Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আর্কি গ্রাউন্ড নিয়ে তিন বন্ধুর স্বপ্ন

দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধ নিয়ে আধুনিক স্থাপত্য শিল্পে যারা দেশের জন্য কাজ করে চলেছেন, তাদের মধ্যে নবী নেওয়াজ খান শমিন, মো: জুবায়ের হাসান ও লুৎফুল্লাহিল মজিদ রিয়াজ অন্যতম। সকলেই ২০০৬ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগ থেকে পাস করেন। ২০১০ সালে তিন বন্ধু মিলে গড়ে তোলেন ‘আর্কি গ্রাউন্ড লিমিটেড নামের একটি আর্কিটেকচারাল কনসালটেন্সি ফার্ম। যা এখন এ দেশের প্রতিষ্ঠিত একটি স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান। আর্কি গ্রাউন্ডকে এই আস্থার জায়গায় আনার পেছনে রয়েছে এই তিন বন্ধুর নিরলস সংগ্রাম ও পরিশ্রম। এবার শাহ্ সিমেন্ট সুইট হোমে তিন বন্ধুকে নিয়েই প্রতিবেদন। লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক
দুই ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় স্থপতি নবী নেওয়াজ খান শমিন। তার গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলায়। কিন্তু তার বেড়ে ওঠা ঢাকায়। নবী নেওয়াজের বাবা মরহুম এ কে ডি নেওয়াজ মুহাম্মদ খান বিআইডবিøউটির একজন কর্মকর্তা ছিলেন। মা দিল আফলোজ খান গৃহিনী। স্কুল জীবন থেকে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। আঁকাআঁকির প্রতি ছিল তার প্রচন্ড নেশা। বই পড়া ছিল তার পছন্দের বিষয়। খেলাধুলায় পারদর্শী ছিলেন। তবে ছবি আঁকার ঝোকটা ছিল সবচাইতে বেশি। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। উদয়ন হাই স্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন ১৯৯৬ সালে। ১৯৯৮ সালে ঢাকা কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগে। স্ত্রী তাসনিয়া আজিজ ও এক কন্যা সুহায়মা নাজাফারিন খানকে নিয়েই তার সংসার।
স্থপতি মো: জুবায়ের হাসানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা সিরাজগঞ্জে। তার বাবা কে এম নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন এ্যাডভোকেট। মা জেসমিন সুলতানা গৃহিনী। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে হাসান মেঝ। জেডিপি হাইস্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন ১৯৯৫ সালে। ১৯৯৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগে। তার স্ত্রী তাহমিদা আফরোজও একজন স্থপতি। এই দম্পতি এক সন্তানের জনক-জননী। ছেলের নাম রাইফ হাসান আলভান।
তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট স্থপতি লুৎফুল্লাহিল মজিদ রিয়াজ। তার জন্ম চাঁদপুর শহরে। রিয়াজের বাবা শফিউদ্দিন আহমেদ পেশায় একজন ব্যবসায়ী। মা মনোয়ারা বেগম গৃহিনী। হাসান আলী সরকারি স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন ১৯৯৬ সালে। ১৯৯৮ সালে নটরডেম কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগে। রিয়াজের স্ত্রীর নাম খাদিজা রহমান তানচি। এই দম্পতি এক ছেলে সন্তানের জনক-জননী। ছেলের নাম নুসায়ের আল ওয়ারিদ।

