সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2001-2021 - আনন্দ আলো
সৈয়দ রুমা ফ্যাশন জগতের পরিচিত মুখ। রুমা যখন র্যাম্পে হাঁটেন তখন দর্শকের দৃষ্টি অন্যদিকে যাবে প্রশ্নই আসেনা। সুদর্শনা এই র্যাম্প মডেল এখন আর শুধু র্যাম্পে হাঁটার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। ব্যস্ত সময় পার করছেন মিডিয়ার অনেকগুলো শাখায়। সম্প্রতি আনন্দ আলোর সাথে কথা হয় রুমার। কথা প্রসঙ্গে বেরিয়ে আসে অনেক অজানা তথ্য। আলাপচারিতার চৌম্বক অংশ থাকছে পাঠকদের জন্য। লিখেছেন প্রীতি ওয়ারেছা
আনন্দ আলো: এতো কাজ থাকতে র্যাম্পে কেন?
সৈয়দ রুমা: র্যাম্পে কাজ করার ব্যাপারে আমার কোন ইচ্ছে ছিল না। ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হব কিংবা ল ইয়ার হব। ফ্যাশন সেক্টরে কাজ করার ব্যাপারে আমার বড় বোন রেশমার খুব শখ ছিল। পরিবারের বাঁধা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত সে তার শখ পূরণ করতে পেরেছিল। রেশমা বহুদিন র্যাম্পে কাজ করেছে। প্রায় চার বছর হলো র্যাম্প ছেড়ে এখন সে পুরোদস্তুর ফ্যাশন ডিজাইনার। রেশমার ফ্যাশন শো থাকলে আমি তার হাত ধরে সেই শো গুলোতে হাজির হয়ে যেতাম। তখন আমি খুবই ছোট। ওদের কাজ আমার একটুও পছন্দ হতো না। খালি হাঁটাহাঁটি করে। হাঁটাহাঁটির জন্য সারাদিন ধরে এতো পরিশ্রম! এটা কোন কথা হলো! একদমই ভালো লাগতো না। ধীরে ধীরে যখন বড় হতে থাকলাম অনেকেই আমাকে প্রস্তাব দিতে থাকলো রুমা তুমিও তো র্যাম্পে কাজ করতে পার। তখন আমি সেসব প্রস্তাব উড়িয়ে দিতাম। আমার পক্ষে এতো ধৈর্য্য নিয়ে কাজ করা সম্ভব না। আমার ফড়িংয়ের মত স্বভাব। স্হির হয়ে, ধৈর্য্য নিয়ে কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। একসময় সবাই আমার বড় বোনকে বলতে থাকলো আমাকে র্যাম্পে কাজ করানোর বিষয়ে। প্রস্তাব শুনে রেশমাতো খুব খুশি। আমাকে রাজি করিয়ে ফেলল। কোন কিছু ম্যানেজ করার ব্যাপারে রেশমা অসাধারণ ক্ষমতাবান। আমাদের চৌদ্দ গোষ্ঠীর মধ্যে কোন মেয়ে ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করেনি। প্রথম দিকে রেশমার বাইরে কাজ করার কথা শুনে আমি ভয়ে অস্হির হয়েছিলাম। আমি রেশমাকে বলতাম আপু এটা করতে যেও না। দাদী মারবে, মা বকা দেবে। অথচ রেশমা ঠিকই দাদীকে আর মাকে ম্যানেজ করে ফেলল। রেশমার কারণেই আমাকে নতুন করে আর স্ট্রাগল করতে হয়নি। পথটা রেশমাই পরিস্কার করে রেখেছিল। মূলত রেশমার কারণেই আজ আমি র্যাম্প মডেল। একটা দুইটা শো করতে করতে আমি একসময় র্যাম্পের প্রেমে পড়ে গেলাম। র্যাম্পের বিষয়টাই এমন একবার যে শুরু করে সে আর ছাড়তে পারে না। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মডেলরা র্যাম্পে কাজ করতে পারে। যদি এমন হতো সারাজীবন র্যাম্পে কাজ করা সম্ভব হতো তাহলে বোধ হয় আমি সারাজীবনই সেটা করতাম।
