Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আহ্ আফ্রিকা! বাহ আফ্রিকা! (২য় কিস্তি)

এবারের সফরে আমাদের সঙ্গে আরও দুই বন্ধু যুক্ত হলো। জায়া-পতি ডাক্তার রিতা ও ইঞ্জিনিয়ার রিপন। দুই সফল কন্যার মাতা-পিতা রিতা ও রিপন ২৫ বছর ধরে জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকাতে বসবাস করছে। তাদের সঙ্গেই লিভিংস্টোনে যাত্রা। সেখানেই রয়েছে সিংহ বাড়ি আর পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম জলপ্রপাত, ভিক্টোরিয়া ফলস্।
যাত্রা পথে রিপনের গাড়িতে বাঙলা গানে সকলেই যেনো একটু নস্টালজিক হয়ে গেলাম। …‘একবার যেতে দেনা আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’…।
বাংলাদেশের ছোট্ট সোনার গাঁ থেকে এসে জাম্বিয়াতে পঁচিশ বছর ধরে বসবাসরত সফল ব্যবসায়ী রিপন আমাদেরকে জানালো জাম্বিয়া সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য। আফ্রিকা মহাদেশে মোট দেশ রয়েছে ৫৪টি। তার মধ্যে জাম্বিয়ার আয়তন ৭,৫২, ৬১৮ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যা ১ কোটি ৬৫ লক্ষ প্রায়। মাথাপিছু আয় ১ ,৩৪২ মার্কিন ডলার। মূল অর্থ উপার্জনের উৎস কপার রপ্তানী। এবার কিশোর-কিশোরীর কথা জানতে চাইলে ডাক্তার রিতা বলেন, মূল জনসংখ্যা প্রায় ২৫ শতাংশ হলো কিশোর-কিশোরী। মাতৃমৃত্য হার লাখে এখন প্রায় ৪৭০ জন। এর অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি দায়ী করতে চান সময়ের আগে গর্ভধারণকে যা কিনা এখন জাম্বিয়া সহ পুরো আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশেরই সবচাইতে বড় সমস্যা। পুষ্টি বিজ্ঞানী ডা. জিয়া হায়দার বললেন, ‘এ কারণেই ২০১৫ সালে স্বর্ণ-কিশোরী আদলে বিশ^ব্যাংকের সহায়তায় কনসার্ন ওয়ার্ল্ড-ওয়াইডের পরিচালনায় কাওমা এবং লিমোলুঙ্গা এই দুটো জেলার ১০টি ওয়ার্ডে ২৪৯টি কিশোর-কিশোরী সুরক্ষা ক্লাব নির্মিত হয়েছে। ‘স্বর্ণ-কিশোরী’ শব্দটিকে আফ্রিকান ভাষায় বলা হয় ‘মাচুয়ে-মাসিজানা’।’
২ লক্ষ ৪৫ হাজার মার্কিন ডলারের ২৪৯টি কিশোর-কিশোরী সুরক্ষা ক্লাব প্রকল্প ২০১৫ সালে শুরু হলেও ২০১৮ সাল থেকে এ প্রকল্প স্বর্ণ-কিশোরীর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে একত্রিত হয়ে গেল।
লিভিংস্টোনের পথে এগুচ্ছিলাম। ডানে বায়ে ফসলহীন জমি আর জমি। জীবনে প্রথমবারের মতো আফ্রিকা মহাদেশে পা রেখে অনুভব করলাম পৃথিবীর অন্যান্য ভূ-খন্ডের তুলনায় এটি বেশ ভিন্ন। আকাশ একটু বেশীই নীল। আর বৃক্ষগুলোর মাথায় যেনো পাতার জোয়ার। ঝাঁকড়া পাতায় পুষ্টকান্ড নিয়ে প্রতিটি গাছ যেনো দৃঢ় যৌবনপ্রাপ্ত। বেশ কিছু গাছকে পরিচিত মনে হচ্ছে। আবার কিছু কিছু গাছের আকৃতি ও আকার যেনো একেবারেই অদেখা কিছু।
