Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

একটি সিনেমার গল্প বললেন আলমগীর!

রেজানুর রহমান: আমাদের মহানায়ক আলমগীর নিজেই গল্পটা বললেন। “একবার ঢাকার বাইরে শুটিং করতে গেছি। সরকারি ডাক বাংলোয় আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। ডাক বাংলো থেকে শুটিং স্পটের দূরত্ব কয়েক কিলোমিটার। গাড়িতে রওয়ানা দিয়েছি। কিন্তু গাড়ি সামনে এগুচ্ছে না। নায়ক আলমগীরকে একনজর দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে এসেছে সাধারণ মানুষ। তারা শুনেছে এই রাস্তা দিয়ে নায়ক যাবেন। তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। হাজার হাজার মানুষকে পাশ কাটিয়ে গাড়ি সামনের দিকে নেয়া যাবে না। অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত হলো পুলিশ প্রহরায় মানববন্ধন তৈরি করে নায়ককে হাঁটিয়ে নেয়া হবে শুটিং স্পটে। নায়ক গাড়ি থেকে নামলেন। সামনে পিছনে পুলিশ। মাঝখানে মানববন্ধনের ভেতর হেঁটে যাচ্ছিলেন নায়ক আলমগীর। অপেক্ষমাণ ভক্ত ও দর্শকের সেকি আনন্দ চিৎকার। ভিড় ঠেলে যখনই একটু দেখা যাচ্ছে নায়কের মুখ তখনই গগন বিদারী চিৎকার আর হাততালি। হঠাৎ এক অবাক করা ঘটনা ঘটলো। পুলিশের কড়া প্রহরা সত্তে¡ও খালি গায়ে এক বৃদ্ধ ঢুকে পড়লেন মানববন্ধনের মাঝখানে, একেবারে সরাসরি মহানায়ক আলমগীরের মুখোমুখি এসে নায়কের দুই গাল টিপে কিছু একটা দেখলেন এবং হঠাৎই অবাক হয়ে বললেন, আরে এটাতো মানুষ, নায়ক কোথায়…

সেদিন সেই বৃদ্ধ ঠিকই বলেছিলেন। তার সঙ্গে তো নায়কের দেখা হয়নি, দেখা হয়েছিল মহানায়কের সঙ্গে। আমাদের বাংলা সিনেমার জীবন্ত কিংবদন্তি মহানায়ক আলমগীর এ যাবৎ ২২৫টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। ৩ এপ্রিল আমাদের মহানায়ক পা দিয়েছেন ৭০ বছরে। এই সঙ্গে একটি আনন্দ বার্তাও ছড়িয়ে দিয়েছেন আমাদের চলচ্চিত্র পরিবারে। আর সেটা হলো নতুন একটি ছবি বানিয়েছেন তিনি। ছবির নাম ‘একটি সিনেমার গল্প’। আনন্দ আলোর সঙ্গে এক আড্ডায় সে কথাই বলছিলেনÑ “সিনেমার সঙ্গেই তো জীবনটা পার করে দিলাম। নানা কারণে এখন আর নিয়মিত সিনেমায় অভিনয় করা হয় না। হঠাৎ একদিন মনে হলো, এই যে আমরা সিনেমায় অভিনয় করি… আমাদেরও কিছু গল্প আছে। সিনেমার মানুষদের নিয়েও তো একটি ভালো সিনেমা হতে পারে। বেশ কিছুদিন গল্পটা মাথায় নিয়ে ঘুরলাম। যেখানেই যাই কাজে তেমন মনে বসে না। মাথার ভেতর শুধুই গল্প ভাবনা। একদিন গল্পের খসড়া দাঁড় করালাম। ইতোমধ্যে বোধকরি একটা বছর চলে গেছে। এবার সেই গল্পের চিত্রনাট্য তৈরি করলাম। সিনেমার নামও চ‚ড়ান্ত হলোÑ একটি সিনেমার গল্প। একদিন অফিসে গিয়েই হিসাব রক্ষককে ডাক দিলাম। তাকে বললাম ব্যবসার ক্ষতি না করে আমাকে কি কোটি খানেক টাকা দেয়া যাবে? হিসাব রক্ষক জানতে চাইলেনÑ কেন স্যার? এত টাকা দিয়ে কি করবেন? হাসতে হাসতে তাকে বললামÑ ধরেন বুড়িগঙ্গায় টাকাটা ফেলে দিব। হিসাব রক্ষক ঠিকই বুঝেছিলেন আমি টাকার কথা কেন বলছি। তবুও মুচকি হেসে জানতে চাইলেনÑ সিনেমা বানাবেন স্যার?

