Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

কবির জন্য ভালোবাসা

রেজানুর রহমান: এমন ঘটনাও ঘটে। প্রিয় লেখক সৈয়দ শামসুল হক তখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অসুস্থ শরীরেও তিনি নিয়মিত লিখে চলেছেন। আমরা তাকে চমকে দিতে চাইলাম। চ্যানেল আই-এর জন্মদিন উপলক্ষে আনন্দ আলো প্রিয় লেখকের ওপর একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিল। ‘সৈয়দ শামসুল হক চ্যানেল আই-এর অকৃত্রিম বন্ধু’ এই শিরোনামে সংখ্যাটি প্রকাশ হবে। চটজলদি লেখাও জোগাড় হয়ে গেল। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের ওপর কিছু লিখতে পারাও তো অনেক আনন্দের। গর্বেরও বটে। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন, ইমদাদুল হক মিলন, ফরিদুর রেজা সাগর, সুবর্ণা মুস্তাফা, শাইখ সিরাজ, আনিসুল হক, আমীরুল ইসলাম, লুৎফর রহমান রিটন, রেজা উদ্দিন স্ট্যালিন, আহমাদ মাযহার, রাজু আলীম আনন্দ আলোর এই বিশেষ সংখ্যার জন্য লিখলেন। আনন্দ আলো পরিবার দারুণ ব্যস্ততা। প্রিয় লেখককে চমকে দিতে যাচ্ছি আমরা।

পত্রিকার মেকআপ শুরু হয়েছে। একটার পর একটা পৃষ্ঠা মেকআপ করে যাচ্ছি। হঠাৎ খবর এলো প্রিয় লেখকের শারীরিক অবস্থা অবনতির দিকে। তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। আমাদের সমবেত প্রার্থনা শুরু হলো। সৃষ্টিকর্তা যেন আমাদের প্রিয় লেখককে সুস্থ করে দেন। আমরা যেন তাকে আবার ফিরে পাই।

পত্রিকা মেকআপের দ্বিতীয় দিন। আজ আয়োজন সম্পন্ন হবে। তারপর প্রেসে যাবে ছাপার জন্য। হঠাৎ বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক আমীরুল ইসলামের ফোন। রেজানুর ভাই খবর শুনেছেন?

আমীরুলের কথায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে আমার মনের ভিতর। খবর শুনেছেন মানে কী? তিনি কি সৈয়দ হকের ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে চাচ্ছেন? জিজ্ঞেস করলাম- খবর মানে…? কী…? আমীরুল মন খারাপ করা কণ্ঠে বললেন- হক ভাই আর আমাদের মাঝে নাই। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।

ওপাশে আমীরুল নিশ্চুপ। এপাশে আমি। আনন্দ আলোর এখন কি করা উচিত। সংখ্যাটির প্রকাশ কি বন্ধ রাখা উচিত? অনেক আলোচনার পর আনন্দ আলোর সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি ফরিদুর রেজা সাগর সিদ্ধান্ত দিলেন আনন্দ আলোর বিশেষ সংখ্যাটি যে ভাবে ছাপার জন্য তৈরি করা হয়েছে সেভাবেই ছাপা হবে।

কবি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ২৭ সেপ্টেম্বর। ৩ দিন পর ১ লা অক্টোবর কবিকে নিয়ে আনন্দ আলোর বিশেষ সংখ্যাটি প্রকাশ হলো। ২ অক্টোবর সম্পাদকের মোবাইলে একটি ফোন এলো। পুরুষ কণ্ঠ। কাঁদছেন তিনি। হ্যালো কে বলছেন? সম্পাদক জানতে চাইলেন।

ওপাশে কান্না থামছেই না। কান্নার শব্দ বাড়ছে। সম্পাদক আতঙ্কগ্রস্ত। পারিবারিক কোনো দুঃসংবাদ আছে কী? সম্পাদক জোর দিয়ে বললেন- হ্যালো কে বলছেন? আপনি কাঁদছেন কেন? কি হয়েছে বলুন…