লিভিংস্টোনে ঢোকার আগেই দূর থেকে জলপ্রপাতের কুয়াশা পরিলক্ষিত হলো। গাড়ি থেকে নেমে সকলেই তা মন ভরে দেখলাম। সবাই যখন স্থির দৃষ্টিতে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে তখন আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম জাম্বেজি নদীর ঢেউটা যেনো একটু ভিন্ন। ঘন শ্যামবরণ পানির শক্তি এবং গভীরতা দেখেই টের পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি পানির ¯্রােত ঢেউয়ের মতো ওপর-নিচ না হয়ে শক্তি প্রয়োগ করে ধাক্কা দিয়ে ছলকে উঠে এগিয়ে চলেছে। সাধারণ নদী দেখলে মনে হয় সাধারণ জন¯্রােতের মতো, যারা হেঁটে হেঁটে এগিয়ে চলেছে। আর জাম্বেজী নদীকে তুলনা করা যায় মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশপানে ছুঁড়ে মিছিলে মেতে ওঠা অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এগিয়ে চলা কোনো অদম্য শক্তিশালী জন¯্রােতের সাথে।
লিভিংস্টোনে ঢুকেই নির্ধারিত থাকার জায়গায় আমরা প্রবেশ করলাম যার নাম ছিল কাজমেইন লজ। সেখানেও বাড়িগুলো একটু দূরে দূরে। বাড়িগুলো দোতলা হওয়ার কারণে নিচের তলায় একজন আর উপরতলায় একজন বসবাসের সুযোগ রয়েছে। তাই মুকাম্বি লজের মতো সম্পূর্ণভাবে জনবিচ্ছিন্ন হবার আশংকা থেকে বাঁচা গেল। তবে লক্ষ্যণীয় যে এই লজেও কোনো মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করে না। নেই কোনো ওয়াই-ফাই। তাই বন্ধু ও পরিজনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার দীর্ঘ সময়ের অভ্যস্ততা থেকে কিছুটা ছিটকে পড়ে মন্দ লাগার চেয়ে ভালো লাগার পরিমাণটাই বেশি অনুভব করলাম। বহুদিন পর নিজের সঙ্গে নিজের কিছু কথাও হলো।
বাড়ির পাশেই ইমু পাখি, ময়ূর, হাঁস আর জেব্রা দম্পতি, বেশ স্বাভাবিকভাবেই বিচরণ করছিল যেনো এটাই তাদের বাড়ি।
আবারও নিয়ম শেখার পালা। কিছুতেই জেব্রার পেছনে গিয়ে দাঁড়ানো যাবে না। তাতে যেই হোক না কেনো জেব্রার পায়ের তীব্র লাথি খাওয়ার সম্ভাবনা তার নিরানব্বই শতাংশ।
কৃষ্ণকায় এক বান্ধবী জুটে গেল আমার। নাম তার ভেরোনিকা। এত সুন্দর ঝকঝকে হাসি আর কবে দেখেছি মনে পড়ে না। দোহারা গড়নের শরীর জুড়ে তার শক্তির সৌন্দর্য্য প্রতিফলিত হচ্ছে। হাঁটা, চলা, হাত নাড়ানো এবং হাসিতে অফূরন্ত জীবনী শক্তির আভাস স্পষ্ট। ক্লান্তিহীনভাবে দৌড়ে দৌড়ে চারটি রুমে আমাদেরকে পৌঁছে দিল ভেরোনিকা। আলাপের শুরুতেই আমাকে প্রশ্ন করলো তুমি কি টেলিভিশন কিংবা সিনেমার কোনো তারকা? এমন প্রশ্নের জন্যে আমি প্রস্তুত ছিলাম না। হ্যাঁ, আমি টেলিভিশনে কাজ করি বটে। তবে আমাকে ঠিক তারকা বলা যায় কিনা তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। উপস্থাপক আসলে দূর আকাশের কোনো চক চকে তারকা নয় যাকে শুধু দূর থেকেই দেখতে হয়। বরং, তাকে আকাশের চাঁদ বলা যেতে পারে যে কিনা অন্ধকার রাতে সূর্যের অনুপস্থিতিতে সূর্য থেকে আলো নিয়ে পৃথিবীকে আলোকিত করার চেষ্টা করে। অথবা চির পরিচিত বোন কিংবা ভাই যার সঙ্গে মন খুলে প্রায় সব কথাই বলা যায়।
