Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

কান্না ভেজা শহীদ মিনার!

সুবর্না হক
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। লোক লোকারণ্য। শহীদ মিনারের বেদীটুকু ছাড়া আর কোথাও তিল ধারনের ঠাই নেই। যে দিকে তাকাই শুধুই মানুষ আর মানুষ। নবীণ-প্রবীণ সঙ্গীতশিল্পী, শিক্ষাবিদ, চিত্রশিল্পী, রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী, ছাত্র-ছাত্রী, শ্রমিক সহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের সাধারন মানুষও ভীড় করেছেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এসেছেন অনেকে। আবার কেউ এসেছেন পারিবারিকভাবে ছেলে-মেয়েদের সাথে নিয়ে। অনেকেই এসেছেন একা। চোখে বাধ ভাঙ্গা কান্না। হাতে ফুলের অর্ঘ। প্রিয় শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুকে শেষ দেখা দেখতে এসেছেন সবাই। হাজার হাজার মানুষের বিষণœ অবয়বে একটাই আহাজারিÑ কি হতে কি হয়ে গেল? এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। বড্ড অসময়ে চলে গেলেন আমাদের প্রাণের মানুষ, গিটারের জাদুকর, মানবিক কণ্ঠশিল্পী আইয়ুব বাচ্চু।
নেত্রকোনা থেকে এসেছিলেন স্বপন গুহ। একজন কলেজ ছাত্র। আগের দিন টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের খবরে জেনেছেন প্রিয় শিল্পী মারা গেছেন। প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। রাতেই নেত্রকোনা থেকে ঢাকার বাসে উঠে পড়েন। ভোর থেকে শহীদ মিনারে একটি লাল গোলাপ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। প্রিয় শিল্পীর কফিনে গোলাপ শ্রদ্ধা জানাবেন। প্রশ্ন করতেই কেঁদে ফেললেন স্বপন গুহ। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, প্রতিদিন আইয়ুব বাচ্চুর গান শুনে আমি জীবনের প্রেরণা খুঁজি। তাঁর গিটারের সুর আমার সৃষ্টিশীল কর্মের অনুপ্রেরণা। মানুষটা হঠাৎ করেই চলে গেল। আমার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল! বলেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন স্বপ্ন গুহ।
প্রিয় শিল্পীর কফিনে ফুল দেওয়ার জন্য অনেক বড় লাইন পড়েছে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে সেই লাইন চলে গেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রধান গেট পেরিয়ে আরও দূরে। ফুল হাতে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন একজন তরুণী। কেঁদে কেদে চোখ ফুলিয়েছেন। তার সাথে কথা বলতে চাইলে প্রথমে আগ্রহ দেখালেন না। পরক্ষনেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। বললেন, আমার জীবনের অনুপ্রেরণা ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। নানা কারনে মাঝে মাঝেই আমি হতাশ হই। তখন আইয়ুব বাচ্চুর গান আমার জন্য টনিকের মতো কাজ করে। কেন এতো অসময়ে চলে গেল আমাদের বাচ্চু ভাই… বলেই ওড়নায় মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকলেন সেই তরুণী।
একজন মা দাঁড়িয়েছিলেন দীর্ঘ লাইনের মাঝামাঝি। চোখে পাওয়ারি চশমা। সাধারন মানের শাড়ির সাথে একটা চাদর জড়িয়েছেন শরীরে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে একজন জীবন সংগ্রামী মা। জিজ্ঞেস করলামÑ আপনার সাথে কথা বলা যাবে? পাল্টা প্রশ্ন করলেনÑ কি কথা বলবেন? আপনি কি সাংবাদিক?
পরিচয় দিতেই বললেন, তেজগাঁওয়ে একটি গার্মেন্টেসে চাকরি করি। আজ অফিস যাই নাই। প্রিয় শিল্পীকে শেষ দেখা দেখতে এসেছি। আপনি কি এই শিল্পী গান শুনেছেন? প্রশ্ন করতেই যেনো প্রতিবাদের ঝংকার তুললেন, এটা কি ধরনের প্রশ্ন করলেন আপনি? আইয়ুব বাচ্চুর গান না শুনে কি থাকা যায়? আম্মাজান… আম্মাজান… তার এই গানটি আমার খুবই প্রিয়। মন খারাপ হলেই আমি গানটা শুনি। বলেই চশমার ফাঁকে কান্না লুকাতে চেষ্টা করলেন ওই মা। এমনি আরও কত কান্না ভেজা মুখ যে চোখে পড়ল শহীদ মিনারে তার কোনো ইয়ত্তা নাই। পরিচিত, অপরিচিত অনেক চোখেই কান্না। একজন শিল্পীর জন্য এতো কান্না কেউ কি দেখেছে এর আগে? শুধু কি সাধারণ মানষের কান্না? যখন প্রিয় শিল্পীর কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে দেখলাম দেশ বরেণ্য নাট্য ব্যক্তিত্ব, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরকে তখন নিজেও কান্না চেপে রাখতে পারলাম না। প্রিয় শিল্পীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন নাট্যজন আসাদুজ্জামান নূর। আইয়ুব বাচ্চুর কফিনের পাশে এসেই নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না। হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। বিপরীত দিকে আইয়ুব বাচ্চুর কফিনের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন কুমার বিশ্বজিৎ সহ এলআরবি ব্যান্ডের সদস্যদের সাথে আরও অনেক সঙ্গীত শিল্পী। তারাও কান্না লুকাতে পারলেন না।