Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আর্কিটেক্টস স্বামী স্ত্রীর স্বপ্ন ভূবন

আধুনিক স্থাপত্য শৈলীর সমন্বয়ে স্থাপত্য শিল্পে যারা কাজ করে চলেছেন তাদের মধ্যে নিশাত আফরোজ ও সাকলায়েন বুলবুল অন্যতম। তারা স্বামী-স্ত্রী। দুজনই ২০০০ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্য বিষয়ে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৩ সালে স্বামী-স্ত্রী মিলে গড়ে তোলেন ‘আর্কিটেক্টস’ নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। ইতোমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার ডিজাইন করেছেন। সম্প্রতি স্থপতি নিশাত আফরোজ ও স্থপতি সাকলায়েন বুলবুল বার্জার অ্যাওয়ার্ড অব এক্সিলেন্স-২০১৭ এর ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাটাগরিতে ‘ইফাদ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’ প্রজেক্টের জন্য কমেন্ডশান অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। এবার শাহ সিমেন্ট সুইট হোমে স্বামী-স্ত্রী দুজনকে নিয়ে প্রতিবেদন লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক

আমার প্রতিটি কাজে প্রাধান্য পায় পরিবেশবান্ধব, এনার্জি এফিসিয়েন্ট এবং সাশ্রয়ী স্থাপনার চিন্তা। প্রকৃতির ছোঁয়া, আলো বাতাস এবং বিভিন্ন ঋতু বৈচিত্র্যের প্রকাশ পায় এমন ল্যান্ডস্ক্যাপের ডিজাইনই থাকে বিল্ডিং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। কমার্শিয়াল এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল বিল্ডিং যেন কাঠ খোট্টা না হয় তার জন্য কংক্রিট ও সবুজের সমাহার থাকে সমানে সমান। কথাগুলো বললেন, স্বনামধন্য স্থপতি নিশাত আফরোজ। চার ভাইবোনের মধ্যে নিশাত মেঝ। তার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জ জেলায়। কিন্তু তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। বাবার নাম হাবীব উদ্দিন আহমেদ। তিনি বেসরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। মা তাহমীনা হাবীব গৃহিণী। ছোটবেলা থেকে ছবি আঁকা আঁকির প্রতি ছিল তার ভীষণ নেশা। বই পড়া তার পছন্দের বিষয়ের একটি। নিজের ইচ্ছে থেকেই আর্কিটেক্ট হয়েছেন তিনি।

মোহাম্মদপুর কিশলয় গার্লস স্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন ১৯৮৯ সালে। ১৯৯১ সালে বদরুন্ননেসা কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগে। স্থপতি সাকলায়েন বুলবুলের গ্রামের বাড়ি বগুড়া জেলায়। কিন্তু তারও জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। বাবার নাম আব্দুর সবুর। তিনি সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। মাতার নাম সুরাইয়া বেগম। দুই ভাইয়ের মধ্যে স্থপতি সাকলায়েন বড়।

উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন ১৯৮৯ সালে। ১৯৯১ সালে নটর ডেম কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগে।

২০০০ সালে নিশাত আফরোজ ও সাকলায়েন বুলবুল দুজনেই ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। পাস করে বের হওয়ার পরপরই নিশাত যোগ দেন স্থপতি রফিক আজমের ফার্মে। আর সাকলায়েন যোগ দেন স্থপতি রাশেদুল হাসান ছবির ‘প্রতিবেশ’ নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্মে। স্থাপত্য র্চ্চার পাশাপাশি নিশাত আফরোজ শিক্ষকতা করতেন আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগে। ২০০৩ সালে স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে গড়ে তোলেন ‘আর্কিটেক্টস’ নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। ধানমন্ডিতে খুব সুন্দর একটি অফিস সাজিয়েছেন তারা। ইতোমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি দেশের নামকরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল বিল্ডিং, অফিস বিল্ডিং, কমার্শিয়াল টাওয়ার, ফ্যাক্টরীসহ অসংখ্য বিল্ডিংয়ের ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করেছেন। তাদের উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছেÑ তেজগাঁও এর ইফাদ হেড অফিস ও ইন্টেরিয়র, গাজীপুরের বিবিএস-এর হেড অফিস, ময়মনসিংহ ভালুকার রানার এর গাড়ি ফ্যাক্টরী, বনানীর ইয়েসটার হেড অফিস, সাভারের বার্জার-এর ইন্ডাস্ট্রিয়াল বিল্ডিং, ইস্কয়ার প্লাস্টিক ফ্যাক্টরী, তেজগাঁও সাত রাস্তার ইস্কয়ারের হেড অফিসের ইন্টেরিয়র, মদনপুরের গাড়ি সার্ভিস স্টোরসহ অসংখ্য বিল্ডিংয়ের ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র।

Shah-Cement-Proসম্প্রতি স্থপতি নিশাত আফরোজ ও স্থপতি সাকলায়েন বুলবুল বার্জার অ্যাওয়ার্ড অব এক্সিলেন্স ২০১৭ তে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাটাগরিতে, ‘ইফাদ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক’ প্রতিষ্ঠার জন্য কমেন্ডশান অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। যার নকশা প্রাণয়নের পিছনে রয়েছে তাদের সুদূর প্রসারি চিন্তা ভাবনা। ইফাদ অফিস ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক নামের মধ্য থেকেই চোখে ভেসে আসে সবুজের চাদরে ঢেকে থাকা সুবিশাল এক কারখানার যান্ত্রিক প্রতিচ্ছবি। মূলত বাস-ট্রাকের বিভিন্ন পার্টসের অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্টের ফাংশনকে পাশে রেখে প্রয়োজনীয় অফিস, হাঁটার জায়গা, গাড়ি চলাচলের রাস্তাসহ সবুজের সমারোহের এক বিশাল সমন্বয় যেখানে ঘটানো হয়েছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কটির নির্মাণশৈলীসহ এর পারিপার্শ্বিক উন্নয়ন যে ভাবে আছে নানাবিধ বৈচিত্র্যের সমারোহ, ঠিক তেমনিভাবে নকশা প্রণয়নে প্রতিটি প্রদক্ষেপে যেন স্থপতি বৃন্দের সুচিন্তিত গোছানো এক অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ। স্থপতি নিশাত আফরোজ ও স্থপতি সাকলায়েন বুলবুল স্থাপত্যের নান্দনিকতার ছোঁয়ায় গড়ে তোলেন অপূর্ব এই মাস্টার প্ল্যান। যার প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে অভিজ্ঞতার আলোকে পরিপক্বতার ছোঁয়া। প্রকল্পটির সাইট ধামরাইয়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ এক জায়গায়। সাইটের চার পাশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিশালতার মাঝে রয়েছে অসংখ্য ইটের কারখানা। গাছগাছালি পরিপূর্ণ এই সাইটটিতে সবুজের সমারোহের মাঝেই পার্কটির পরিকল্পনা দানা বাঁধতে থাকে স্থপতিদের চিন্তায়।

