Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

অন্নপূর্ণা তুমি সুন্দরী : মুকিত মজুমদার বাবু

“সবুজ পাতার খামের ভেতর

হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে

কোন পাথারের ওপার থেকে

আনল ডেকে হেমন্তকে?

আনল ডেকে মটরশুঁটি,

খেসারি আর কলাই ফুলে

আনল ডেকে কুয়াশাকে

সাঁঝ সকালে নদীর কূলে।

বেলায় শিশির ভেজা

ওপর চলতে গিয়ে

হাল্কা মধুর শীতের ছোঁয়ায়

শরীর ওঠে শিরশিরিয়ে। …”

ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ।  প্রত্যেক ঋতুর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে গর্বিত হয় প্রত্যেক বাঙালি।  গ্রীষ্মে খরতাপ, বর্ষায় জল নুপূরের গান আর স্নিগ্ধ, নির্মল, মায়াবী শরৎ পেরিয়ে আসে শান্ত-সৌম্য হেমন্ত।  বাংলা বারো মাসের কার্তিক-অগ্রহায়ণ হেমন্তকাল।  হিম থেকে এসেছে হেমন্ত।  হেমন্ত আসা মানেই পায়ে পায়ে শীত নেমে আসা।  টুপটাপ শিশির ঝরে পড়ে দুর্বাঘাসের ডগায়।  সকালের সোনা রোদে শিশির বিন্দু যখন চকচক করে ওঠে সে এক অপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হয়।  নিশিতে চারদিকে মোহ বিস্তার করে শিউলি ফুলের মাতাল করা ঘ্রাণ।  সেই সাথে ফোটে কামিনী, গন্ধরাজ, মল্লিকা, হিমঝুরি, দেবকাঞ্চন, রাজ অশোক।  বিলে-ঝিলে হেসে ওঠে শাপলা, পদ্ম।

হেমন্ত লক্ষ্মী।  হেমন্ত অন্নদাত্রী।  কল্যাণদাত্রী জননী।  এই হেমন্তে মাঠজুড়ে সোনালি রঙের পাকা ধান মাথা দুলিয়ে খেলা করে বাতাসে।  হেমন্তের সে শিশির ভেজা বাতাস পেয়ে নেচে ওঠে কৃষকের মন।  খুশির জোয়ারে ভেসে যায় মনের উঠোন।  কণ্ঠে খেলে যায় চিরায়ত বাংলার সুরের ধারা।  শুরু হয় ধান কাটা।  গোছা গোছা ধান এক জায়গায় করে অাঁটি বাঁধা, গরু গাড়িতে করে বাড়ি আনা, ধান ঝরানো, ধুলো উড়ানো ইত্যাদি কাজে এ সময় ব্যস্ত থাকে কৃষক ও কৃষক বধূ।  গ্রামের ঘরে ঘরে শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব যা মূলত নবান্ন উৎসব নামে পরিচিত।  ‘নবান্ন’ শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’।  নতুন ধান কাটার পর সেই ধানের চাল দিয়ে প্রথম রান্না করে গ্রামবাসী, আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাসই নবান্ন উৎসব।  নতুন ধানের চালের সাথে দুধ-গুড় নবান্নের প্রধান উপকরণ।  এসব উপকরণ দিয়ে তৈরি হয় সুস্বাদু পিঠা-পায়েশ।  বাংলাদেশে প্রতিবছর পহেলা অগ্রহায়ণ নবান্ন উৎসব পালন করা হয়।  আবার কোথাও কোথাও এ উৎসব মাঘ মাসেও পালনের প্রথা রয়েছে।  নবান্ন উৎসবকে আরো প্রাণোজ্জ্বল করতে কোনো কোনো অঞ্চলে মেলা বসে।  আয়োজন করা হয় নাচ, গান, লাঠিখেলা, মোড়গ লড়াই, ঘোড়দৌড়, নৌকাবাইচ ইত্যাদির।  যদিও আজ বাংলার এই প্রাচীন ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।