নবী নেওয়াজ খান শমিন, মো: জুবায়ের হাসান ও লুৎফুল্লাহিল মজিদ রিয়াজ তিন বন্ধুই ২০০৬ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগ থেকে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। পাস করে বের হওয়ার পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে স্বনামধন্য স্থপতিদের অধীনে কাজ করার সুযোগ হয় তাদের। ২০১০ সালে তিন বন্ধু মিলে গড়ে তোলেন ‘আর্কিগ্রাউন্ড লিমিটেড’ নামের একটি আর্কিটেকচারাল ফার্র্ম।
লেক সার্কাস কলাবাগানে তারা খুব সুন্দর করে একটি অফিস সাজিয়েছেন। ইতোমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি দেশের নামকরা অফিস কমপ্লেক্স, কমার্শিয়াল টাওয়ার, ফ্যাক্টরি, ইউনিভার্সিটি, মসজিদ, স্কুল, কলেজ সহ অনেক দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার নকশা করেছে। তাদের উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছেÑ গাজীপুরে ভাওয়াল রিসোর্ট, চাঁদপুরে শাহাবুদ্দিন ফাউন্ডেশনের মসজিদ ও স্কুল কমপ্লেক্স, খুলনায় রামপাল ভ্যাকেশন হাউস, গাজীপুরে অ্যাম্বার ডেনিম লুমসেড ফ্যাক্টরি, বাড্ডায় ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস, ধানমন্ডিতে বেঙ্গল আর্ট সেন্টার, গাজীপুর মাওনায় এবিএসএস এর গ্রীণ ফ্যাক্টরি, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে প্রস্তাবিত ইউসিবিএল ব্যাংক এর বহুতল ভবন।
তারা এ সকল স্থাপনার পাশাপাশি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের ইন্টেরিয়র ডিজাইনও করেছেন। উল্লেখযোগ্য ইন্টেরিয়র ডিজাইনের মধ্যে রয়েছেÑ বিভিন্ন স্থানে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ইন্টেরিয়র, অ্যাম্বার স্টাইলের সবগুলো আউটলেটের ইন্টেরিয়র, বনানীতে বেঙ্গল সুইটস এর ইন্টেরিয়র, নারায়নগঞ্জে নীট কনসার্ন গ্রæপের বিভিন্ন অফিসের ইন্টেরিয়র ডিজাইন ইত্যাদি।
এছাড়া বর্তমানে বেশ কিছু নতুন প্রজেক্টের কাজ করছেন তারা। স্থাপনার কাজে তাদের রয়েছে অসম্ভব সাফল্য। প্রতিযোগিতামূলক কাজে অংশ নিয়ে তারা পুরস্কৃত হয়েছেন। যার ফলশ্রæতিতে তাদের সাফল্যের ঝুড়িতে জমা হয়েছে সেরা কর্মের স্বীকৃতি। তারা অসংখ্য অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। যার মধ্যে রয়েছেÑ বার্জার অ্যাওয়ার্ড, রেসিডেন্স ক্যাটাগরি ২০১৫, বার্জার অ্যাওয়ার্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাটাগরি ২০১৫, ২অ এশিয়া আর্কিটেকচার অ্যাওয়ার্ড কমার্শিয়াল ক্যাটাগরি ২০১৫, জে কে সিমেন্ট ফোকাস কান্ট্রি আর্কিটেক্ট অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড, ইন্ডয়া ২০১৬, আইএবি কমেন্ডেশন অ্যাওয়ার্ড ইনস্টিটিউশনাল ক্যাটাগরি ২০১৬, বার্জার ইয়ং আর্কিটেক্ট অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাটাগরি ২০১৭, আর্ক এশিয়া কমেন্ডেশন অ্যাওয়ার্ড, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাটাগরি ২০১৭, আইএবি এর স্পেশাল মেনসন অ্যাওয়ার্ড ইনস্টিটিউশনাল ক্যাটাগরি। এছাড়াও বিভিন্ন মেয়াদে ২অ এশিয়া আর্কিটেকচার অ্যাওয়ার্ডে পাবলিক প্রজেক্ট ক্যাটাগরি, ফিউচার প্রজেক্ট ক্যাটাগরিতে সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পেয়েছে।

আর্কিগ্রাউন্ড তাদের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ দেশে বিদেশে অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছে। সম্প্রতি তারা আগা খান অ্যাওয়ার্ড ফর আর্কিটেকচার এর জন্য মনোনীত হয়েছেন। দেশে বিদেশের ৩৮২টি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের সাথে প্রতিযোগিতা করে সংক্ষিপ্ত ২০টি প্রকল্পের তালিকায় নিজেদের স্থান করে নিয়েছেন, যা কিনা বিশ্বব্যাপী স্থাপত্য পেশা চর্চার ক্ষেত্রে অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ এক সম্মাননা। স্থাপনা বা ব্যক্তির পাশাপাশি এই সম্মাননা প্রকল্প, সম্প্রদায় এবং অংশীদারদেরকেও এই পুরস্কার দেয়া হয়। আগা খান ২০১৯ অ্যাওয়ার্ড সাইকেল এর সংক্ষিপ্ত তালিকায় থেকে আর্কিগ্রাউন্ড যেমন নিজেদেরকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের স্থাপত্য পেশার ভাবমূর্তিও বিশ্বব্যাপী গৌরববান্বিত ও উজ্জ্বল করেছে।
তারা বলেন, আমরা বিশ্বাস করি প্রকৃতির বুকে গাছ পালা, বৃক্ষরাজি জন্মানোর সময় ভৌগলিক অবস্থান, আবহাওয়া ও জলবায়ুর কারণে বিভিন্ন দেশের বা স্থানের গাছ পালার প্রকার ও গঠন যেমন বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। তেমনি প্রকৃিতর বুকে একটি স্থাপনা ও ঐ স্থানের ভৌগলিক অবস্থান, আবহাওয়া ও জলবায়ু, ইতিহাস ও সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত। আমরা চেষ্টা করছি আমাদের স্থাপনা গুলো যেন বাংলাদেশের আবহাওয়া, জলবায়ু, ইতিহাস ও সংস্কৃতি এবং স্থানীয় সহজলভ্য উপাদান গুলোকে সন্তুষ্ট করার পাশাপাশি সমসাময়িক বিশ্ব স্থাপত্যের আধুনিকতাকেও প্রতিনিধিত্ব করে। আর্কি গ্রাউন্ড এর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা যদি বলতে হয়, তাহলে বলবো আমরা আরো বড় পরিসরে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের জন্য কাজ করতে চাই এবং বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের স্থাপত্যকে আরো পরিচিত ও সমৃদ্ধ করতে চাই।