Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

কাশেফ চৌধুরীর অনবদ্য স্থাপত্য

মোহাম্মদ তারেক

আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন বিশাল একটি ভবন। ইটের গাঁথুনি দিয়ে নির্মিত ভবনটি একাধিক ব্লকে বিভক্ত। সেখানে রয়েছে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, লাইব্রেরি, অভ্যনৱরীণ চলাফেরা ও থাকা-খাওয়ার সু-ব্যবস্থা। একটির সঙ্গে আরেকটির মধ্যে রয়েছে সংযুক্ত বারান্দা ও খোলা প্যাভিলিয়ন। কিন্তু পুরো ভবনটিই দৃষ্টির আড়ালে। পাশ দিয়ে চলে গেছে গ্রাম্য সড়ক। অথচ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে ভবনটি। কারো চোখেই পড়বে না। কারণ পুরো ভবনটি মাটির সমানৱরালের নীচে। প্রকৃতির সঙ্গে মিশে আছে। ভবনের বিভিন্ন রুমের ছাদ মাটির সমতলে। তাতে লাগানো সবুজ ঘাস মিশে গেছে আশে পাশের মাটির সঙ্গে। প্রকৃতির মধ্যে মিশে যেন লুকিয়ে আছে ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার নামক এই ভবনটি। গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের মদনের পাড়া গ্রামের বালাসী সড়ক ঘেষে গড়ে ওঠা এই ভবনের আয়তন বত্রিশ হাজার বর্গফুট। প্রকৃতির মধ্যে মিশে থাকা ভবনটি দেখতে প্রতিদিনই কৌতুহলী মানুষের  ভিড় জমে। এমন একটি ব্যতিক্রমী স্থাপনা এলাকার সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাটি এবার আনৱর্জাতিক পর্যায়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিল। সারা বিশ্বের সম্মানজনক আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকায় এবার বাংলাদেশের যে দুটি স্থাপনা মনোনয়ন পেয়েছে এটি তার মধ্যে একটি। সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্কের পুরস্কারের জন্য বিশ্বের ৩৮৪টি স্থাপনাকে পেছনে ফেলে সেরা ১৯ স্থাপনার তালিকায় রয়েছে ফ্রেন্ডশিপ Shah-Cementসেন্টার। এ স্থাপনাটির স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী। স্থপতিদের উদ্ভাবনী ধারণাকে স্বীকৃতি দিতে আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক প্রতি তিন বছর পর পর এই পুরস্কার দিয়ে থাকে। অনেক বিষয় এ ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়। উদ্ভাবনী আইডিয়ার পাশাপাশি স্থাপনাটি কতটা পরিবেশ বান্ধব তাও দেখা হয়। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে এটির যোগসূত্রও বিবেচনা করা হয়।  প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার সম্পর্কে কাশেফ মাহবুব চৌধুরী বলেন, স্বল্প বাজেটে এই স্থাপনাটি নির্মানের চিনৱা ভাবনা ছিল। ভবনের অনুপ্রেরণা বৌদ্ধ বিহারের ধারণা থেকে এসেছে। ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারের ভবনটি উপর দিক থেকে দেখলে মহাস্থানগড়ের প্রাচীন বৌদ্ধবিহারের চিত্র ফুটে ওঠে অনেকটা। তিনি আরও বলেন, ভবনের জমি খুবই নিচু ছিল। পানি আটকাতে চারদিকে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। ভবনের ছাদের লেভেল রাসৱার প্রায় সমতলে। আমার লক্ষ্য ছিল অল্প খরচে সবার জন্য ভিন্নধর্মী কিছু একটা করা। এটি একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কার্যালয়। সংস্থাটি চরের মানুষের জন্য কাজ করে। সেখানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পাশাপাশি চরের মানুষজনের জন্য সেবা দেওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। তাই সেখানে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিদেশি দাতা সংস্থার লোকজন আসবেন, থাকবেন- সেটাও একটি বিষয়। সবাই যাতে ভবনে স্বচ্ছন্দ্যে বিচরণ করতে পারেন, সেটাও মাথায় রাখতে হয়েছে। ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে জেনে নিরিবিলি ও শানৱ একটি পরিবেশ তৈরির বিষয়টি ভাবা হয়েছে। পর্যাপ্ত আলো আর বাতাসের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এতে ব্যবহার করা হয়েছে দেশি উপকরণ। বিশাল এই ভবনটি নির্মাণে খরচ হয়েছে আট কোটি টাকা। এর মধ্যে সকল আসবাবপত্র, জেনারেটর ইত্যাদি সবই অনৱর্ভুক্ত। এর কাজ শেষ করতে সময় লেগেছে প্রায় দুই বছর। প্রতিষ্ঠানটি মনে করছে, মাটি ভরাট করে ভবন নিমার্ণ করতে গেলে বাজেটের ৬০ শতাংশই শেষ হয়ে যেত। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান গ্রামে হওয়ার কারণে সেখানে দোতলা ভবন করলে গ্রামের পরিবেশের সঙ্গে মিলত না। তাই সমতল ভূমির সঙ্গে মিল রেখে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। এতে গ্রামের প্রকৃতির অংশও হয়ে উঠেছে ভবনটি।

