Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

ক্রিয়ায় নেই প্রতিক্রিয়ায় আছি!

Tanvir-Tareqতানভীর তারেক: এই অস্থির সময়ে বোঝা মুশকিল কোনটা মূলত আমাদের স্টার-ইজমের গতিপথ! কী ভাবছেন? হঠাৎ এরকম কঠিন বাক্যচয়ন কেন করছি? বা এর কারণ প্রসঙ্গেও অনেকেই বিভ্রান্তি তুলতে পারেন। কিংবা বলতে পারে কেন তানভীর এসব কথা বলা শুরু করেছে। ফেসবুকে তর্ক তুলতে পারেন অকারণে অনেক কিছু বলে। কারণ আমরা এখন অনেকেই ক্রিয়ার চেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল বেশি হয়ে পড়ছি। কারণ আগে একটি গণমাধ্যমের মালিক হতে কোটি কোটি টাকার পরিকল্পনা করতে হতো। এখন একটি গণমাধ্যমের মালিক হতে ঘরের ওয়াইফাই আর ফেসবুক অ্যাকাউন্টটা থাকলেই হয়। যা ইচ্ছে তাই মতবাদ দিয়ে দিলাম।

মাত্র কিছুদিন আগে এক প্রখ্যাত অভিনেতা কাম চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির অন্যতম নেতা তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে একটি নিউজ শেয়ার দিলেন। সেই নিউজ পোর্টালের নাম আবোল-তাবোল ডট কম। থাম্বল আকারে সেই নায়কের ছবি আর হেড লাইন দেখা গেলেও নিউজ পোর্টালের নাম কিন্তু সহজেই চোখে পড়ে না। আমাদের মতো নিউজ চষে বেড়ানো চোখ হয়তো এড়াই না।

ভয়ের বিষয় হচ্ছে, দুই লাইন প্রশংসা করছে বলেই তারকারা সেই পোর্টালের নিউজ শেয়ার দিয়ে দিচ্ছেন। এর ভেতর দিয়ে পোর্টালের অগণিত ফেক নিউজের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে দিচ্ছেন। কারণ ফেসবুক প্রতিষ্ঠানটি তাদের ‘ইন্সট্যান্ট আর্টিকেল’ এর মাধ্যমে আলাদা টাকা দিচ্ছেন এখন। ফলে নানান ভুঁইফোড় অনলাইন নিউজ পোর্টাল বেরিয়ে যাচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তাই কতটা সামাজিক থাকছে তা এখন বলা মুশকিল।

শাকিব-অপুর বিয়ে ডিভোর্স প্রসঙ্গে এখন তোলপাড়। ফেসবুক আর ইউটিউবে সয়লাব হাজার হাজার নিউজে। মাত্র কিছুদিন আগে রমনা পার্কে একটি ফটোশুটে গিয়ে পড়লাম মহা বিপদে। একজন সেলিব্রিটির ফটোশুটে বেরিয়েছি আমরা ৩ জন। ভেবেছি গাছগাছালি আর নিরিবিলি পরিবেশে তারকাকে নিয়ে দারুণ এক ফটোশুট করানো যাবে। আমরা টিম রেডি করে গেলাম। ঘাস গালিচাই বসে আছি। এদিক ওদিক তাকাতেই হঠাৎ ক্যামেরা ট্রাইপড হাতে ৪ জন ছেলে-মেয়ে। বলা নাই কওয়া নাই ‘বুম’ এগিয়ে দিল। ভাইয়া অপুর বাসায় যে বাপ্পী গভীর রাতে নিয়মিত যাতায়াত করছে এর পেছনে কারণ কি?