মৃদু হেসে বললামÑ হ্যাঁ, সিনেমা বানাব। ব্যস, ২১ বছর পর নতুন করে চলচ্চিত্র প্রযোজনায় নামলাম। আর ২০ বছর পর আবার শুরু হলো পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রে নতুন করে পথ চলা।

Cinemar-Golpoশুরুতে একটি সিনেমার গল্পে কলকাতার প্রসেনজিৎ-এর অভিনয়ের কথা ছিল। ভাবনাটা ছিল এটি যৌথ প্রযোজনার ছবি হবে। কিন্তু প্রসেনজিৎ সময় দিতে না পারলেও আমাদের মহানায়ক আলমগীর ছবির নির্মাণ কাজ শুরুর ব্যাপারে তার সিদ্ধান্তের এক চুলও নড়চড় করেননি। কলকাতার ঋতুপর্ণা আর আমাদের আরেফিন শুভ এবং চম্পাসহ অন্যদের সঙ্গে নিয়ে ‘একটি সিনেমার গল্প’ শুরু করলেন।

বাংলাদেশের এত অভিনেত্রী থাকতে ভারতের কলকাতার ঋতুপর্ণা কেন? এই প্রশ্ন করেছিলাম তাকে। তাৎক্ষণিক জবাব দিলেন এভাবেÑ চরিত্রের প্রয়োজনেই ঋতুপর্ণাকে ডেকেছি। অনেকে শুভ আর ঋতুপর্ণার বয়সের পার্থক্য নিয়ে কথা তুলেছেন। এক্ষেত্রে আমার বক্তব্য, ছবিটা দেখার পর আসলে বোঝা যাবে কেন ঋতুপর্ণার সঙ্গে শুভকে নেয়া হয়েছে। ‘একটি সিনেমার গল্প’ আসলে আমাদের সিনেমা পরিবারেরই গল্প। গল্পের ভেতর আরেকটি গল্প দেখতে পাবেন দর্শক। সিনেমা হলে গিয়ে ছবিটি দেখলেই বোঝা যাবে গল্পের রহস্যটা কি?

‘একটি সিনেমার গল্পের চিত্রনাট্য ও পরিচালনা সবকিছুই আলমগীর করেছেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন। তার বিপরীতে অভিনয় করেছেন দেশের গুণী অভিনেত্রী চম্পা। তবে এই ছবির একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলোÑ আন্তর্জাতিক খ্যাত কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লা একটি গানের নেতৃত্ব দিয়েছেন। রুনা লায়লার সংগীত পরিচালনায় গানটি গেয়েছেন আঁখি আলমগীর। অর্থাৎ একটি সিনেমার গল্প নির্মাণযজ্ঞে আলমগীরের পুরো পরিবার সময় দিয়েছেন। প্রসঙ্গ তুলতেই আমাদের মহানায়ক রুনা লায়লার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললেন, তাঁর মতো বিশ্বখ্যাত একজন সংগীত শিল্পী আমার ছবিতে সংগীত পরিচালনা করেছেন এজন্য আমি কৃতজ্ঞ।

Cinemar-Golpo-1কি আছে একটি সিনেমার গল্পে? দর্শক কেন হলে গিয়ে ছবিটি দেখবে? এমন প্রশ্নের জবাবে আলমগীর একটু ভেবে নিয়ে বললেন, হলে কেন দর্শক যাবে এটা বলতে পারব না। তবে এটা জোর দিয়ে বলতে পারি ‘একটি সিনেমার গল্প’ দর্শককে আকৃষ্ট করবে। এই ছবিতে সিনেমার ভেতরে সিনেমার গল্প আছে। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না। দর্শক হলে গিয়ে ছবিটা দেখলেই গল্পের রহস্য বুঝতে পারবে।

অনেকদিন পর আবার ছবি পরিচালনায় এলেন। এ ব্যাপারে কিছু বলুন?

প্রশ্ন করতেই মহানায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ আলমগীর একটু যেন ভাবলেন। তারপর বললেন,  আমি তো ভাই সিনেমার মানুষ। সিনেমা নিয়েই তো আমার ব্যস্ততা থাকার কথা। একটা সময় আমাদের সিনেমার চারপাশের পরিবেশ আমাকে দারুণভাবে আহত করে। তাই একটু দূরে দূরে ছিলাম। তবে নতুন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাহলো বছরে একটি হলেও ছবি বানাব এবং একটি হলেও ছবিতে অভিনয় করব।

আমাদের সিনেমা অঙ্গনের এই যে অস্থিরতার কথা বললেন তা কি দূর হয়েছে?

