েছিল। আমাদের মধ্যে দারুণ আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল। একটা দূর্দান্ত টিমওয়ার্ক ছিল।
সামিয়া রহমান: সবই যখন ভালো ছিল, তাহলে সোলসও একটা সময়ে আপনি ছেড়ে দেন কেনো?
আইয়ুব বাচ্চু: থ্যাটস দ্য পয়েন্ট। নিজের কিছু পছন্দের বিষয় ছিল। একান্তই নিজের কিছু ভালোলাগা এবং ভালোবাসার বিষয় ছিল। আমার একটা সময় মনে হলো নিজের তো কিছু একটা করা দরকার। আমার নিজস্ব কিছু স্টাইল এবং নিজের কিছু সিগনিফিকেন্ট কাজ করতে হবে। আমি ব্যক্তি আইয়ুব বাচ্চু হবো। তখন আসলে এই চিন্তায় ইমোশন কাজ করেনি, পুরো ব্রেনটাই কাজ করে। এসব ভেবেই ছেড়ে দিয়েছিলাম সোলসও।
সামিয়া রহমান: তপন দা এই বিষয়ে বলেছিল- নুতন নতুন কেউ কেউ ঢুকে যাওয়া এবং উনি সময় না দেয়ার জন্যই আসলে সোলসটা তখন ভেঙে গিয়েছিল…
আইয়ুব বাচ্চু: উনার এই কথার সাথে আমি একমত পোষণ করি না। নতুনদের তো আসতে দিতেই হবে। যেমন নকিব ভাইয়ের রিপ্লেসমেন্টে তো কাউকে না কাউকে তো বাজাতেই হবে। আমি সোলস- এ পার্থকে নিয়ে আসি। আমার ডিরেক্ট স্টুডেন্ট পার্থ। এটা ও সব জায়গায় বলেও। যাইহোক। কথা হচ্ছে পুরনোরা থাকবে নতুনদেরও তৈরি হতে হবে। বড়দের হয়তো নতুনদের অনেক সময় বোঝার বেলায় ভুল বুঝাবুঝি হতে পারে। তবে আমরা এখনো তপনদাকে ভালোবাসি এবং সম্মান করি। আমরা হয়তো একেকজন একেক জায়গা চলে গেছি। তবে উনার প্রতি সম্মান এখনো অনেক। দ্বিতীয়ত, কথা হচ্ছে উনি ঐ সময় প্র্যাকটিস এ থাকতে পারতেন না। কারন উনি ঢাকায় ব্যস্ত অনেক। ফিল্মে গান গাইছেন, অ্যালবাম করছেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই তিনি সময় দিতে পারতেন না। আমরা নতুন গান করলে সেটাও উনার প্রক্সি অন্য কেউ দিত। একটা সময় তো এমন হয়ে গেছে যে, আমরা উনাকে একদিন প্র্যাকটিস এ পেলে নিজেদের অনেক ধন্য মনে করতাম। সব মিলিয়ে আসলে উনি ছেড়ে দেন সোলস। এটা উনার সিদ্ধান্ত ছিল।
সামিয়া রহমান: আপনি তাহলে কেন সোলস ছেড়েছিলেন?