আমি তো মহা মুশকিল। ক্যামেরা অনরেকর্ড। আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম।

‘ থামো ’ বলে। ক্যামেরা তবু রেকর্ড চলছে।

অতঃপর তারা কৌশলে অনেকটা হাসতে হাসতে দৌড়ে পালালো। তার ঠিক ১৫/২০ মিনিটের ভেতরে এক সুন্দরী মেয়ে এসে বললো এই তুমি যদি আজ বিয়ে না করো তাহলে আমি এই পার্কে চিৎকার দিয়ে উঠবো। আজকেই বিয়ে করতে হবে। আমি নিজের পূর্ব প্রেমিকাদের কথা মনে করছিলাম..এমন সময় আমি কিছু বলতে না বলতেই ..ওরা হেসে বললো।

‘ভয় পাবেন না, আমরা প্রাংক ভিডিও তৈরি করতে এসেছি। আপনার এক্সপ্রেশন নিতে এলাম। আমি রেগে ওর ক্যামেরার কার্ড নিতে যাব। আবার দৌড়!

বিপদ হলো আমার এই বিব্রতকর চেহারাই হয়তো তারা কোনো না কোনো ইউটিউব চ্যানেলে ছেড়ে দেবে। যা আমার অনুমতি ছাড়াই ধারণ করা হলো। এমন প্রতিনিয়ত রেকর্ড চলছে। …বেশিক্ষণ পার্কে থাকা গেল না। কারণ গুনে দেখলাম প্রায় ডজন খানিকের ওপরে ভিডিও টিম পার্কের আশেপাশে সক্রিয় । আমরা যে নাট্যতারকার ফটোশুট করতে এসেছি, তার বাইট নেবার জন্যও অস্থির করে দিচ্ছেন সবাই।

এই অবস্থায়, আসলে আমরা অনেকেই দ্বিধাগ্রস্ত। বা বিব্রত। টিভি টকশো’র প্যাটার্ন এখন বদলে গেছে। একাধিক চ্যানেলের প্রডিউসার থেকে শুরু করে উপস্থাপক পর্যন্ত তার শোতে মেসেজ দেবার বদলে কোনো একটি কথা বা মন্তব্য ভাইরাল করানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। একটি রেকর্ড টকশোতে এক তারকা গেস্ট হোস্টের এক প্রশ্নের জবাব দিতে না দিতেই সেই তারকাই অনুষ্ঠানের মাঝখানে চিৎকার দিয়ে উঠলেন।

‘দেখলেন কী জবাবটা দিলাম। এটা ছেড়ে দেন, কালকেই ভাইরাল! ’ পুরো প্রডাকশন আবার শুটিং শুরু করলেন।

তাই.. সত্যিই খুব বেদনাদায়ক এক সময়ের ভেতরে আছেন অনেকে। অন্যদিকে অনেকে এই খেলো বিষয় নিয়েই হতে চাইছেন আলোচিত। এ প্রসঙ্গে দু-লাইন লিখতে যাবেন, উপদেশ দিতে যাবেন ফেসবুক স্ট্যাটাসে, সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে নানান তর্ক বিতর্কের মারপ্যাঁচে মাথা ধরিয়ে দেবে। কারণ আমরা ক্রিয়ায় থাকি কম প্রতিক্রিয়ায় ওস্তাদ।

অথচ দেশের অধিকাংশ বড় মার্গের ইউটিউবাররা এ ধরনের প্রাংক ভিডিও তৈরি করে আজকের অবস্থানে এসেছেন। অন্যদিকে যারা এসব চর্চায় নেই তারা পড়ছেন হতাশায়। কারণ বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী সংস্থা থেকে শুরু করে সকল ধরনের প্রডিউসাররা এখন তাদের কাস্টিং-এর জনপ্রিয়তা মাপছেন তার ফেসবুকে কত ফলোয়ার বা ইউটিউবে কত সাবস্ক্রাইবার দেখে।

কিছুদিন আগে এক প্রখ্যাত অভিনেতা খুব আক্ষেপের সুরে বলে উঠলেন, ‘তানভীর, বড় মুশকিলের সময় আছিরে। কারণ এখন নাটকে পেমেন্ট সিকোয়েন্স ভাগ করা হচ্ছে কার কত সাবস্ক্রাইবার এটা গুনে। কিন্তু আমি তো এখনও ইউটিউব অ্যাকাউন্টও খুলিনি! ভাবছি কালকেই খুলে আমার দাঁতমাজার একটা ভিডিও আপ করবো।’