ওপাশের পুরুষ কণ্ঠ কাঁদতে কাঁদতেই বললেন- আমাকে আপনি চিনবেন না। আমি আনন্দ আলোর একজন  পাঠক। সৈয়দ হকের ওপর আনন্দ আলোর বিশেষ সংখ্যাটি পড়লাম। আমাদের দুর্ভাগ্য প্রিয় কবিকে আর আমরা কাছে পাবো না… বলেই তিনি ফোন কেটে দিলেন। সংখ্যাটি হাতে পাবার পর এরকম আরও অনেকে ফোন করেছেন। প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। চট্টগ্রাম থেকে কাজী বশির নামে একজন শিক্ষক পরামর্শ দিলেন- সৈয়দ হকের সিনেমা জীবন নিয়ে একটি বড় প্রতিবেদন আনন্দ আলোয় প্রকাশ করার জন্য।

কুড়িগ্রাম থেকে আনন্দ আলোর এক পাঠক তার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বললেন- আনন্দ আলোর আয়োজনটি ইতিহাসের একটি অংশ হয়ে থাকবে। কবির জীবদ্দশায় সংখ্যাটি প্রকাশ হলে নিশ্চয়ই কবি খুশি হতেন।

সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন আনন্দ আলোর একজন অভিভাবক। এমনও হয়েছে তিনি নিজেই পরামর্শ দিয়েছেন। বলেছেন- তোমরা এবার এটা নিয়ে কাজ করো। ঐটার ব্যাপারে নজর রাখো। মনে পড়ে একবার বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি আনন্দ আলোয় এক দীর্ঘ আড্ডায় বসেছিলেন। সেই আড্ডায় আমাদের বাংলা সাহিত্য ও প্রিয় মাতৃভূমিকে নিয়ে অনেক প্রত্যাশার কথা বলেছেন। যা আমাদের কাছে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

চ্যানেল আই-এর ছাদ বারান্দায় আনন্দ আলো সাহিত্য আড্ডায় সৈয়দ হক এক দীর্ঘ বক্তৃতা দেন। তার কিছু অংশ ছিল এরকম-

s-hoque-2সাহিত্য যখন শুরু করেছিলাম আজ থেকে পঁয়ষট্টি বছর আগে তখনও ভাবিনি সাহিত্য নিয়ে এরকম আড্ডা হবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে, সুদৃশ্য গোল টেবিলের চারপাশে সুন্দর সুন্দর চেয়ারে বসতে পারব। কথা শুরুর আগে সিঙ্গারা আসবে, ডালপুরি আসবে, চা আসবে। কারো মুখ দেখে মনে হবে না কোনো সমস্যা আছে। সবাই খুব স্মিত ও উৎফুল্ল। মনে পড়ে সাহিত্য আড্ডায় অংশ নিতাম পাটুয়াটুলিতে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের সওগাত পত্রিকার গুদাম ঘরে। সেই গুদামে কাগজ রাখা হতো। কাগজের রীম সরিয়ে একটি শতরঞ্জি বিছিয়ে আমরা ৬০/৭০ জন বসতাম প্রতি ১৫ দিনে। সেখানে সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত একটি প্রবন্ধ, দুটি কবিতা ও একটি গল্প পড়া হতো। আড্ডা শেষে যতটা ছোট হতে পারে একটি সিঙ্গারা ও ছোট এককাপ চা দেয়া হতো। এতেই আমরা কত উৎফুল্ল ছিলাম। কারা সেই আড্ডায় উপস্থিত থাকতেন সেই নাম শুনলেই চমকে উঠতে হয়। ড. কাজী মোতাহার হোসেন, তিনি আমাদের সভাপতি ছিলেন। আব্দুল গনি হাজারী, সরদার জয়েন উদদীন এবং শওকত ওসমানের মতো লেখক। লক্ষ্মীবাজারের যে বাড়িতে থাকতাম সেই বাড়ির বারান্দা ঘিরে একটি ঘর করা হয়েছিল। সেখানে একটি চৌকি পাতা ছিল। মাথার কাছে একটি ছোট টেবিল ছিল কিন্তু চেয়ার বসার জায়গা ছিল না। এজন্য লেখার জন্য আমাকে রেস্টুরেন্টে বসতে হতো। ১৯৫২ সালের দিকে লক্ষ্মীবাজারে মতি ভাইয়ের রেস্টুরেন্টে আমরা বসতাম। আমরা মানে আব্দুল গাফফার চৌধুরী, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, কবি ফররুখ আহমেদসহ অনেক গুণীজন। তারা আসতেন, গল্প করতেন চা খেতে খেতে আড্ডা দিতেন। আড্ডা একেবারে জমে উঠতো। পরবর্তীতে শামসুর রহমান আসতে শুরু করলেন। আমাদের এক বন্ধু ছিলেন গণিত শাস্ত্রবিদ মিজানুর রহমান তিনিও আসতেন।