বাংলার প্রকৃতির মাঝে থেকে সংস্কৃতির সমন্বয় স্থপতিদের মাঝে তারা সিদ্ধান্তই নিয়ে নেন  গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী দো চালা বাড়ির প্রতিচ্ছবিকে তুলে আনবেন। কিন্তু অবশ্যই তা ভিন্ন আবহের মোড়কে। তারা মূল এ্যাসেম্বলী প্ল্যান্টের জন্য এক বিশেষ মডিউলের পরিকল্পনা করেন যা কি না ১২টি খÐে বিভক্ত। ১২টি খÐের প্রত্যেকেই একে অপরের সঙ্গে পাশাপাশি ভাবে আবদ্ধ কিন্তু চালাতে রিজলাইন পৃথক ভাবে বিন্যস্ত। ক্লায়েন্ট গ্রæপের চাহিদা মোতাবেক স্বল্প খরচের নির্মাণ উপকরণ দিয়ে ভাবনার গঠন এগুতে থাকে। মূল এ্যাসেম্বলী বিল্ডিংটিকে ছাদ এবং প্রতিটি পাশে স্টেইনলেস স্টিরে করোগেটেড শীট দ্বারা আবরণ দেয়া হয়। ১২টি খÐকে ভিন্ন রিজলাইনে থাকার কারণে স্থপতিরা বাঁকিয়ে দেন নির্দিষ্ট এ্যাঙ্গেলে দুপাশে। যার ফলে প্রতিটি খÐের মাঝেই দুদিকে কিছু পার্শ্ব ভাগ বেরিয়ে আসে। যেখানে আলোক সংবেদী বাঁশ দিয়ে বেষ্টনী দেয়া হয়। ফলশ্রæতিকে প্রাকৃতিক আলো ডিফিউসড আকারে ভিতরে প্রবেশ করে। আর ভেতরে তৈরি করে এক স্বপ্নীল পরিবেশের আবহ। যা বৃষ্টির দিন আর রোদেলা দিনে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এই এলাকাটি সাইক্লোনের জন্য সুপরিচিত হওয়ায় স্থপতিরা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বেশ কিছু পরিকল্পনা হাতে নেন। জানালাসহ টানাবাকে দেয়া বহিঃপার্শ্বগুলোতে তারা ডাবলগেøজড কাচ ব্যবহার করেন। ইটের ভাটা থেকে আসা ধুলার আস্তরণ যেন আলোর প্রবেশে ক্ষতির কারণ হয়ে না দাঁড়াতে পারে। তাই সতর্কতার সঙ্গে আলোক সংবেদি কাচগুলো স্থাপন করেন পার্শ্বগুলোতে, ছাদের তলদেশে। কারখানার মালিক পক্ষ থেকে শুরু করে শ্রমজীবীসহ দর্শনার্থীদের কথাও তারা ভেবেছেন। তাদের মন মানসিকতাসহ স্বাস্থ্যগত সুরক্ষার বিভিন্ন দিক উঠে আসে ডিজাইনের চিন্তাশীলতার মাঝে। বহিঃবিশ্বের কিছু কারখানা পরিভ্রমণের সময় স্থপতিবৃন্দ লক্ষ্য করেন যে কিছু স্থাপনাতে প্রাকৃতিক ভাবে আলো বাতাসের সঞ্চালন সঠিক ভাবে হয় না। যা স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর। এতে করে শ্রমজীবীদের ক্লান্তির উদ্রেক হওয়াটা যেন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া রুটিন মাফিক কর্মমুখর দিনের সফলতা নির্ভর করে সঠিক সময়ে সঠিক কাজের উপর। এজন্য কাজ এবং সময়ের পরিকল্পনার মাঝে সমন্বয় সাধনের প্রয়োজন অত্যধিক। যান্ত্রিক এক পরিবেশে ঠান্ডা মাথায় কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়াটা খুবই জরুরি সে ক্ষেত্রে। সে জন্য সঠিক ভাবে আলো বাতাসের সঞ্চালন না থাকাটা যেন পরিপূর্ণ ডিজাইনেরই অন্তরায়। স্থপতিরা তাই ছাদ এবং পার্শ্ব দেওয়ালের মধ্য দিয়ে আলো বাতাসের সঞ্চালনের জন্য একপাশে এক্সস্ট ফ্যানের মাধ্যমে বিশুদ্ধ বাতাসের সঞ্চালন সবসময়ই নিশ্চিত রাখা হয়। ছাদ এবং পার্শ্ববর্তী দেওয়ালে বসানো আলোক সংবেদী উপকরণের মাধ্যমে ডিফিউসড আলোর জন্য দিনের বেলাতে কোনো বাতি জ্বালাতে হয় না। সাস্টেইনেবল ডিজাইনের পাশাপাশি স্থপতিরা ভেতরগত পরিবেশের সঙ্গে বাহিরের পরিবেশের সমন্বয়ে গোপনীয়তাকেও গুরুত্ব দেন। ফলশ্রæতিতে শ্রমিক, দর্শনার্থীসহ সবার জন্যই এক আরামদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। মেজোনাইন লেভেল থেকে প্লিন্থ লেভেল আর হরিজন্টালিটির মধ্য দিয়ে ভার্টিক্যাল এক দারুণ স্কেল বিদ্যমান। যেখানে কর্মপরিবেশে সবাই একে অপরের সঙ্গে সাবলীলভাবে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে। কখনোই স্কেলের হারিয়ে যাওয়া অনুভ‚ত হয় না। ভেতরের প্রতিটি স্থাপত্য যেন সে ভাবেই বিন্যস্ত করা। এরই সঙ্গে ডিফিউসড আলোর সঙ্গে বিশুদ্ধ বাতাসের সঞ্চালন ভেতরের পরিবেশকে গড়ে তোলে একই সঙ্গে যেমন নান্দনিক ঠিক তেমনি ভাবে স্বাস্থ্যকর, আরামদায়ক এবং অবশ্যই সাশ্রয়ী করে। যেখানে ক্লান্তির ছোঁয়া ভুলে সবাই যেন পুনরায় কর্মোদ্যম ফিরে পায় বারে বারে।

সমগ্র মাস্টার প্ল্যানের ল্যান্ড স্ক্যাপিংয়ের নকশাতেও আছে অভিজ্ঞতার আলোকে সুনিপুণ হাতের ছোঁয়া। ল্যান্ড স্ক্যাপিং প্ল্যানিংয়ের জন্য দুই স্থপতি বেছে নেন সেই সমস্ত গাছগুলোতে যেগুলো সেই সাইটে অভিযোজনে সবচেয়ে পারদর্শী। এ ক্ষেত্রে সাইটের ভ‚মিগত রূপ, প্রকৃতি, গাছের ধরনের পাশাপাশি তারা গুরুত্ব দেন পার্শ্ববর্তী ফাংশনের সঙ্গে তার সমন্বয় সাধন। ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অবদান রাখবে সে সব গাছও রয়েছে।