Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

কেন আমরা ভয় নিয়ে খেলি!

মামুনুর রহমান
বাংলাদেশের মানুষের কাছে ক্রিকেট শুধুমাত্র একটি খেলা নয়। ঐতিহ্য, অহংকারের পাশাপাশি বিনোদনের অন্যতম একটি মাধ্যমও হয়ে উঠেছে। একবার কল্পনা করুন তো। কোনো কারণে আপনার মন খারাপ। মাঠে চলছে ক্রিকেট খেলা। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল ক্রিকেট পরাশক্তির কোনো দলকে হারিয়ে দিয়েছে। ক্রিকেটে জিতেছে বাংলাদেশ। নিশ্চিত করে বলে দিতে পারি আপনার মন ভালো হয়ে যাবে। হয়তো রাস্তায় আনন্দ মিছিল করতেও নেমে যাবেন আপনি। অথবা বন্ধু, শুভাকাঙ্খীদের সাথে সুখবরটা শেয়ার করতে শুরু করবেন। রাতে ভালো ঘুম হবে আপনার। এটাই প্রমান করে বাংলাদেশের মানুষের কাছে ক্রিকেটের জয়-পরাজয় কতটা গুরুত্বপুর্ণ। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বিশ্ব ক্রিকেটের তালিকায় যোগ্যতর দল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু গত বিশ্বকাপে আশানুরুপ সাফল্য দেখাতে পারেনি। বিশ্বকাপের পর-পরই দেশে ফিরে শ্রীলঙ্কায় খেলতে যায়। কিন্তু শ্রীলংকায় কোনো সাফল্যই মেলেনি। বরং পরাজয়ের গøানি নিয়ে দেশে ফিরতে হয়েছে। শ্রীলংকার পর ঘরের মাঠে আফগানিস্তানের সাথে টেস্ট খেলতে নামে বাংলাদেশ। কিন্তু মাত্র ৩টি টেস্ট খেলা আফগানিস্তানের মতো ক্রিকেট দলের কাছে শতাধিক টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতাপুস্ট বাংলাদেশ দল শোচনীয় ভাবে হেরে যায়। এই হারের ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই ঢাকা ও চট্টগ্রামে শুরু হওয়া ত্রিদেশীয় অর্থাৎ বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও জিম্বাবুয়ের ম্েযধ টি২০ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট শুরু হয়। এখানেও বাংলাদেশ আহত বাঘের মতো শুধুই ছটফট করছে। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত প্রথম খেলায় ভাগ্যগুনে কোনো মতে জিম্বাবুয়ের সাথে জয় পেয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় খেলায় আবার হেরেছে আফগানিস্তানের সাথে। ফলে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষৎ নিয়ে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। ১৯ বছরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল টেস্ট ক্রিকেটের ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে আছে বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করছেন। ওয়ানডে ফরমেটে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল মোটামুটি পারফরমেন্স দেখাতে পারলেও টি২০ ফরমেটে আহামরি কোনো সাফল্য দেখাতে পারছে না। কিন্তু কেন? অভিজ্ঞ মহলের মতে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিতে হলে টেস্ট, ওয়ানডে ও টি২০ তিন ফরমেটেই পৃথক ভাবে গোছালো ক্রিকেট স্কোয়াড জরুরি। এজন্য ঘরোয়া ক্রিকেটে মানসম্মত ক্রিকেটার তৈরি ও তাদের ক্ষেত্রে নজরদারি বাড়ানোর ব্যাপারে বিসিবির প্রতি পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে।
কয়েকজন অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান, দুই তিনজন দক্ষ স্পিনার, অধিনায়কের দায়িত্বশীলতা আর ঘরোয়া ক্রিকেটের শক্ত ভিত্তি এবং অদম্য ইচ্ছে শক্তির কারনেই নিজেদের তৃতীয় টেস্টেই দারুন জয় পেয়েছে আফগানিস্তান। এমনটাই মনে করছেন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে চরম হতাশা ব্যক্ত করেছেন তারা। জাতীয় দলের সাবেক কোচ সারোয়ার ইমরান বলেছেন, নাম্বার ওয়ান, টু, থ্রি যে টীমে ঠিক থাকে না ঐ টীমে ব্যাটিং এর ক্ষেত্রে ভালো রেজাল্ট আশা করা উচিৎ নয়। একটা দলের সলিড ৫টা অথবা ৬টা ব্যাটসম্যান থাকা উচিৎ। তাহলে দলে ব্যাটসম্যানের দায়িত্ব বাড়ে। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বর্তমান অবস্থা তো তেমন নয়। সাবেক ক্রিকেটার ইশতিয়াক আহমেদ বলেছেন, টেস্ট ক্রিকেটে ধৈর্য্য খুব বেশি প্রয়োজন। বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ধৈর্য্যরে খুব অভাব।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ১১৫টি টেস্ট খেলেছে। এর মধ্যে জয় মাত্র ১৩টিতে, হেরেছে ৮৬টিতে। প্রায় ১৯ বছরে টেস্ট ক্রিকেটে উন্নতি মাত্র ১১%। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের মন্তব্যÑ বাংলাদেশের ক্রিকেটে গতি আনতে হলে ঘরোয়া ক্রিকেটের প্রতি জোর দিতে হবে। একই সাথে ক্রিকেটারদের মাঝে মানসিক শক্তি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে। একথা অবশ্য বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন। টেস্টে আফগানিস্তানের বিপক্ষে হারার পর সাকিব বলেছেন, খেলার সময় আমাদের ক্রিকেটারদের মধ্যে ভয় কাজ করে। এই ভয় দূর করতে হবে।
সাকিবের কথাই যদি সত্যি হয় তাহলে ভয়টা কিসের? বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সাকিব আল হাসান বেশ ভালো পারফরমেন্স দেখিয়েছেন। সেজন্য প্রশংসাও পেয়েছেন। কিন্তু বিশ্বকাপের পর সাবিব আল হাসানই কি তার পারফরমেন্স ধরে রাখতে পারছেন? আফগানিস্তানের সাথে একমাত্র টেস্টে সাকিবের পারফরমেন্স আহামরি ছিল না। জিম্বাবুয়ে ও আফগানিস্তানের সাথে দুটি টি২০ ম্যাচেও সাকিব ব্যাটিং বোলিং দুই জায়গায়ই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। দলের পঞ্চপান্ডব বলে পরিচিত ৫ তারকা ক্রিকেটারের মধ্যে মাশরাফি তো বিদায় নিয়েছেন বলা যায়। তামিম ইকবাল দল থেকে ছুটি নিয়েছেন। অপর তিন তারকা ক্রিকেটার সাকিব, মুশফিক ও মাহমুদুল্লাহ’র বর্তমান পারফরমেন্স যারপর নাই উদ্বেগজনক। টেস্ট ও টি২০ দুই ফরমেটেই মুশফিক হঠাৎ যেন খেই হারিয়ে ফেলেছেন। আগের সেই মুশফিকের দেখা যেন মিলছেই না। সাকিব বলেছেন, আমাদের ক্রিকেটাররা ভয় নিয়ে খেলে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে পঞ্চপান্ডবের তিন তারকাও যেন অজানা ভয়ে অস্থির। ভয়টা কিসের? এটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন।
আফগানিস্তান তো টেস্ট ক্রিকেটে নতুন। আর জিম্বাবুয়ে নানা সংকটে অস্থির একটি দল। অথচ মাঠের খেলায় কোনো ভাবেই ছাড় দিতে নারাজ। ঘরের মাঠে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দুটি ক্রিকেট দলের সাথে ক্রিকেট খেলতে গিয়েই অভিজ্ঞ বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কাহিল অবস্থা। তাহলে নভেম্বরে শক্তিধর ভারতের সাথে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে বাংলাদেশ আসলে কি করবে?
যুব এশিয়া কাপের ফাইনালে বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৯ দল ভারতের সাথে আবারও হেরেছে। ভারতের সাথে এই হারকে ‘মানসিক’ কারণ বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ বড় দলের সাথে খেলতে নামলেই বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা যেন একটু সিধিয়ে যায়। কিন্তু আফগানিস্তান ও জিম্বাবুয়ে তো বাংলাদেশের চেয়ে ক্রিকেটের ক্ষেত্রে বড় দল নয়। তাহলে এই দুই দেশের সাথে খেলতে গিয়েও কেন এতো কলংকের বোঝা কাধে নিতে হচ্ছে? বিশ্বকাপের পর বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এই যে এতো হেরেই চলেছে…. এর থেকে উত্তরণের পথ কী?
এমন তো বলা যাবে না যে বাংলাদেশে ক্রিকেটের অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধাসন্তোষ জনক নয়। বরং বাংলাদেশে অন্যান্য খেলার চেয়ে ক্রিকেটের অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধাই অনেক বেশি। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং সর্বদাই ক্রিকেটের ভালো-মন্দ নিয়ে অস্থির থাকেন সে দেশে ক্রিকেট কেন এতো পরাজয়ের বৃত্তে ঘুরপাক খাবে? এই প্রশ্নই এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।