রথখোলায় খোশমহল বলে একটি রেসেৱারাঁয় সাহিত্যের আড্ডা বসতো। নর্থব্রক হল রোডে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে শফিউল্লাহ সাহেব থাকতেন। সেখানে তার একটি প্রেস ছিল রেনেসাঁ নামে। সেই প্রেস দেখাশোনা করতেন শফিউল্লাহ সাহেবের ছোট ভাই জকিউল্লাহ। আমাদের সবার প্রিয় জকি ভাই। তার সঙ্গেও আড্ডা হতো। সেই প্রেসের উল্টো দিকে বিশ্রামালয় নামে একটি রেস্টুরেন্ট ছিল। রেস্টুরেন্টে এক ভদ্রলোক বসতেন। তার নামটা কখনোই জানা হয়নি। তিনি সকাল ও বিকেল দুইবেলা চায়ের দোকান খুলতেন। সেখানে পাওয়া যেত চা, নোনতা বিস্কুট ও ডিমপোচ। দোকানী একজন শৌখিন মানুষ ছিলেন। ফিনফিনে সাদা পাঞ্জাবী ও ধুতি এবং সোনালী ফ্রেমের চশমা পরতেন। রাতে রবীন্দ্র সঙ্গীতের চর্চা করতেন। ওখানে রনেশ দাস গুপ্ত, সত্যেন সেন এরা নিয়মিত বসতেন।

বামপন্থি নেতাদের আড্ডা ছিল সেখানে। আমি রেনেসাঁ প্রেসে বসতাম মাঝেমধ্যে। উল্টোদিকের বিশ্রামালয়ে যেতাম। ধীরে ধীরে সেখানে একটি আড্ডা জমে ওঠে। এই আড্ডায় একসময় যোগ দিলেন সঞ্জীব দত্ত। সঞ্জীব দত্ত হচ্ছে ধীরেন দত্তের জ্যেষ্ঠ পুত্র। ধীরেন দত্ত ’৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত হন। ধীরেন দত্ত ইংরেজিতে কবিতা লিখতেন, পাকিস্তান অবজারভার-এ সম্পাদকীয় লিখতেন, চাকরিও করতেন। সঞ্জীব দত্ত আমাদের সব সময় মাতিয়ে রাখতেন নানান মজার কথার খেলায়। তিনি বলতেন সপ্তাহ যদি ৭ দিনে না হয়ে ৬ দিনে হতো তাহলে পলাশীর যুদ্ধ কোন সালের কয় তারিখে হয়েছিল। তিনি এটা ক্যালকুলেট করতে বলতেন। আরো বলতেন আমি যদি আমি না হয়ে তুমি হতেন এবং তুমি যদি তুমি না হয়ে তিনি হতেন তাহলে সমাজটা কি রকম হতো। এ রকম নানান ধরনের বিদঘুটে প্রশ্ন করতেন। গোবিন্দ ধামের আড্ডার প্রাণ পুরুষ ছিলেন ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী ব্রোজেন দাস। তিনি সাঁতারু হলেও সাহিত্যে সাঁতার কাটতে পারতেন এটা আমাদের অনেকের অজানা। তিনি আমাদের অনেককেই ডাকতেন আড্ডা দেয়ার জন্য। বিউটি বোডিং-এর আড্ডার কথা বলা হয়েছে। এই আড্ডার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব কবি শহীদ কাদরীর। আমি তখন লেখার জন্য রেস্টুরেন্ট খুঁজে বেড়াতাম। তখন শহীদ কাদরী একদিন বললেন, আমার বাড়ির কাছে একটি রেস্টুরেন্ট হয়েছে সেখানকার চমৎকার ডাইনিং টেবিলে বসে আপনি লিখতে পারেন। মূলত শহীদ কাদরী বিউটি বোডিং-এ আড্ডার সূচনা করেন। অনেকেই এই কৃতিত্ব নিতে চায় কিন্তু এটা ঠিক নয়। তখন নিয়মিত বিউটি বোডিং-এ বসে লিখতে শুরু করি। একসময় আড্ডায় যোগ দেন কবি শামসুর রাহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, সৈয়দ আতিকুল্লাহ, ধীরেন দত্তসহ অনেকে। পরবর্তীতে আরো অনেকেই আসতে শুরু করেন। আমি ১৯৫৮ সালে আড্ডা ছেড়ে দেই।

s-hoque-coverনানান কারণে আড্ডা দেয়া সম্ভব হয়নি আমার। আমার ১৮ বছরের পুত্র বিয়োগের ফলে সংসারের অনেক ঝামেলা পোহাতে হতো। যা হোক সাহিত্য যখন শুরু করি তখন আমার বাবা খুব বিরোধিতা করেছিলেন। বলেছিলেন তুমি যে সাহিত্য করছো তুমিতো একসময় অনাহারে মারা যাবে। সাহিত্যিকদের একসময় এরকমই মন্তব্য করা হতো। বাবা বলতেন সাহিত্য করতে গিয়ে তোমার যক্ষ্মা হবে। তখন সাহিত্যিকদের সম্পর্কে বিখ্যাত ব্যাধী হতো যক্ষ্মা। তুমি মদ্যপান করে নর্দমায় গড়াবে? তোমার জামা ছেঁড়া থাকবে। ক্ষয়া স্যান্ডেল থাকবে। বাবার এইরকম ভবিষ্যদ্ববাণী করার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম তবুও আমি সাহিত্যিক হতে চাই। বাবা এটা বলবার একটা কারণ ছিল। তিনি যখন কলকাতায় ডাক্তারী পড়তেন তখন মুসলিম এক কবির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বাবা ডাক্তারী পাস করে কলকাতার জাকারিয়া স্টিটে প্র্যাকটিস করতেন এবং থাকতেন একটি মেসে। সেই মেসে ঐ কবিও থাকতেন। পরবর্তীকালে সেই কবি দুই বাংলায় বিখ্যাত হয়ে যান। তার নাম বলব না, তিনি সবার নমস্য ব্যক্তি। তার কবিতার দুটি লাইন বলছি। কবিতা শুনে হয়তো চিনতে পারেন- ‘ভৈরবে ভেরি গরজে গভীরে দুর্জে তুরিও তান, কুল মুখলুকে জাগে রোমাঞ্চ জিন্দা পাকিস্তান।’

বাবার মুখ থেকে শুনেছি। একদিন সকালে মেস থেকে বের হওয়ার সময় বাবাকে সেই কবি বলেছিলেন ডাক্তার সাহেব আপনার কাছে দুটো টাকা হবে। ১৯২১ সালের কথা তখন দুই টাকা অনেক টাকা। কবি বললেন, আমার মা অসুস্থ তার জন্য ওষুধপত্র ফলমূল নিতে হবে। বাবা দুটি টাকা বের করে দিয়ে বললেন, কবি সাহেব এখনই বাড়ি যান। আপনার মায়ের জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করব। রাতে যখন বাবা চেম্বার বন্ধ করে এশার নামাজ পড়ে মেসে ফিরছিলেন তখন দেখেন কবি মাতাল অবস্থায় নর্দমায় পড়ে আছেন। বাবা এই ঘটনার কথা বলে আমাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।

ইংরেজ কবি চ্যাটারটেন্ডও কবিতা লেখার জন্য বাবার হাতে মার খেয়েছিলেন। তার বাবাও চাইতেন না ছেলে কবি হোক। মার খেয়েও কবিতা লিখেছিলেন। তখন চ্যাটারটেন্ডের বাবা বলেছিলেন, তোকে দিয়েই হবে।

s-hoque-3বাড়িতে ছেলে অথবা মেয়ে কবিতা লেখে সাহিত্য করে বাবা-মা তাদের উৎসাহিত করে এমন পরিবার এখন পাওয়া মুশকিল। বরং তাকে নিরুৎসাহিত করে বলে লিখে কী হবে, পড়াশোনা কর, একটা ক্যারিয়ার গড় ইত্যাদি। তার পরও যারা লেখে তারা হচ্ছে, সত্যিকারের সাহিত্য প্রেমী। এক সময় আমরা বিপ্লবীদের কথা শুনতাম, বিপ্লবের জন্য তারা প্রশিক্ষণ নেয়, নানা রকম চেষ্টা করে পরিবারের অজানেৱ, নানা রকম আখরাতে গিয়ে যোগ দেয় এবং শেষ পর্যন্ত বিপ্লবী হিসেবে তারা প্রতিষ্ঠা পায়, তাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। পরিবারে কবিদের অবস্থাও তেমনি।

আড্ডার বিষয় সাহিত্য কী এবং কেন। আমার কাছে সাহিত্য হচ্ছে সময়ের কাছে লেখা প্রেম পত্র। এ লাভ লেটার টু টাইম। আমার লেখা মার্জিন মন্তব্য বইয়ে প্রথম অংশে এই কথাগুলো বলা হয়েছে। আমরা সময়ের কাছে গচ্ছিত রেখে যাই সাহিত্যের মাধ্যমে আমাদের ভাবনা, অভিজ্ঞতা, যন্ত্রণা, বেদনা, আনন্দ সমস্ত কিছু। আমরা মনে করছি শুধু আজকের দিনের পাঠকের জন্য লিখছি তা কিন্তু নয়। লেখা আজকের দিনের জন্য যেমন আগামী দিনের জন্যও তেমন। আজকের লেখা বহুবছর পর যদি কেউ পাঠ করেন তাহলে একটা সময়ের ছবি তিনি পাবেন। অনেক সময় আমরা বলে থাকি খাঁটি এবং তেজি সাহিত্য না হলে লেখা বেঁচে থাকবে না এটা কিন্তু ভুল। অনেক সময় নিম্নমানের একটি লেখাও অনেক শতাব্দী বেঁচে থাকে। আমরা প্রাচীন সাহিত্যের দিকে যদি তাকাই দেখব তখনকার সব সাহিত্যই কিন্তু শ্রেষ্ঠ রচনা। অনেক ভালো জিনিসের মৃত্যু হয় আবার অনেক তুচ্ছ জিনিস বহুকাল বেঁচে থাকে।

অনেকেই বিশ্লেষণ করে পেয়েছেন সহিদ থেকে সাহিত্য কথাটি এসেছে। মানুষের সহিদ, দশজনের সহিত। অর্থাৎ সাহিত্যে সান্নিধ্যের একটা ব্যাপার আছে। দশজনের সহিদ ভাগ করে নেয়ার একটা ব্যাপার আছে। আর কীভাবে সাহিত্য হচ্ছে সেটা অনেক দিক থেকে বলা যায় যেমন- একটি উপন্যাস সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম। সবচেয়ে বেশি পাঠক পড়ে। প্রকাশকদেরও উপন্যাসের দিকে চোখ থাকে। উপন্যাসে একদিক থেকে সব মিথ্যা কথা লেখা হয়। যে মানুষগুলোর কথা এবং যে ঘটনার কথা লেখা হয় তার একটাও ঘটেনি। তাই বলে কী এগুলো মিথ্যা, কাল্পনিক তা নয়। এটা হচ্ছে সম্ভবপরতা। হলে এই রকমই হতো। রাহাত খানের একটা লেখা আছে একশ টাকার নোট। টাকায় একজন নাম লিখে দিয়েছিলেন সেটা ঘুরতে ঘুরতে বহু ঘটনার জন্ম দেয়, তারপর শেষ হয়। চমৎকার একটি গল্প। এটি যে বাস্তবে ঘটেছে তা নয় কিন্তু ঘটলে এরকমই হতো। পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের কথাই বলি। উপন্যাসে ময়নার দ্বীপের হোসেন মিয়ার কথা বলা হয়েছে। সত্যিকার অর্থে কী ওই দ্বীপে হোসেন মিয়া বলে কেউ কি আছেন। কিন্তু উপন্যাসটি পড়ার পর মনে হয় এর চেয়ে সত্য বোধ হয় আর কিছুতে নেই। এটিই হচ্ছে সম্ভবপরতার একটা জায়গা। হলে এরকমই হতো। আমরা অনেক কিছু খুঁজে পাই যার উপর ব্যঞ্জনা আরোপ করি কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্ভবপরতা আমাদের টানে এবং মজিয়ে রাখে। আবার অসম্ভব কী কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে বলিব তুমি আছ আমি আছি। অনন্ত আমি মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে বলতে পারব কি না জানি না। মৃত্যুর মুখে হয়তো নিরব থাকব, অধিকাংশ মানুষ সৃষ্টিকর্তার নাম করবে। কিংবা একেবারেই বাকরুদ্ধ হয়ে যাবে।

হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে ঝলমল করে চিত্ত। আমাদের একেক সময় এমন হয় কিন্তু টের পাই না কিন্তু কোথা থেকে যেন হঠাৎ আলো এসে স্পর্শ করে। আসলে সাহিত্য এই কাজটি করে। হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে ঝলমল করে না হয় অশ্রুপাত হয় কিংবা আমাদের উদ্দীপ্ত করে অথবা আমাদের বিনীত করে। আমাদের দংশায়, আমাদের বাঁচায়। নানানভাবে সাহিত্য কাজ করে।

বিদ্রোহী কবিতার প্রথম চার লাইন যদি কেউ আবৃত্তি করে তবে তার কুঁজো হয়ে বসে থাকার কোনো উপায় নেই। একটু হলেও শির দাঁড় করে জেগে উঠবে। বলবীর উন্নত মম শির। এই লাইন পড়ার পর একটু হলেও সোজা হয়ে তাকাবে যে কেউ। আমরা দোলনার কথা সবাই জানি। কারো বাড়িতে দোলনা নেই। কেউ দোলনায় চড়েনি। দোলনায় প্রিয় মানুষকে নিয়ে চাঁদনী রাতে বসেছি এটা অনেকের কাছে কল্পনীয় কথা। যখন শুনি ‘সেদিন দুজনে দুলিছিনু বনে ফুলো ডোরে বাধা ছিল না’ তখন মনে হয়, হ্যাঁ এটা হলে মন্দ হতো না।