আনন্দ আলো: বড় বোনের কথা জানলাম। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের প্রসঙ্গে একটু জানতে চাই।
সৈয়দ রুমা: ওয়ারীতে আমাদের নিজেদের বাড়ি। আমরা যৌথ পরিবারে বাস করি। আমার বাবা মারা গেছেন। চাচারাও কেউ বেঁচে নেই। আমরা দুই বোন, এক ভাই। মা, ভাই-বোন, চাচী আর কাজিনরা মিলে আমাদের পরিবার। দাদা-দাদীর পূর্ব পুরুষ পাকিস্তানের ছিলেন। তাদের তখনকার অনেক আত্মীয় স্বজন পরবর্তীতে পাকিস্তানে ফিরে গেছেন। আমার দাদীর পরিবার যাননি। আমার বাবা চাচারা এই দেশেই মানুষ হয়েছেন। বিয়েও করেছেন এখানে। আমার নানার বাড়ি যশোর। এই প্রজন্মের আমরা পুরোদস্তুর বাঙালী। আমি বড় হয়েছি এটা জেনেই যে আমাদের পরিবার এখানে সেটেল। পরিবারের কেউ আমাদের কখনো আভাসও দেইনি যে আমাদের পূর্ব পুরুষ পাকিস্তানের তাই তাদের ফিরে যেতে হবে সেখানে। যদি আমি আমার দাদীকে বা বাবাকে বলতে শুনতাম তাদের পূর্ব পুরুষদের ভিটা সম্মন্ধে, যদি তাদের ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে কোন আগ্রহ থাকতো তাহলে আমাদের ভেতরেও একটা উৎসুক মনোভাব থাকতো। কিন্তু সেটা ঘটেনি আমাদের সাথে। কারণ আমাদের পরিবারের কেউ সেটা চায়নি। আমরা বাড়িতে বাংলাতেই কথা বলে থাকি তবে মাঝে মাঝে উর্দুতেও বলা হয়। পরিবারের মূল পেশা ব্যবসা। কেউই চাকরি করে না। আমি ছোটবেলা থেকেই দেখেছি আমাদের ঘরভরা মানুষ। খেলার প্রয়োজনেও বাইরের কারো সাথে মেশার দরকার পরেনি। আমরা কাজিনরা মিলে নিজেরাই একশ।
আনন্দ আলো: আপনার চেহারাটা টিপিক্যাল বাঙালী ঘরানার না, কিছুটা ওয়েস্টার্ন। বাবা নাকি মা কার মত হয়েছেন দেখতে?
সৈয়দ রুমা: আমাকে কেউ বলে বাবার মত, আবার কেউ বলে মায়ের মত দেখতে। আমার মনে হয় আমি মিক্সড্ লুক পেয়েছি। তবে আমার বোন আর ভাই পুরোটাই বাবার মত দেখতে।
আনন্দ আলো: র্যাম্পে কতদিন হলো কাজ করছেন?
সৈয়দ রুমা: আমি ২০০২ সাল থেকে র্যাম্পে কাজ করছি। রেশমার পীড়াপীড়িতে শুরু করেছিলাম। সেসময় আমি স্কুলে পড়তাম। মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম দুই একটা শো করেই বাদ দিয়ে দেব কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয়নি। র্যাম্পের পুরো পরিবেশটাই ছিল আমার পরিচিত। আমি বড়ই হয়েছি র্যাম্প মডেলদের কোলে কোলে। আমাকে তুপা আপু, টুম্পা আপু পিচ্চি বলে ডাকতো। এখনো ডাকে। সবাই এতো ভালোবাসে যে থেকেই গেলাম র্যাম্পে।
আনন্দ আলো: আপনি র্যাম্পে কাজ করার পাশাপাশি মিডিয়ার অনেকগুলো শাখায় কাজ করছেন। তবে কী শুধু র্যাম্প দিয়ে জীবন ধারণ সম্ভব নয়?
সৈয়দ রুমা: এখনকার প্রেক্ষিতে সম্ভব। একটা ব্যাপার হয় মিডিয়াতে সেটা হল কেউ একটা সেক্টরে কাজ করতে গিয়ে সফল হলে তার সামনে অনেকগুলো শাখা খুলে যায়। র্যাম্পে যারা কাজ করে তাদের ক্ষেত্রেও এই বিষয়টি ঘটে। র্যাম্প মডেলরা সবসময় ফোকাসডৃ থাকে বলে তাদের পাবলিসিটি অনেক বেশি। কাজের সুযোগ বেশি। র্যাম্পের বাইরে কাজ করাকে দোষের বলিনা। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত র্যাম্পে কাজ করা যায় এরপর কিন্তু তাকে নিজের জন্য একটা প্রতিষ্ঠিত জায়গা বের করতে হবে। সবদিক বিবেচনা করেই ক্যারিয়ার চিন্তা করে সবাই।
আনন্দ আলো: র্যাম্পে আপনার করা উল্লেখযোগ্য কাজ কোনগুলো?
সৈয়দ রুমা: অনেক অনেক শো আছে যেগুলো ভীষণ আনন্দ নিয়ে করেছি। ঠিক এই মুহূর্তে যেগুলো মনে পড়ছে তার মধ্যে আছে- ঢাকা ফ্যাশন উইক, বাটা স্পো, বিকেএমই, আড়ং ফ্যাশন উইক, নকিয়া শো, বিপিএল এর শো, মাহিন খানের ফ্যাশন শো, লাক্সের শো, গীতাঞ্জলী, ট্রিসিমি শো ইত্যাদি। অনেকগুলো নাম বাদ থেকে গেল। প্রচুর শো করেছি। এখন মনে হচ্ছে সবগুলো লিখে রাখা উচিত।
আনন্দ আলো: দেশের বাইরে কোথায় কোথায় কাজ করেছেনা?
সৈয়দ রুমা: বাইরের মডেলরা যেমন এখানে শো করতে আসছে তেমনি আমরাও দেশের বাইরে শো করার সুযোগ পাই। বাইরের শোগুলোর মধ্যে মনে পড়ছে ২০০৫ সালে ব্রাইডাল শো করতে গিয়েছিলাম করাচিতে, গতবছর শো করেছি জাপানে।
আনন্দ আলো: আপনার মধ্যে এমন কী স্বকীয়তা আছে যার কারণে সৈয়দ রুমা সবার চেয়ে আলাদা?
সৈয়দ রুমা: যারা শো দেখেন আসলে তারাই ভালো বলতে পারবেন তবে আমার মনে হয় আমার অ্যাটিচিউড আলাদা, চোখের এবং ঠোঁটের এক্সপ্রেশন অন্যদের চেয়ে কিছুটা হলেও আলাদা। র্যাম্পে হাঁটার ক্ষেত্রে একই কথা বলা যেতে পারে। হাঁটার স্টাইলটা আমি নিজে রপ্ত করেছি। আমি হাঁটলে আমার চুল অনেক বাম্পিং হয়। আর আমার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কাজ করে কনফিডেন্ট। র্যাম্পে হাঁটতে গেলে ভেবে নেই আমিই সেরা। সুতরাং সেক্ষেত্রে আমাকে তো আলাদা দেখাবেই।
আনন্দ আলো: আজ থেকে ১৫ বছর পর বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি কেমন হবে?
সৈয়দ রুমা: এখন যেমন চলছে সেই ধারাবাহিকতা যদি বজায় থাকে তবে ১৫ বছর পরে বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বলিউডকে ছাড়িয়ে যাবে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্হিতি স্হির থাকলে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির আরো উন্নতি হবে। তবে আমার প্রত্যাশা ১৫ বছর পরে হলিউডকেও ছাড়িয়ে যাক।
আনন্দ আলো: কেউ র্যাম্পে আসলে চাইলে তার কী যোগ্যতা থাকতে হয়?