শরত আর হেমন্তের আকাশের ভেতর তেমন একটা পার্থক্য দেখা যায় না।  কেননা, শরতের মতো হেমন্তের নীল আকাশে পাখা মেলে উড়ে বেড়ায় সাদা মেঘের দল।  মিষ্টি সোনা রোদ বলতে যা বুঝায় তা দেখা যায় হেমন্ত ঋতুতে।  তবে শীত ঋতু থেকে একটু আলাদা থাকে হেমন্তের প্রকৃতি।  এ সময় দিন ছোট হয়ে আসে।  রাত হয় দীর্ঘ।  দুপুর গড়াতেই দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের প্রান্তে দেখা যায় সাদা ধোঁয়ার মতো কুয়াশা।  দেখতে দেখতে সূর্য পশ্চিমাকাশে ডুবে যেতে থাকে আবির রঙ ছড়িয়ে।  চারদিকে নেমে আসে বন্য নির্জনতা।  এমন রহস্যময় নীরবতা শুধু হেমন্ত ঋতুতেই দেখা মেলে।  শীত-শরতের মাঝামাঝি বাংলার সুন্দর একটি ঋতু হেমন্ত।

হেমন্তের বাড়াবাড়ি কোনো উচ্ছ্বাস নেই, নেই তেমন কোনো চঞ্চলতা।  তাই হেমন্ত বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য স্হান দখল করতে পারেনি।  বাংলা সাহিত্যে কালিদাস থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ সবার কাছে বসন্ত, বর্ষা, শরৎসহ অন্যান্য ঋতুর রূপমাধুরী বিশেষভাবে ধরা পড়লেও হেমন্ত তেমন একটা প্রাধান্য পায়নি।  এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম শুধু নির্জনতা ও প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ।  হেমন্ত জীবনানন্দ দাশের প্রিয় ঋতু।  হেমন্তের গভীর গম্ভীর রূপ জীবনানন্দের প্রাণে দোলা দিয়েছে।  ক্ষণস্হায়ী এই ঋতু তাকে আকৃষ্ট করেছে।  তাইতো বুকের গভীর থেকে তিনি উচ্চারণ করেছেন

“আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে  এই বাংলা হয়তো মানুষ নয়  হয়তো বা শংখচিল শালিখের বেশে, হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়…”

হেমন্ত যেমন ধান দিয়ে কৃষকের গোলা ভরে দেয়, তেমনি ধান কাটার পর পরই শুরু হয় রবিশস্যর বোনার কাজ।  মাশকলাই, মটরশুঁটি, খেসারির ঘন সবুজ কচিপাতা সবুজ হয়ে ওঠে দিগন্তের মাঠ।  মাঠে মাঠে হলুদ শস্যফুলে মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে ওঠে।  শীতের আগাম সবজিতে মাঠের পরে মাঠ সবুজে সবুজে ভরে যায়।  দেখতে দেখতে হেমন্তের দিনগুলো পেরিয়ে দুয়ারে হাজির হয় ঠান্ডা কনকনে শীত।

শরৎ পেরিয়ে প্রকৃতিতে হেমন্তের আসে চুপিসারে, নীরবে, নিভৃতে।  সম্পূর্ণ নিজস্ব ধারায়।  কার্তিকের ছন্নছাড়া বেশভূষা ছেড়ে অগ্রহায়ণে এসে মানুষ নতুন এক প্রকৃতিকে আবিষ্কার করে।  তবে কেউ কেউ তাকে অনুভব করতে পারলেও সবাই তাকে অনুভব করতে পারে না।  ক্ষণস্হায়ী হেমন্ত মৌন, শীতল, অর্ন্তমুখী।  সে উদাসীন, মগ্ন, নিভৃত এক অবয়ব নিয়ে আমাদের মাঝে বিচরণ করে।

লেখক: চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন