Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আমিরের আমির খান হয়ে ওঠার গল্প

মামুনুর রহমান

তাঁর রয়েছে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি। মি: পারফেকশনিষ্ট হিসেবে পরিচিতি। বলিউডের চকলেট বয়। তিনি আমির খান। বলিউডের স্টেরিও টাইপ, নির্দিষ্ট রোমান্টিসিজম, কিংবা এ্যাকশনের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখেননি তিনি। ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে ভিন্নধর্মী সিনেমায় অভিনয় করাই তাঁর প্রধান পছন্দ। নিজেকে বার বার ভাঙা গড়া তার নেশা। সিনেমায় প্রযোজনা ও পরিবেশনাতেও একজন সিদ্ধ হস্ত ব্যবসায়ী বলা যায় তাকে। আমির খান সম্পর্কে এসব কথা হয়তো আপনার জানা আছে আগে থেকেই। তবে আমির খানের ছেলেবেলা থেকে আজকের পর্যায় পর্যন্ত আসার পথটা কিন্তু এতোটা মসৃণ ছিল না। যতটা আজ রয়েছে।
ছেলেবেলায় স্কুলের বেতন পরিশোধ না থাকায় প্রায়ই আমির সহ তাঁর ভাই বোনদের দাঁড় করিয়ে শাস্তি পেতে হয়েছে। স্কুলের গন্ডি পার হতে না হতেই ছাড়তে হয়েছিল লেখাপড়া। জীবনে কোনদিনই অভিনেতা হতে চাননি। চেয়েছিলেন ভালো কোন চাকুরী করবেন। কিন্তু লেখাপড়ার জায়গাটা ছুটে গেলে সে পথটাও বন্ধ হয়ে যায়। তবে আজ আমির খান বিশ্বসেরা অভিনেতা। কিভাবে এলেন সিনেমায়? সাদা কালো জীবনের রং গুলো কিভাবে পাল্টে রঙিন হলো? এসবই জানাবো এখন।
পুরো নাম আমি হোসেন খান। জন্ম হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। বান্দ্রাতে। বাবা তাহির হোসেন খান ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক। আমিরের মা জিনাত হোসেন খান একজন গৃহিনী। আফগানিস্তান থেকে এসেছিলেন আমিরের পূর্ব পুরুষেরা। ভারতের বিখ্যাত পরিচালক, প্রযোজক নাসির হোসেন এই একই পরিবারের সন্তান। তাঁর মায়ের দিক থেকে আবুল কালাম আজাদ তাদের পূর্ব পুরুষদের একজন। তরুণ আমির খানের লেখাপড়ার চেয়ে খেলাধুলায় আগ্রহ ছিল বেশি। হতে চেয়েছিলেন টেনিস খেলোয়াড়। মহারাষ্ট্র থেকে হয়েছিলেন স্টেট চ্যাম্পিয়ন। নিদারুন আর্থিক কষ্টের মধ্যেই কেটেছে আমির খানের বাল্যকাল। আমি নিশ্চিত এই লাইনটি পড়ে আপনি বিস্মিত হয়েছেন। যার বাবা একজন পরিচালক তার কেন আর্থিক সমস্যায় পড়তে হবে ভাবছেন! আমিরের বাবা পরিচালক ছিলেন ঠিকই কিন্তু ব্যবসায়িক দিক থেকে ছিলেন ঋণগ্রস্থ মানুষ। যে কারনেই শৈশবের আমির খানের জীবন অনেক না পাওয়ার কষ্টে জর্জড়িত। চোখের সামনে প্রিয় বাবা মানুষটির হেরে যাওয়া দেখতে দেখতে কলেজের লেখা পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন আমির খান। কি করবেন, কোথায় যাবেন নিশ্চিত করতে পারছিলেন না তিনি। কিন্তু একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তখনই, আর যাই করবেন সিনেমায় বা অভিনয়ে আসবেন না কখনোই। কিন্তু বাল্যবন্ধু আদিত্য ভট্টাচার্যের চাপে চলচ্চিত্রে পা বাড়ান আমির খান। আদিত্যের পরিবারটিও ছিল চলচ্চিত্রে সংযুক্ত পরিবার। কালজয়ী পরিচালক বিমল রায়ের নাতি আদিত্যের মাথায় সিনেমার পাগলামি ছিল ছেলে বেলা থেকেই। পুরান ঢাকার এই পরিচালকের গল্প শুনে শুনে বড় হওয়া আদিত্য ছেলে বেলাতেই ভালোবেসে ফেলেন রুপালী পর্দার দুনিয়াটিকে। নাছোড়বান্দা আদিত্য ভট্টাচার্যের চলচ্চিত্রে অনিচ্ছা সত্বেও কাজ করতে হয়েছিল আমির খানকে।


আমিরের বাবা মায়ের ঘোর আপত্তির জন্য ছবিটির স্যুটিং হয়েছিল গোপনে। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর শাবানা আজমির ব্যাপক প্রশংসা পায়। শাবানা আজমি নিজে গিয়ে বোঝানোর দায়িত্ব নেন আমিরের পরিবারকে। সক্ষম হয়েছিলেন শাবানা আজমী। চল্লিশ মিনিটের সেই সিনেমার নাম ছিল প্যারানয়া। একটি নির্বাক চলচ্চিত্র। প্রকাশ্যে এলেন আমিন খান। ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় প্যারানয়া।
আমির নিজের ভেতর থেকে শক্তি পান। যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তার উপর ভর করে স্বপ্ন বুনতে শুরু করেন। থিয়েটারে যুক্ত হলেন। থিয়েটারকে অভিনয় শেখার জায়গা মনে করে এক বছর যাবৎ শুধুই মঞ্চে অভিনয় করেছিলেন তিনি। কথায় আছে লেগে থাকলে সুযোগ আসবেই। হলোও তাই। সুযোগ এলো ফিল্মে কাজ করার। না না অভিনয়ে নয়। ক্যামেরার পেছনের মানুষ হিসেবে। চাচা নাসির হোসেনের সহকারি হিসেবে ক্যামেরা পেছনে দাঁড়িয়ে সিনেমার কাজ গুলো শিখতে শুরু করেন তিনি। ক্যামেরার পেছনের সেই সময়টিতে বেশ কিছু প্রামান্যচিত্রে কাজ করার সুযোগ হয় আমিরের। সৌভাগ্যক্রমে আমির অভিনীত সেসব প্রামান্যচিত্র নজর কাড়ে পরিচালক কেতন মেহতার। ভীষন ভালো লেগে যায় তাঁর। সুযোগ দিলেন আমির খানকে তাঁর হোলি সিনেমায় ছোট্ট একটি দৃশ্যে কাজ করার। এভাবে ছোট ছোট কাজ করতে থাকেন তিনি। কিন্তু পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র ধরা দিচ্ছিলো না আমিরের নাগালে। আবার আবির্ভাব ঘটে আমিরের বাল্য বন্ধু আদিত্যর। তবে এবার পূর্ণ দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নিয়ে। আদিত্য’র ‘রাখ’ (কয়লা) ছবির মাধ্যমে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু হলো নায়ক হিসেবে। ব্যাপক ব্যবসা সফল হয় রাখ। এরপর সুযোগ আসে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত তাক’ সিনেমায় কাজ করার। আমির খান ও জুহি চাওলার চমৎকার অভিনয় রসায়ন বলিউড ঢালিউড সহ দক্ষিণ এশিয়ায় প্রশংসিত হয় সব গুলো ক্যাটাগরিতে। এই সিনেমার পাপা ক্যাহতা হে বেটা নাম কারেগা গানের মাধ্যমে বাজিমাত করেন আমির। প্রথম ছবির পরপরই আমিরের চুক্তি হয় আরো নয়টি সিনেমার নায়ক হিসেবে। তারপর আর কখনোই পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আমির খানকে। কিন্তু বাবার ব্যর্থতার জন্য প্রায়ই স্যুটিং শেষে বা সিনেমার মুক্তির পর অনেক দিনই কাঁদতে দেখা গেছে গুণি এই শিল্পীকে। সব সময় আমির ভয় পেতেন কোন ভুলে যেন বাবার মতো ব্যর্থ না হয়ে যান এই ভেবে।
২০১৩ সালে আমির খানের শ্রেষ্ঠ অর্জন দেখা দেয় যখন টাইম ম্যাগাজিনে বিশ্বের একশ সেরা মানুষদের তালিকায় নাম ওঠে আমির খানের। প্রচার বিমুখ এই মানুষটির ঝুলিতে অসংখ্য পুরস্কার থাকলেও কখনোই কোন পুরস্কার গ্রহণ করতে যাননি তিনি। মিডিয়া জগতের বাইরেও আমির সচল রয়েছেন সমাজের নানা হিতকর কাজের সাথে। দেশ ছাপিয়ে আমির বিশ্বের কাছে একটা রোল মডেল। চীনের মানুষের প্রথম পছন্দ গৌতম বুদ্ধের জীবনীর পর আমির খানের জীবনী। শিশুদের জন্য ইউনিসেফের বিশেষ দূত হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন এই গুণী মানুষটি।