সৈয়দ রুমা: সবার আগে কমিটমেন্ট ঠিক থাকতে হবে। র্যাম্প মডেলিং অনেকগুলো বিষয়ের মিশেল। ধৈর্য্যশক্তি থাকতে হবে, নিজের অবস্হান সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা থাকতে হবে, সিনিয়রদের প্রতি সম্মানবোধ থাকতে হবে। র্যাম্পে আসার আগেই বিবেচনা করা দরকার তিনি কোথায় পা রাখছেন, পুরো বিষয়টাকে তিনি নিজের ভেতরে আয়ত্ব করতে পারবেন কী না, মিডিয়ার মানুষদের সাথে চলাফেরা করতে সক্ষম কী না ইত্যাদি। আমরা র্যাম্প মডেলরা ছেলে মেয়ের বিভেদ দেখিনা। ভাই কিংবা বন্ধু হিসেবে একসাথে কাজ করি।
আনন্দ আলো: র্যাম্পের অনেকেই নাটক, সিনেমা করেছেন। আপনার কী তেমন ইচ্ছে আছে?
সৈয়দ রুমা: আগে অনেক সিনেমার অফার পেতাম। তখন র্যাম্পটাকেই সিরিয়াসলি নিয়েছি। তারপরে যখন র্যাম্পটাকে সামলিয়ে সিনেমা করার সময় বের করলাম তখন কোন না কোনভাবে সংযোগ ঘটেনি। আমার চাহিদার সাথে মেলেনি। ভবিষ্যতে মিলে গেলে অবশ্যই করবো। তবে গেম ও ইউটার্ন নামে দুটো সিনেমার আইটেম গানে অভিনয় করেছি। আর নাটক তো অনেকদিন ধরেই করছি। এই মুহূর্তে করছি ঘুন পোকা ও শেষ রাতের গল্প, ঘরে বাইরে, প্রতিবিম্ব নামের সিরিয়ালগুলো।
আনন্দ আলো: প্রেমে পরেছেন?
সৈয়দ রুমা: প্রেমে পরিনি বললে মিথ্যা কথা বলা হবে। পরেছি তবে হয়তো সিরিয়াসনেস ছিল না তাই সম্পর্কটা তৈরি হয়নি।
আনন্দ আলো: বিয়ে নিয়ে পরিকল্পনা কী?
সৈয়দ রুমা: অবশ্যই বিয়ে করতে চাই। ইচ্ছে আছে পারিবারিক পছন্দে বিয়ে করার। তবে পরিবারের প্রতি এই বিশ্বাসও আছে যদি আমি কখনো কাউকে পছন্দ করি তবে তারা সেটা মেনে নেবে। আর বিয়ের ক্ষেত্রে পছন্দ মিডিয়ার বাইরের ছেলে। যে আমার কাজকে এবং আমার পরিবারকে সম্মান করতে পারবে, আমিও যাকে মেনে নিতে পারব তেমন কাউকেই বিয়ে করতে চাই।
আনন্দ আলো: প্রিয় শখ কী?
সৈয়দ রুমা: ঘুরে বেড়ানো, শপিং করা, জুতার কালেকশন আর পছন্দ কুকুর পোষা। একসময় আমার বাসায় ১৬টা পোষা কুকুর ছিল। কাজের চাপে ওদের দেখভাল করতে পারতাম না। কাজ শেষে বাসায় ফেরার পরে ওরা আমাকে অভিযোগ করতো। চিল্লাতে থাকতো, আমার পিছু ছাড়তো না। বাড়িতে আমার মা যত্ন করতো কিন্তু ওদের সেটা পছন্দ হতো না। আর এদিকে আমি ওদের সময় দিতে পারতাম না। মজার ব্যাপার হল যিনি কুকুর পোষেন তিনি ওদের ভাষা বুঝতে পারেন। আমিও বুঝতাম। যত্নআত্মির চিন্তা করেই ওদের আমি আমার আত্মীয় স্বজনদেরকে দিয়ে দিয়েছি যাতে ওরা ভালো থাকে। আমার ব্যস্ততা কমলে আবারও কুকুর পুষতে চাই। একসময় আমার চারশর বেশি জুতার কালেকশন ছিল।
আনন্দ আলো: রুমা প্রসঙ্গে একটি তথ্য দিন যেটা আগে কেউ শোনেনি।
সৈয়দ রুমা: রুমার সবকিছু সবাই জানে। রুমা একেবারে ওপেন। রুমা ভীষণ কনফিডেন্ট যা করে সেটা বলার সাহস রাখে।