দুপুরের খাবার প্রস্তুত। পাঁচজন খাবার নিয়ে বসতেই আরও একজন এসে হাজির। তার নাম ইমু পাখি। ত্রিভুজ আকৃতির পাউরুটির একটি কোণ তার সামনে ধরতেই ঠোকর মেরে তা খেয়ে নিল সে। আমার মনে হয়েছিল রুটির সঙ্গে আমার আঙ্গুলটিও খেয়ে নিলো কিনা। কিন্তু ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম আমার অতিপ্রিয় হাতের আঙ্গুলটি আমার হাতের সঙ্গে ঠিকঠাকভাবেই যুক্ত আছে।
এবারে সেই কাক্সিক্ষত ক্ষণ, সিংহ বাড়ি গমন।
সিংহ বাড়িতে ঢুকতেই আমার হাতে স্বাক্ষরের জন্য একটি কাগজ ধরিয়ে দেয়া হলো যাতে লেখা ছিল সিংহ আমার ঘাড় মটকে খেলেও এ দায়ভার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বহন করবে না। আফ্রিকা এসে সিংহকে জড়িয়ে ধরার যখন সুযোগ একটি পাওয়াই গেছে তখন সে সুযোগ কাজে না লাগিয়ে বাড়ি ফিরে যাবো সেই বান্দা আমি নই। তাই খস খস করে কাগজে দিলাম সই করে। চার বন্ধু অপেক্ষায় থাকলো আমার। আমি চললাম সিংহ বাড়িতে।
একটি ঢাল পেরিয়ে কিছুটা বনভূমির মধ্যে প্রবেশ করলাম। আমার সঙ্গে রয়েছে এখানকার সিংহের বন্ধু মানুষ ‘মুন্ডা’। মুন্ডাকে অনুসরণ করে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে লালমাটির পথ বেশ কিছুটা পাড়ি দিতেই ক্লান্ত এবং তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়লাম। কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে পথের পাশে বয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক ঝরনার পানি হাতের আজলে নিয়ে পান করলাম এবং কিছুটা মুখে ছিটালাম। মুন্ডাকে বললাম, ‘তুমি পানি খাবে?’ তখনি হঠাৎ লক্ষ্য করলাম মুন্ডার ডান হাতের তালুর এক অংশ নেই। অনেক ইনিয়ে-বিনিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে প্রশ্নটা তার সামনে রাখলাম, ‘ তোমার হাতে কী হয়েছিল?’ আমার দৃঢ় বিশ^াস সিংহ-ই তাকে কামড় হাত অর্ধেক খেয়ে নিয়েছে। কিন্তু সে সেকথা কিছুতেই স্বীকার করলো না। বরং ছোট্ট করে বললো, ‘অ্যাকসিডেন্ট’। নিজের হাত জোড়া আমার খুব প্রিয়। ভালো করে দেখলাম সৃষ্টিকর্তা অসাধারণ সুন্দর করে বানিয়েছেন আমার হাত জোড়া। চুমু খেলাম নিজের হাতে। প্রতিটি আঙ্গুলে চুমু খেলাম। তারপর আবার হাঁটা শুরু হলো।