তারকা বড় ভাই মনোবেদনা থেকে এটা বললেও এটাই বাস্তবতা। এমনকি বলা যায় না, তার  ঐ দাঁত মাজার ভিডিও থেকেও একটি ভাইরাল হয়ে উঠতে পারেন।’

মাত্র কিছুদিন আগে আমার একটি রেডিও শোতে(শোটি ফেসবুকেও লাইভ সম্প্রচার হয় ) এক লাক্স ফটোসুন্দরী নাম না প্রকাশ করেই বললেন, তারকারা যে অর্ধকোটি টাকার গাড়ি পান। বা বলেন বাবা কিনে দিয়েছেন। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, কীভাবে এই টাকার জোগাড় হলো। আমি প্রায় বিব্রত। বিষয়টি ইউটিউবে দিতেই ভাইরাল হওয়া শুরু করলো। ওমনি আরেক লাক্স তারকা আমাকে হুমকিসুলভ ফোন।

‘তানভীর ভাই আপনার ইউটিউব অ্যাকাউন্ট থেকে ঐ মেয়ের স্টেটমেন্ট ডিলিট করুন। নইলে আমি ব্যবস্থা নেবো।’

– আমি তো মহা মুশকিলে পড়লাম! একই সঙ্গে বিরক্তও হলাম। তাকে বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আচ্ছা শোনো সেই ভিডিওতে কারো নামই উল্লেখ করেনি। এখন তুমি যদি উপযাজক হয়ে এরকম করো। তাহলে ঐ ‘ঠাকুর ঘরে কেরে’র মতো অবস্থা হবে। পরে সে বুঝলো..

এই যখন অবস্থা তখন আমার এক শোতে জনপ্রিয় তারকা তাহসান এলেন। তাহসান ডিজিটাল মিডিয়াতেও তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়। শো শুরুর আগে আমরা চা খাচ্ছিলাম। আর কি টপিকে কথা বলবো আলাপ করছিলাম।

তাহসান বেশ ভ্রæ কুঁচকেই বললেন, ‘আসলে অডিয়েন্স এখন এত হালকা বিষয় মানুষ শুনতে চায়, কী আর বলবো। আমার ডিভোর্স নিয়ে কথা বলবো তো হুমড়ি খেয়ে শুনবে। একই কথা আগেও বলেছি, আজকেও বলবো তবুও শুনবে।’

আমি বললাম, এর বাইরে রিলেশনশীপের দর্শন নিয়ে কথা বলুন আপনি। কারণ আপনারা সব  মাধ্যমে জনপ্রিয়।  আপনারা বলা শুরু করলে পরিস্থিতি বদলাবে। বদলানোও উচিত। নয়তো দিনকে দিন এই নিয়ন্ত্রণহীন সামাজিক গণমাধ্যম একটি অস্থির ভাগাড়ে পরিণত হবে।

আশার বিষয় হলোÑ একসময়কার প্রাংক নির্মাতা ইউটিউবার সালমান মুক্তাদির, তৌহিদ আফ্রিদি, ছোট আজাদসহ অনেকেই এখন দারুণ সব মেসেজ নির্ভর ভিডিও আপ করছেন। এটা মানতেই হবে তারা যে উপায়েই হোক জনপ্রিয়। এখন এই জনপ্রিয়তাকে পজিটিভ ভাবে তারা মোটিভ নিলে গোটা ইউনিটির চেহারা বদলাবে।

সেদিন হয়তো ক্যামেরা নিয়ে রমনা পার্কে দারুণ সব সবুজ গাছের ভেতরে ঝিলিক দেয়া রোদের দৃশ্য ধারণ করবে তরুণেরা। সেই নান্দনিক ভিডিও ফেসবুকে বা ইউটিউবে নন্দনতত্ত¡’র ঝড় তুলবে। এভাবেও তো আমরা ভাবতে পারি। আশা দেখতে পারি। স্বপ্ন জাগাতে পারি। সেই আশায় প্রতিদিন ল্যাপটপ খুলছি। প্রতিদিন সেই প্রত্যাশার দিন গুনছি।..একদিন চোখ বিস্ময় গুনবে কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক : উপস্থাপক, সাংবাদিক, সংগীত পরিচালক