আইয়ুব বাচ্চু: এটা একেবারেই সিম্পল। আমি যখন দেখেছি যে আমার মতো পাগলামি কেউ করবে না, কারন আমি প্র্যাকটিস খুব পছন্দ করি। এমনকি প্র্যাকটিসের কথা বলালে আমার উপর কেউ কেউ মাইন্ডও করতেন। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম সোলস ছেড়ে দেয়ার। কারন আমি সবসময় নিজের মতো করে নিজে কিছু করার চিন্তা করেছিলাম। যেই মিউজিকের জন্য আমি ঘর ছেড়েছি, সেই মিউজিকটাই আমি ঠিকঠাক মতো করতে চাই সারাজীবন। এবং আমি সেটাই করে যাচ্ছি এখন পর্যন্ত। যেটা আমি এলআরবি এর সাথে থেকে করতে পারছি।
সামিয়া রহমান: আপনি এতো জনপ্রিয় অথচ আপনার কোন দুর্নাম নেই…
AB-(26)আইয়ুব বাচ্চু: চাঁদেরও কলষ্ক আছে। আমার দুর্নাম নেই এটা আমি বলতে চাই না। আরেক জনের দুর্নাম করলেই নিজের দুর্নাম হয়। তাই কারো দুর্নাম না করাই ভালো।
সামিয়া রহমান: আপনার অনেক মেয়ে ভক্ত আছেন, অনেক ছেলে ভক্ত আছেন। আপনি কাদেরকে বেশি ভালোবাসেন?
আইয়ুব বাচ্চু: (হাসতে হাসতে) আমি মেয়ে ভক্তদের বেশি ভালোবাসি। তবে ছেলে ভক্তদের আরো বেশি ভালোবাসি। আমি তাদেরকে এতো বেশি ভালোবাসি যেনো তারা সবসময় ভালো থাকে। তারা ভালো থাকলেই এই বাংলাদেশটা ভালো থাকবে। আর বাংলাদেশ ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকবো।
সামিয়া রহমান: মেয়ে ভক্তের কাছ থেকে তো আপনি প্রচুর ভালোবাসা পেয়েছেন…
আইয়ুব বাচ্চু: এখানে বিষয়টা ক্লিয়ার করি। যে ভক্ত সে শুধু ভক্তই থাকবে। তার ভালোবাসাটার প্রকার আর রকম থাকবে শুধু ভক্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আমিও ভক্ত, হিসেবে তাকে অনেক স্নেহ করবো অনেক ভালোবাসবো। কিন্তু সেই ভালোবাসার রকম কিন্তু আবার তথাকথিত প্রেমের সাথে মিলবে না।
সামিয়া রহমান: আপনার ব্যক্তিগত ভালোবাসার কথা একটু বলবেন-
আইয়ুব বাচ্চু: ভালোবাসার অভিজ্ঞতা আমার খুব একটা ভালো না। আমার কাছে ভালোবাসাটা হচ্ছে- ইচ্ছে করে কষ্ট পাওয়া।
সামিয়া রহমান: আপনি কী তাহলে ভালোবেসে কষ্ট পেয়েছেন?
আইয়ুব বাচ্চু: এটা তো বলবো না। সব কথা তো বলতে নেই। কেউ যদি ভালো বাসতে চায় প্রাণখুলে, তাকে ধরেই নিতে হবে কষ্ট পেতেই হবে।
সামিয়া রহমান: আপনি বললেন আপনার জীবনে ভালোবাসাটা এসেছে কষ্ট হয়ে- সেটা কী আপনার দোষে নাকি অন্যের দোষে?
আইয়ুব বাচ্চু: সেটা অবশ্যই আমার দোষে। ভালো যে বাসবে তাকেই কষ্ট পেতেই হবে। বিশ্বাস যে করবে তাকেই সবসময় কষ্ট পেতে হবে। যে ভালোবাসেনি তার তো কোনো কষ্ট নেই।
সামিয়া রহমান: আপনি নাকি একবার আপনার স্ত্রীকে বলেছিলেন বাচ্চা-কাচ্চা বড় হয়ে গেছে আাপনাকে যেনো এখন ছেড়ে দেয়?
আইয়ুব বাচ্চু: হ্যাঁ। এটা আমি এখনো বলি। যেহেতু সবাই এখন সবার মতো থাকতে পারে এবং আমার দায়িত্ব শেষ তাই আমাকে ছেড়ে দাও। পাখির মতো উঁড়তে দাও। আমি পালিয়ে যেতে যাই। কোথায় যাবো সেটা নিজেও জানি না। তবে এই জীবন সংসার থেকে পালাতে চাই। আমি একজন পিতা, স্বামী যাই বলা হোক না কেনো- এক জীবনে আমি এতো এতো দায়িত্ব পালন করেছি যে, এখন আর করতে ভালো লাগছে না। তাই বোহেমিয়াম হতে চাই…।
সামিয়া রহমান: ক্লান্ত হয়ে গেছেন?
আইয়ুব বাচ্চু: অনেকটা তাই। পালিয়ে যেতে চাই। আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয় কেনো পালাতে চাই, এক্ষেত্রে আমি বলবো- হলো তো। অনেক তো করলাম। সবাই এখন সবার মতো করে প্রতিষ্ঠিত। তাই আমি এখন আমার মতো থাকতে চাই। আমার শুধু মিউজিকটাই ভালো লাগছে, আর কিছুই ভালো লাগে না। আমার গিটারই আমার সত্যিকারের প্রেমিকা। কেউ যদি আমার কাছে জানতে চায়- এক জীবনে আমি কাকে বেশি সবচেয়ে ভালোবাসি, তাহলে আমি বলবো- আমার সবগুলো গিটারকেই আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। ওরা আমাকে কোথাও যেতে দিতে চায় না। তাই আমি ওদের নিয়ে ওদেরই জন্য বোহেমিয়াম হতে চাই। আর আমার যাওয়াটা এখন ওদিকেই।
সামিয়া রহমান: গোপন কোনো দু:খ কী কাজ করছে আপনার মধ্যে?
আইয়ুব বাচ্চু: সেটা জানি না। তবে আমি সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে চেয়েছি। একান্নবর্তী পরিবার বলতে যেটা বোঝায় সেটা করতে চেয়েছিলাম। পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে থাকবো, আনন্দ করবো, সবার দু:খ শেয়ার করবো ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি আমার ছোটবেলায় এরকম পরিবার দেখে বড় হয়েছি। তাই আমার ভাই-বোন আর নিজের পরিবারটাকেও সেই জায়গায় দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা হলো না। এই কষ্টটা আমার বুকের মধ্যে থাকবে সারাজীবন। আমার মনে হয়েছে- এটা এই সময়ে একটা অযৌক্তিক দাবি খাটাচ্ছি সবার উপর। এটা অনেকটা সেকালে হয়ে গেছে। এখন হচ্ছে- পাশের বাসায় কে আছে এটা কেউ জানে না। এটাই হচ্ছে আধুনিকতা।
সামিয়া রহমান: না আপনার এভাবে পালিয়ে যাওয়া চলবে না। কারন আপনার অনেক দায়িত্ব আছে। গান পাইরেসি থেকে শুরু করে অনেক বিষয়ে আপনার কাজ করার আছে…।
আইয়ুব বাচ্চু: খুব ভালো একটা বিষয়ে নিয়ে কথা উঠিয়েছেন আপনি। আমাদের এখানে ক্রিকেট খেলা টিকেট দেখতে রাজি আছে, এমনকি আমাদের কনসার্টও কিন্তু টিকেট কেটে গান পাগল মানুষ যায়। কিন্তু সিডি-ডিভিডি এখন ডিজিটাল মাধ্যম হয়ে আরো বেশি পাইরেটেড হচ্ছে। এটা আসলে যাদের দেখা উচিত তারা কিন্তু দেখছেন না। পুরো বিষয়টা একটা সিস্টেমের মধ্যে আনতে হবে। যেনো সবাই গানটা ফ্রি শুনতে পারলেই ভালো লাগে। অনেকের মনোভাব দেখে মনে হয়- শিল্পীদের খেতে হয় না, তাদের সংসার নেই। তাদের বাসা ভাড়া দিয়ে থাকতেও হয় না।
সামিয়া রহমান: এই জাতি কী তাহলে শিল্পীদের সম্মান করতে জানে না?