কিছুটা পথ পেরিয়ে দেখা পেলাম সিংহ দম্পতি মনা এবং মাইলোর। গাছের নিচে বেশ আয়েসী ভঙ্গিতে বসে আছে এই সিংহ দম্পতি। আমরা পৌঁছেই দেখলাম জলপাই এবং খাকি রঙের পোষাক পড়া আরও তিনজন সুঠামদেহী গাইড সেখানে উপস্থিত। নিজের পোষাকের দিকে তাকিয়ে কিছুটা আঁতকে উঠলাম। গাঢ় নীল আর সাদা এই পোষাকে জেব্রা বলে আমাকে ভুল করার সম্ভাবনা থাকতেও পারে। তিনজন দেহরক্ষী হওয়ার বিশেষ কারণ রয়েছে। দুজন দুজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে রাখে। আর একজন সহযোগীতা করে সিংহের কাছাকাছি যাবার জন্য।
প্রথমে আমাকে সেখানে হলো কামড় দিতে নিলেই তার মুখে লাঠি পুরে দিতে হবে এবং মাথায় খুব সজোড়ে হাত রাখা যাবে না। মেয়ে সিংহটিকে জড়িয়ে না ধরাই ভালো। তবে ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরা যেতে পারে।
সবকিছু শিখে নিয়ে আমি সিংহী মনার কাছে গিয়ে প্রথমে বসলাম। সে আমার চোখে চোখ রাখলো, লাঠিটি দেখলো। তারপর সামনে গাইডের দিকে মুখ ফেরালো। এর অর্থ হলো, সে আমাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছে। গাইড আমাকে লাঠিটি রেখে দিয়ে আরাম করে তার সঙ্গে বসতে বললো। আমিও তার গায়ে হাত বুলিয়ে বললাম, ‘তুমি খুব সুন্দর মনা।’ লেজ নাড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমার হাতে বারি দিল যেস। যেনো কথাটি শুনে কিছুটা লজ্জা পেয়ে বললো, ‘যাহ্।’
Farjana-brownia1মনার সঙ্গে কথা শেষে চলে এলাম মনার পুরুষ সঙ্গী মাইলোর কাছে। সে যেনো আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল কোনো অতিথি আসবে আজ। মনা যতটা শান্ত মাইলো ততটাই চঞ্চল। আমি তাকে আদর করার সময় সে বার বার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিল যে কে তাকে আদর করে। মাইলোর সঙ্গেও আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। মাইলো বলে ডাকতেই সে ঘাড় ঘুরিয়ে দ্যাখে আমায়। আফ্রিকান ভাষায় মাইলো শব্দের অর্থ হলো আগামীকাল বা আগামী। যদিও সিংহের মাথায় হাত রাখা নিষেধ। তবুও বন্ধুত্বের দাবিতে হাত রাখতেই সে যেনো পোষ মেনে গেল। চোখ বন্ধ করে মাথা নিচু করে আদর নিলো। কেশরের নিচে কাঁধের কাছে একটু সুড়সুড়ি দিতেই আমার মনে হলো সে যেনো হেসে দিল। অবশেষে আমি আর সে দুজনেই যখন আরাম করে বসে আছি তখন একটি চোঙা দিয়ে সিংহের কানে ‘কুক’ শব্দ করতেই সে কামড়ে ধরে লাঠি।
এমনি খেলায় খেলায় যখন সূর্য পশ্চিমাকাশে লাল রঙ ধারণ করে ঢলে পড়ে তখন হয় আমার বিদায় বেলা। মাইলো-মনাকে খুনসুঁটিতে মেতে উঠে নিজের বাড়ির পথে রওনা দিলো। আমিও তাদের স্মৃতি নিয়ে ফিরে এলাম আমার চার বন্ধুর কাছে। ডাক্তার রিতা পিতলের তৈরী পশুর মুখ সম্বলিত একটি মালা পরিয়ে আমাকে নব-জীবনে বরণ করে নিল। অক্ষত অবস্থায় অবশেষে বেঁচে ফিরলাম তাহলে!
নব-জীবনকে অভিবাদন জানাতেই পাঁচ বন্ধু মিলে যাত্রা করলাম পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম জলপ্রপাত ভিক্টোরিয়া ফলের দিকে।
আবারও নিয়ম শেখার পালা। বেবুনের সাম্রাজ্য জলপ্রপাতের চারপাশ। মানুষ এবং বেবুন দুজন দুজনকে সহজভাবে মেনে নিয়ে সহ অবস্থান করছে লিভিংস্টোনে। লিভিংস্টোনে ঢুকতেই দেখলাম এক সাদা মহিলা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন একটি বেবুনের দিকে যে কিনা কিছুক্ষণ আগেই তার হ্যান্ডব্যাগটি কেড়ে নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে বসে সেখান থেকে লিপস্টিক বের করে ঠোঁটে মাখছে। এমন অবস্থা আমাদেরও হতে পারে আশংকায় গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র গাড়িতে রেখে ব্যাগটা বুকের সাথে মোটামুটি চেপে ধরে জলপ্রপাতের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। শুরুতেই মিস্টার লিভিংস্টোনের মাঝারি সাইজের একটি মূর্তি বানানো রয়েছে। তা থেকে কিছুটা সামনে যেতেই আমাদের বিস্ময়ের সীমা রইলো না। ঝমঝম করে এতো দৃঢ়ভাবে জলের পতন ঘটতে পারে এবং তার যে ছন্দময় দৃঢ় সুর তা আমাদের মোহাবিষ্ট করে ফেললো। ডাক্তার রিতা বহুবার এ জলপ্রপাত দেখেছেন। তাই তিনি প্রায় টেনেই আমাদেরকে সামনের দিকে নিয়ে গেলেন। জলপ্রপাতের পানির ঝাঁপটায় সম্পূর্ণ অবগাহন করার সম্ভাবনা শতভাগ বিধায় নির্দিষ্ট পোষাক এবং জুতো পরেই আমরা সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম।
বিশে^র দ্বিতীয় বৃহত্তম জলপ্রপাত হলো ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত। ১০৮ মিটার উঁচু এই জলপ্রপাতে গড়ে ৩৮,৪০০ কিউবিক ফিট পানি প্রবাহিত হয় প্রতি সেকেন্ডে। এর এলিভেশন হলো ৮৮৫ মিটার। চল্লিশ বছর পেরিয়ে জিয়ার, সুমনের এবং আমার তিনজনেরই ছিল এটি ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের প্রথম দর্শন। রেইনকোটের ভেতরে ক্যামেরা নিয়ে সুমন বিস্ময় ভরে ধারণ করছে ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের অপরূপ দৃশ্য। স্টিভ জবস্কে ধন্যবাদ এমন একটি ফোন আবিস্কার করার জন্যে যা গ্রাহকের মনের কথা বোঝে। প্রচন্ড পানির ঝাঁপটার মধ্যেও সগৌরবে কাজ করে চলেছে আমার আইফোনটি। ক্লিক, ক্লিক, ক্লিক।
সেলফি ক্লিকে হঠাৎ করেই আবিস্কার করলাম আমার মাথার পেছনে বিশাল এক রঙধনু। ক্যামেরা সরিয়ে গায়ে মেখে নিলাম রঙধনুর রঙ। চোখে, চুলে, হাতে খেলতে শুরু করলো রঙধনুর সাতটি রঙ। চল্লিশ বছরের প্রতিটি মানুষই হয়ে গেল চার বছরের শিশু। কণ্ঠ ছেড়ে ডাকতে লাগলাম একজন আরেকজনকে। একটা সাদা প্রজাপতি চোখের সামনে নাচতে নাচতে ছুটে যাচ্ছে সামনের দিকে। আমরাও পিছু নিলাম তার। পথ থেকে একটু ডানে ঘুরলেই কিছু সিঁড়ি পেরুলেই জলপ্রাপাতের সবচাইতে কাছে যাওয়া। অন্ধ ভালোবাসায় অবগাহন করলাম। ছিটকে আসা পানি ঠোঁটে এসে লাগতেই তা পান করে নিলাম। অপূর্ব মিষ্টি, সঠিক শীতল এই হালকা পানির স্বাদ আমাকে এক অনন্য স্বর্গীয় আনন্দের অনুভূতি দিল। পানির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কতক্ষণ নেচেছি মনে নেই।
ডাক্তার রিতার ডাকেই স্বর্গ থেকে মর্তে ফিরে এলাম আমরা। ঝুলন্ত সেতু পারি দেবার সময় আবারও রঙধনুতে অবগাহন। সেতুটি পার হবার সময় একবারও মনে হয়নি এখান থেকে পড়ে মরে যাবো। বরং, মনে হয়েছে এমনি এক শ্রেষ্ঠ মৃত্যুর প্রতীক্ষা করা যেতে পারে। প্রকৃতি থেকেই জন্ম। প্রকৃতিতেই শেষ। সামনেই আরও একটি ঝুলন্ত সেতু থেকে একটি মেয়ে পায়ে দড়ি বেঁধে ঝাঁপ দিল অনেক উঁচু থেকে। এর নাম বাঞ্জি-জাম্প। আমারও ভীষণ ইচ্ছে হলো সেই সেতুটির ওপর থেকে একবার ঝাঁপ দেই। কিন্তু তা করতে হলে আরও একটি রাত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু এ যাত্রায় তা সম্ভব হবে না। কারণ কাওমা জেলায় অপেক্ষা করছে আফ্রিকার প্রথম স্বর্ণ-কিশোরী ইমুনগানা। স্বর্ণ-কিশোরী সংগ্রামের আন্তর্জাতিক অঙ্গণে পা রাখার উদ্দেশ্যেইতো বিশ^ব্যাংকের নিমন্ত্রণে আমাদের আফ্রিকাতে আগমন। আর তাই আমার বাঞ্জি-জাম্পের তুমুল আগ্রহকে একপাশে সরিয়ে রেখে ফিরতি পথে হাঁটতে শুরু করলাম। পথে একটি সোনালী-হলুদ ফুল আমার দৃষ্টি কাড়লো। কাছে গেলাম ফুলটির। স্পর্শ করলাম তাকে। ঝরনার খুব কাছে ফুটে থাকা ফুলটির কাছে গিয়ে দেখলাম আরেকটি ফুল পাশে ঝরে পড়ে আছে। পড়ে থাকা ফুলটিকে তুলে নিয়ে কানে গুঁজে দিলাম। পৃথিবীতে কত সুন্দর সুন্দর ফুল ফোটে। কিছু তার সুঘ্রাণ ছড়িয়ে সৌন্দর্য্য দিয়ে পৃথিবীকে আনন্দময় করে তোলে। আর কিছু ফুল অবহেলায় অযতেœ অকালে ঝরে পড়ে। ঝরে পড়া ফুলটিকে তুলে নিতে নিতে মনেহলো পৃথিবীর সকল কিশোরী যাতেএই ঝরে পড়া সোনালী-হলুদ ফুলটির মতো অকালে ঝরে না পড়ে। সংগ্রামের সেই শপথ নিয়েই ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত থেকে ফিরে এলাম কাজমেইন লজ-এ।
বিকেলে জাম্বেজী নদীতে সূর্যাস্ত অবলোকন করতেই উঠে পড়লাম আফ্রিকান কুইন নামক জাহাজে। সূর্যাস্তের আগেই পাড়ে শুয়ে থাকা কুমির, সপরিবারে জলহস্তির খেলা অবলোকন করতে করতে আরও একটি চমৎকার লাল সূর্যকে জাম্বেজি নদীর মাঝে বিদায় জানালাম আমরা।
পাঁচতারা হোটেল আভানিতে নৈশভোজের নিমন্ত্রণ পেলাম। আফ্রিকান সঙ্গীতের সাথে আঞ্চলিক বিভিন্ন নতুন পানীয়ের সমারোহ। খাবার মেন্যুতে রয়েছে হরিণ, উটপাখি, কালো মুরগী, বুনো-হাঁস, বন-মহিষ, শুয়োপোকা ছাড়াও প্রচলিত গরু, মুরগি ইত্যাদি। হরিণের মাংস, বুনো-হাঁস, কালো মুরগি এবং বন-মহিষের অর্ডার হলো। সাথে আফ্রিকার প্রধান খাবার ‘শিমা’। ভূট্টা গুঁড়ো করে সিদ্ধ করে পিঠার মতো পরিবেশন করা হয়। যা একটু একট ু করে ভেঙে মুঠে নিয়ে গোল করে বিভিন্ন ‘কারী’-এর ঝোল বা ‘সস’-এ ভিজিয়ে খেতে হয়।
নৈশভোজ সম্পন্ন করলাম আয়েশের সঙ্গে। তারপর লজে ফিরে এসে নিঃশব্দ রাত্রি যাপনের পর আরও একটি সোনালী সূর্যোদয়ের দিন হলো শুরু। বিদায় জানাতে হলো বন্ধু রিতা ও রিপনকে। বিদায়ক্ষণে দেশ থেকে আনা লাল-সবুজ শাড়ি সহ আরও অন্যান্য উপহার রিতার হাতে তুলে দিতেই, রিতাও আমার হাতে লাল এবং সবুজ পাথরের মালা স্মৃতি উপহার হিসেবে তুলে দিল। সবুজ মালাটি গ্রীন ম্যালাকাইট আর লাল মালাটি রেড অ্যাগেট। দুটোই জাম্বিয়ার অত্যন্ত প্রসিদ্ধ পাথর।
আমি, জিয়া হায়দার এবং সুমন রওনা করলাম আমাদের মূল কর্মের স্থান কাওমা জেলার উদ্দেশে।
কাওমাতে পৌঁছুতেই আমাদের পরিচয় ঘটলো অপেক্ষারত আরও দুই বন্ধু, কাটেন্ডি কালেস আর রিচার্ড মোয়াপে-এর সঙ্গে।বিশ^ব্যাংকের শিক্ষানবীস নাথানও আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলো। এবারে দলের সদস্য সংখ্যা হলো ছয় জন।
গ্রামের পথে হেঁটে হেঁটে প্রথমেই পৌঁছে গেলাম কাওমার কিশোর-কিশোরী সুস্বাস্থ্য ক্লাবে। নেচে-গেয়ে স্বাগত জানালো আমাদেরকে ক্লাবের কিশোর-কিশোরী সদস্য। আঞ্চলিক নৃত্যের অপূর্ব ছন্দের সঙ্গে আমাদেরকেও তাল মিলিয়ে গাইতে হলো নাচতে হলো তাদের সঙ্গে। অবশেষে পরিদর্শনে পরিচিত হলাম কিশোরী রথির সঙ্গে যে কিনা মায়ের সঙ্গে মিলে বিশাল এক বাগান গড়ে তুলেছে এই ক্লাবের প্রত্যক্ষ সহযোগীতায়। নিজের জরায়ুর উর্বরতার প্রমাণ দিতে ১৩ বছর বয়সেই রথি এক সন্তানের মা। সংসার আগের চেয়ে স্বচ্ছল। নিজের বাগানের বেড়ে ওঠা সব্জি খেয়ে নিজের এবং সন্তানের পুষ্টি নিশ্চিত করার পর কিছু উপার্জনও হয় তার এগুলো বিক্রি করে।
বেশ কয়েকটি বাগান পরিদর্শনের পর ওয়ার্ড স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলাম আমরা। সেখানে দেখা হলো প্রায় ১১ থেকে ১৫ বছরের নয়জন কিশোরীর সঙ্গে যারা প্রত্যেকেই অন্তঃসত্ত¡া। তাদের মধ্যে ছিল দুজন বিবাহিত এবং যথাক্রমে তারা দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সন্তানের মা হতে চলেছে।