s-hoque-1আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে। সেই বনই বা কোথায় সেই রাত বা কোথায়। কিন্তু গানটি শুনলে মনটা নড়ে চড়ে উঠে, স্থির থাকে না। মার্জিন মন্তব্যের একটি জায়গায় বলেছি সাহিত্য আমাদের স্থানচ্যুতও করে। আমরা যে জায়গায় আছি সেখানে আর থাকি না। আমরা একটু বদলে যাই। একটু সংশোধিত হই, পরিমার্জিত হই, একটু নতুন সংস্করণ আমাদের মধ্যে জেগে উঠে। এটিই হচ্ছে সাহিত্যের কাজ ও উদ্দেশ্যে। যদি বলি এ যুগে ভিকটিম হয়েছে তাহলে বলতে হয় সত্যই হচ্ছে বেশি মাত্রায় নিহত। এবং বারবার নিহত হয়েছে। সত্যের শেষ আশ্রয় হচ্ছে সাহিত্য আর কোথাও নেই। না রাজনীতিতে, না সমাজ নীতিতে, না জীবন আচরণে। কোনো জায়গায় সত্য স্থির নয়। ক্রমশ খর্ব হচ্ছে, ক্রমশ কৃষ্ট হচ্ছে, বিস্মিত হচ্ছে, ক্রমশও দূরে সরে যাচ্ছি সত্য থেকে। শুধু সাহিত্যেই থেকে যাবে সত্যের পূর্ণ প্রকাশ।

সৈয়দ হকের মৃত্যুতে চ্যানেল আই কার্যালয়ে একটি শোক বই খোলা হয়েছিল। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এই শোক বইয়ে তাদের মন্তব্য লিখেছেন।

বিশিষ্ট নাট্যজন রামেন্দুমজুমদার লিখেছেন- “আজ সন্ধ্যায় বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি ভুবনের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রটির পতন হলো। সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হকের মৃত্যু নাই। তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে। হক ভাই আপনি যেখানেই থাকুন শানিৱতে থাকুন। জয় বাংলা।”

নাট্য ব্যক্তিত্ব আতাউর রহমান লিখেছেন- “আমার ব্যক্তি জীবনে অন্যতম প্রধান বেদনা আমার হক ভাইকে হারানো। তাঁর সর্বাধিক নাটকের আমি নির্দেশক। তাঁর সঙ্গে আমিও যেন আমার সত্তার অনেকখানি হারিয়েছি”

বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীর লিখেছেন “এই পরানের গহীণে ভিতরে তোমাকে দিয়েছি ঠাঁই, বাঙালির তুমি হে প্রিয় লেখক বাঙালি তোমার ভাই।”

বিশিষ্ট শিশুসাহিত্যিক আমীরুল ইসলাম লিখেছেন “কবির মৃত্যু নাই। হক ভাই আপনি জীবিতকালেই অমরত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন”।

বিশিষ্ট নাট্যজন আবুল হায়াত লিখেছেন- “হক ভাইকে আমি সব সময় মনে করতাম, এখনও করবো- তিনি যৌবনের প্রতীক। প্রাণ শক্তিতে ভরপুর একটি মানুষ। তাঁর প্রয়াণে ক্ষতি হলো- সাহিত্যের, নাটকের, তথা সমগ্র জাতির। অপূরণীয় ক্ষতি। হক ভাই আপনি অমর। আপনার মৃত্যু হয়নি। বেঁচে আছেন ও থাকবেন আমাদের মধ্যে- সর্বক্ষণ”।

বিশিষ্ট শিশু সাহিত্যিক রফিকুল হক দাদু ভাই লিখেছেন “হামার মরণ আছে, জীবনের মরণ নাই। আমার ‘ভাইজান’ সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক তাঁর লেখা নাটক ‘নূরলদ্দীনের সারাজীবন”-এ নূরলদ্দীনের মুখ থেকে বলিয়েছেন এ সংলাপটি। জীবনের শাশ্বত ও সত্যটি তিনি উচ্চারণ করেছেন অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে। তাঁর বেলাতেও একই কথা বলতে হয়। সব্যসাচী অভিধাটি তার জন্যে খুব ছোট বলে মনে হয় আমার কাছে। তাঁর বহুমুখী সৃষ্টির ব্যপ্তি ও গভীরতার মূল্যায়ন করা সহজ ব্যাপার নয়”।