আইয়ুব বাচ্চু: দেখিনি তো কাউকে সম্মানিত হতে। স্যার সৈয়দ আব্দুল হাদীকে সম্মানিত হতে দেখিনি, গুরু আজম খান, লাকী ভাই, হ্যাপি ভাইকেও সম্মানিত হতে দেখিনি। আমার মনে হয় শিল্পীরা গান গাচ্ছে এবং সেই গান কেউ দয়া করে শুনছেন- এটাই বেশি। এখানে সম্মানের কোন দরকার নেই! একটা বিষয় সবার মনে রাখা উচিত- একজন শিল্পীর কিন্তু পাকস্থলি আছে, তার সামাজিকতা আছে, তারও আট দশনের মতো চলতে ফিরতে হয়। এই বিষয়গুলো মাথায় রাখলেই একজন শিল্পীকে মূল্যায়ন করা হবে এবং তাহলেই সে সমাজে সম্মানিত হবে।
সামিয়া রহমান: আমাদের এখানে অনেক রিয়েলিটি শো সহ নানানভাবে অনেক শিল্পী আসে, তারা হারিয়েও যায়। এই বিষয়ে কি বলবেন-
আইয়ুব বাচ্চু: এরকম আয়োজনের মাধ্যমে আমরা অনেক ভালো ভালো শিল্পী পেয়েছি এবং পাচ্ছি। তারা অনেক ভালোও গায়। কিন্তু তারা যেনো একটা সময় কোথায় হারিয়ে যায়। তারা হঠাৎ করেই অনেক টাকা পয়সা পেয়ে যায়, গাড়ি পায়, বাড়ি পায়, খ্যাতিও পায়। কিন্তু তারা হারিয়েও যায়। আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলি- চলেই যদি যাবেন তাহলে এলেন কেনো! এটা আমার কাছে মনে হয় প্রত্যাশার চাইতে বেশি পেয়ে যায় বলেই তারা সেটা ধারণ করার ক্ষমতটা হারিয়ে ফেলে। ফলে মিস ইউজও হয়। তবে তারা সত্যিকার অর্থেই ভালো গায় এবং তারা মিউজিকটা যেনে-শুনে এবং বুঝেই এসেছে। আমি কয়েকটি শো এর বিচারক থেকেই তাদেরকে বিচার করে দেখেছি। তারা সত্যিই ভালো গায়। এমন অনেকেই আছেন যাদের সম্ভাবনাটা অনেক। আমি তাদের উদ্দেশ্যে একটা কথাই বলবো- যদি এসেই যাও এবং একটা জায়গা পেয়ে যাও- তাহলে প্লিজ যেও না।
সামিয়া রহমান: আপনি গিটারকে ভালোবেসে একসময় ঘর ছেড়েছিলেন। সঙ্গীতকে বেছে নিয়েছেন জীবনের সঙ্গী হিসেবে। কিন্তু আপনি চান না আপনার ছেলেও এই লাইনে হাটুক…
আইয়ুব বাচ্চু: এটা একদম সত্যি কথা। আমি আসলে খুব কাছ থেকে দেখেছি এই লাইনে কষ্ট এবং স্ট্রাগলটা কেমন। আমাদের সময়ের প্রেক্ষাপটটা ছিল অন্যরকম। আমার বাবা আমাকে বলেছিল- বাউলের জীবন মানে অনেক কষ্টের জীবন। এই বয়সে এসে আমি সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। তাই আমি আমার ছেলের এই কষ্টটা কখনোই সহ্য করতে পারবো না। তাই ছেলেকে বলেছি- তুমি গিটার শখে বাজাও। যখন ভালো লাগবে গিটার অবশ্যই বাজাবে এবং তোমার ঘর ভর্তি গিটার থাকবে। সারা বিশ্বের সব নামিদামি গিটার থাকবে। এজন্য তোমাকে আগে পড়াশুনা করতে হবে ভালোভাবে। আর এজন্যই ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে দেই পড়াশুনার জন্য।
সামিয়া রহমান: আপনার মধ্যে একটা অস্থিরতা কাজ করছে-
আইয়ুব বাচ্চু: সত্যি তাই।
সামিয়া রহমান: আপনি কী মনে করেন না আপনি সাকসেসফুল?