সামাজিক রীতি অনুযায়ী ‘ইনিসিয়েশন প্রসেস’ নামক যে ধারাটি প্রচলিত রয়েছে জাম্বিয়ার বিভিন্ন ক্ষুদ্র-নৃ গোষ্ঠীর মাঝে। সে ধারা অনুযায়ী মেয়েটি ঋতুবতী হবার পর পরই একটি ছেলেকে তৃপ্ত করার কৌশল শেখানোর নামে তাকে নির্দিষ্ট একটি প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। যে প্রশিক্ষণ শুধুমাত্র মৌখিকই নয়। বরং, কোনো কোনো ক্ষুদ্র-নৃ গোষ্ঠীতে শারীরিক অত্যাচারের মধ্য দিয়েও যেতে হয়।
এই ভূমির আইন অনুযায়ী কোনো মেয়ের সঙ্গে জোর পূর্বক কোনো ছেলে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলে ছেলেটিকে আইনের আওতায় নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। শুধুমাত্র একাধিক পুরুষ নির্যাতন করলেই তা শারীরিক নির্যাতন বা ধর্ষণ হিসেবে পরিগণিত হয়।
বিয়ের আগে অন্তঃসত্ত¡া হয়ে খুব অল্পবয়সে নিজের গর্ভের উর্বরতার প্রমাণ দিতে গিয়ে এই কন্যা শিশুদের যে শারীরিক, সামাজিক অত্যাচারের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তা তারা নিজেরাও ‘অত্যাচার’ হিসেবে মনে না করে বরং সামাজিক রীতি হিসেবেই মেনে নিয়েছে। নয়টি মেয়ে আমাদের সাথে চিৎকার করে বললো ঠিকই, ‘নো টিন-এইজ প্রেগন্যান্সি’। কিন্তু তা তারা কতটুকু বিশ^াস করলো সেটি নিয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে।
এই অন্ধকারেইতো জ¦ালতে হবে সোনার আলো। জিয়া, কাটেন্ডি, রিচার্ড তাদের পরিশ্রমের ফসল ২৪৯টি ক্লাব তুলে দিল স্বর্ণ-কিশোরীর হাতে। বাংলাদেশের পাঁচ হাজার ইউনিয়নে পাঁচ হাজার ক্লাবের সঙ্গে সংযুক্ত হলো আরও ২৪৯টি ক্লাব।
কাওমা জেলার মাচুয়ে-মুসিজানা হিসেবে নির্বাচিত হলো ইমুনগানা। স্বর্ণ-কিশোরীর সোনালী-নীল পোষাকে সাজলো সে। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললো, ‘আই ওয়ান্ট টু মেক দেম গুড গার্লস্, নট ব্যাড গার্লস্।’
আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি অতি সাধারণ মেয়ে সোনালী আর নীল রঙে বলীয়ানহয়ে নেতা হিসেবে যে আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে; সে আলো নিয়ে এ বছরের মাঝামাঝি তার দেখা হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের স্বর্ণ-কিশোরীর২০১৪ এবং ২০১৬ সালের চ্যাম্পিয়ন মনামী মেহনাজ এবং দীপ্তি চৌধুরীর সঙ্গে ইউরোপে অনুষ্ঠিতব্য পুষ্টি-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে।
সোনার আলোয় আসলেই আলোকিত হবে একদিন এই পৃথিবী। প্রতিটি কিশোরীই তার অপার সম্ভাবনাকে স্বার্থক করে স্পর্শ করবে বিজয়, গাইবে জীবনের জয়গান।