প্রশ্ন শুনে আলমগীর বললেন, না দূর হয়নি। বরং সমস্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। আমার ধারণা আমাদের সিনেমা জগতে এখন ‘আমি’র রাজত্ব চলছে। সবখানেই আমি আর আমি… আমি’র পরিবর্তে শব্দটি যতদিন ‘আমরা’ না হবে ততদিন আমাদের চলচ্চিত্রের প্রকৃত উন্নয়ন হবে না। একথা কে না জানে আমাদের চলচ্চিত্র জগৎ এক সময় কতটা রমরমা ছিল। তখনকার দিনে এই অঙ্গনের মানুষ একে অন্যকে দারুণ শ্রদ্ধা করতো, ¯েœহ করতো। চলচ্চিত্র অঙ্গন ছিল একটা পরিবারের মতো। রাজ্জাক ভাই, উজ্জ্বল ভাই, ফারুক, সোহেল রানা সহ আমরা একাধিক নায়ক দাপটের সঙ্গে সিনেমায় কাজ করেছি। এমনও দেখা গেছে, কক্সবাজারে শুটিং করতে গেছি। আমি একদিকে শুটিং করছি। রাজ্জাক ভাই অন্যদিকে শুটিং করছে। সন্ধ্যার পর শুটিং না থাকলে আমরা ঠিকই এক সঙ্গে আড্ডা দিতাম। কার ছবির কাজ কেমন হচ্ছে আলোচনা করতাম। আজকের দিনে তো একথা ভাবাই যায় না। চলচ্চিত্রে কলটাইম বলে একটা কথা আছে। এটা আমরা মানতাম। বর্তমান সময়ে ‘কলটাইম’ কেউই মানে না। এমনও শুনি পরিচালক সেটে এসে বসে থাকে অথচ অভিনেতা-অভিনেত্রীর দেখা নেই। বিশেষ করে নায়ক-নায়িকা সেটে উপস্থিত হয় তাদের মর্জি মাফিক। এভাবে তো একটা ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়াবে না। আমার নিজের কথা বলি। শুটিং থাকলে সকাল ৯টার মধ্যে সেটে উপস্থিত হই। রাত ৯টা পর্যন্ত কাজ করি। আমার একটা অভ্যাস আছে, দিনে কি কি কাজ করেছি রাতে বিছানায় শুয়ে তা স্মৃতির পর্দায় টেনে আনি। এক এক করে সব দেখি। যদি মনে হয় ওই কাজটা ভালো হয়নি। এভাবে করলে ভালো হতো… তাহলে পরের দিন সেটে গিয়ে কাজটা নতুন করে করার জন্য পরিচালককে অনুরোধ করি। এজন্য অনেকে অবাক হয়। তাদেরকে বুঝাই-ভাইরে, অভিনয়ও হলো এক ধরনের উপাসনা। কাজেই সেটা মন দিয়ে না করলে কাজের কাজ কিছুই হবে না।

Cinemar-Golpo-2৩ এপ্রিল ছিল মহানায়ক আলমগীরের ৭০ তম জন্মদিন। চ্যানেল আই-এর আলোচিত তারকা কথন অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এসেছিলেন। এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, আমাদের সিনেমা জগৎ নিয়ে নানা জনে নানা কথা  বলেন। আমি তাদের অনেকের কথার কোনো মানে খুঁজে পাই না। এই অঙ্গনটাতো আমাদের। কাজেই দূরে থেকে কথা বলছি কেন? দায়বদ্ধতা আর সৃষ্টির তাড়না থেকেই আবার সিনেমা প্রযোজনার কাজে ফিরলাম। এখন থেকে নিয়মিত অভিনয়ও করবো ভাবছি। আমি চাই অন্যরাও চলচ্চিত্রে ফিরে আসুক। আমরা হয়তো চলচ্চিত্রের বর্তমান সমস্যার আমুল পরিবর্তন ঘটাতে পারব না। কিন্তু পরিবর্তনের সূচনাতো করতে পারব। কথায় আছে, বিড়ালের গলায় ঘণ্টি বাঁধবে কে? আমিই বাঁধলাম। এবার দেখতে চাই চলচ্চিত্রকে ভালোবেসে কে কতটুকু দায়িত্ব পালন করে। চলচ্চিত্রের জয় হোক।