আইয়ুব বাচ্চু: না। আমি মোটেও সাকসেসফুল না। আমাদের এখানে এখনো ব্যান্ড মিউজিককে ফান হিসেবে ধরা হয়। সব মিউজিকের কথাই বলা যায়। আমি, আমরা, নতুন পুরাতন এবং সিনিয়র যারাই আছেন সবার মনের কষ্টের কথাই বলছি আমি। আসলে সাধারণ মানুষের ধারণা আমরা আনন্দ করছি, ঘুরছি-ফিরছি, মজা করছি। কিন্তু আমাদেরও যে খেতে হয় এটা কেউ বোঝে না। এটা যেনো কেউ বিশ্বাসই করতে চায় না। একজন আব্দুল আলীম আর ফিরে আসবেন না। একজন শাহ আব্দুল করিম আর তৈরি হবেন না। এরকম আরো অনেকের কথাই বলা যায়। আমরা এই মানুষগুলোর জন্য কি করেছি। ঢাকা শহরের কোথাও কি এরকম যারা লিজেন্ড আছেন তাদেরকে স্মৃতিতে রেখে কিছু করা হয়েছে? শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশ আর ধারাই কিন্তু একটা জাতিকে টিকিয়ে রাখে যুগের পর যুগ। কিন্তু আমরা কি সেটা মাথায় রাখছি? না। শিল্পী সত্ত¡া টিকিয়ে রাখার জন্য আগেও কাজ হয়নি, এখনো হচ্ছে না। সামনেও হবে না। অথচ এটা যে কতো গুরুত্বপূর্ণ তা কেউ অনুধাবন করছেন না। একজন আব্দুল আলীম কিভাবে গান লিখেছেন, কিভাবে সেটা তুলতেন এবং কিভাবে রেওয়াজ করতেন- এটা কয় জনে জানে? অথচ এটা জানাটা অনেক জরুরি। এরকম নানান চিন্তায় আসলেই মনে হয়- আমিও তো হারিয়ে যাবো একদিন। তাহলে কি করলাম এক জীবনে…।
সামিয়া রহমান: আপনার জীবনের একটা কষ্টের কথা জানতে চাই-
আইয়ুব বাচ্চু: আমার জীবনে একটাই কষ্ট- আমার আগে কেনো মায়ের মৃত্যু হল। মা চলে গেছেন আজ বারো বছর। ভালো হতো যদি উনার আগে আমি যেতে পারতাম। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কষ্ট এটাই।
সামিয়া রহমান: এখনকার গান তৈরির বিষয়ে একটু বলবেন-
আইয়ুব বাচ্চু: পুরো মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি এখন একটা অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। যে গাইছে সে জানে না কি গাইছে, সে বাজাচ্ছে সে জানে না নেক্সট এ কি বাজাবে। অথচ আমরা যখন ‘সুখেরই পৃথিবী দু:খেরই অভিনয়, যতো আড়ালেই রাখো আসলেই কেউ সুখী নয়…’ এই গানটি করেছি তখন কিন্তু চিন্তা করেছি পুরো দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষের কথা। সবার ইমোশনাল কথা এবং সবার মনের অবস্থার কথা। আমরা গান করার সময় গণমানুষের কথা চিন্তা করেই গান করেছি। মিউজিক, সুর-তাল-লয় আর ভোকালের একসাথে বসে কম্বিনেশন হয়েছিল। আর এখন গান নিয়ে ফেসবুকে পাগলামি হয়। আমরা এখন সেই পাগলামিই করছি।