এর আগেও আগা খান পুরস্কারের জন্য দুবার মনোনীত হয়েছিলেন কাশেফ মাহবুব চৌধুরী। চট্টগ্রামের চান্দগাঁওয়ে নির্মিত একটি মসজিদের জন্য ২০১০ সালে একক ভাবে আগা খান পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পান তিনি। তিন ভাই বোনের মধ্যে সবার বড়- তিনি জন্ম ঢাকায়। কাশেফের বাবা দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী গণপূর্ত বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন। মা সাবিয়া চৌধুরী একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রিন্সিপ্যাল। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শোনা তার পছন্দের বিষয়। ফটোগ্রাফিতে বেশ পারদর্শী। তবে লেখালেখির ঝোকটা ছিল অনেক বেশি। ইউরোপের ইন্টারন্যাশনাল পাবলিকেশন থেকে ফটোগ্রাফির ওপর তার একটি বই বের হচ্ছে। ১৯৯৫ Shah-Cement-1সালে বুয়েট থেকে তিনি ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। পাস করে বের হওয়ার পর তিনি যোগদেন স্থপতি উত্তম সাহার ‘নন্দন লিমিটেড’ নামের একটি ফার্মে। সেখানে এক বছর চাকরি করার পর আরেক স্থপতিকে সঙ্গে নিয়ে নিজে গড়ে তোলেন ‘আরবানা’ নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। ২০০৪ সাল থেকে এখন পর্যনৱ কাশেফ মাহবুবই আরবানার একক কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইতিমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি দেশের নামকরা অফিস বিল্ডিং, অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং, একাধিক হোটেল, হসপিটাল, মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ অসংখ্য রেসিডেন্স বিল্ডিংয়ের ডিজাইন করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে- মেরিনা তাবাসসুমের সঙ্গে যৌথভাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা সৱম্ভ ও স্বাধীনতা জাদুঘরের নকশা, চট্টগ্রামের চান্দগাঁওয়ে জামে মসজিদ, সাতক্ষীরায় ৮০ বেড বিশিষ্ট হাসপাতাল, কুয়াকাটায় সাইক্লোন সেল্টার, ইএইচএল প্রিমিনিয়াম কনভেমিনিয়াম, গুলশান-২ এ উঁচুমানের বিল্ডিং র‌্যাংগস আর্টিষ্টি সহ অসংখ্য বিল্ডিংয়ের ডিজাইন করেছেন বিশ্বায়ণের এই যুগে তার সৃষ্টি কর্মগুলো দেশীয় অবয়বের পাশাপাশি আনৱর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। বর্তমানে বেশ কিছু নতুন প্রজেক্টের কাজ করছেন তিনি। কাশেফ মাহবুব চৌধুরী তার সব ধরনের কাজ স্থাপত্যনীতি ও রাজউকের নিয়ম মেনেই করেন। বাংলাদেশের আবহাওয়া, জলবায়ু, প্রকৃতিকে ঠিক রেখে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের দিকে নজর দেন তিনি। এই স্থপতি তার নিজের কাজ সততা ও নিষ্ঠার সাথে করতে ভালোবাসেন। পেশার কাছে দায়বদ্ধ থেকে সেটাকে সততার সাথে শেষ করতে চান স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী।