Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

অনেকের ধারনা ছিল আমি ফিল্মের নায়িকা হব

আঁখি আলমগীর

১৯৯২ সালের কথা। তখন আমি ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি। ওই সময় ওস্তাদ গোলাম আলী কনসার্ট করতে বাংলাদেশে এসেছিলেন। কনসার্ট শেষ করে রাত ১২ টার দিকে ছেলে আব্বাস আলীকে নিয়ে তিনি আমাদের বাসায় আসেন। কথা প্রসঙ্গে বাবা বললেন, আমার মেয়ে খুব ভালো হিন্দি গান গাইতে পারে। তখন আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। আমাকে রাত ১টার সময় ঘুম থেকে জাগানো হয়। চোখ ডলতে ডলতে নিচে এসে গেলাম। গোলাম আলী সাহেবকে দেখে তো আমার মাথা নষ্ট। তার হয়তো ধারণা ছিল বাংলাদেশের মেয়ে কী আর হিন্দি গান করবে? হয়তো ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে কিছু একটা গাইবে। সেদিন আমি লতাজীর ‘কাঁহি দ্বীপ জ্বালে কাঁহি দিল’ গানটি করি। এটার পর আরো তিনচারটা পুরনো দিনের গান শোনাতে বলেন তিনি। তখন আমি বেশ কটা গান করি। বাবা জিজ্ঞেস করলেন কেমন লাগল বলেন। তিনি বললেন, আজকে বলব না, আগামীকাল বলব। তার কথা শুনে খুব মন খারাপ হয়ে গেল। এত বড় একজন শিল্পীকে গান শোনালাম, নিশ্চয়ই ভালো হয়নি। আমি হয়তো মন খারাপ করব তাই কিছু বললেন না। পরের দিন কলেজে চলে যাই। বাসায় এসে দেখি নতুন একটা হারমোনিয়াম। আমার হারমোনিয়াম, তবলা, তানপুরা সবই তো আছে। আব্বু বললেন এটা গোলাম আলী সাহেবের হারমোনিয়াম। এটা এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িতে করে তোমার জন্য পাঠিয়েছেন। বলেছেন আঁখির গান কেমন লেগেছে সেটা বলব না, এটা আমার হারমোনিয়াম, এটা দিলে ও বুঝবে। এটা আমার জীবনে সবচেয়ে বড় একটা স্মৃতি।
হ শ্রদ্ধেয় শাহনাজ রহমতউল্লাহ্ ছোটবেলায় আমার গান শুনে বলেছিলেন, ওর তো এখনই প্রফেশনালি গান গাওয়া উচিত। আমি বলেছিলাম, শখে গান করি। বড় হয়ে আইনজীবী হওয়ার ইচ্ছা। গান তো শখে করেছি। তিনি বলেছিলেন, তুমি গান প্রফেশনালি করতে না চাইলে গানই তোমাকে ডেকে নেবে। উনার কথাটা এখনো আমার মনে পড়ে।
হ যখন ফিল্মে গান গাইব গাইব করছি, তখন আমাদের বাসায় প্রায়ই ঘরোয়া জলসায় গানের আসর বসতো। যেখানে প্রায়ই সুবীর নন্দী আঙ্কেল, হাদী আঙ্কেলরা আসতেন। আমার মা যেহেতু গান লিখতেন, বাবা অনেক গান প্রিয় মানুষ। একসঙ্গে বসে গান হতো। এমনই এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে সুবীর আঙ্কেলকে বাবা বললেন, আমার মেয়ের গান শোন, যদি মনে হয় আমার মেয়ে গান গাইতে পারে, তাহলে তাকে গান গাইতে দেব। যদি না হয় তাহলে দেব না। এখন তো স্কুলে পড়ে, কলেজে উঠলে গান গাইতে দেব। কোনো একটা পুরনো দিনের গান গেয়েছিলাম সেদিন। আমার গান শুনে সুবীর আঙ্কেল বললেন, আপনি কলেজ পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন, ততদিনে তো একটা ভালো শিল্পীকে দেশ হারাবে। আঁখি তো এখনই গানের জন্য তৈরি। বড় বড় শিল্পীদের এমন উৎসাহ অনেক বড় পাওয়া।
হ ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত হয় আমার দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ‘বিষের কাটা’। এই অ্যালবামটা ছিল সুপার হিট। তখনো আমার পরিবার থেকে স্টেজ শো করতে দেয়া হয়নি। সেই সময় লন্ডন থেকে একটা বড় শো’র অফার এলো। এখানেও আমার পরিবার যেতে দিতে রাজি হননি। যারা অনুষ্ঠানের আয়োজক তারা আমার অভিভাবকদের জন্যও টিকিটের ব্যবস্থা করল। শেফালী ঘোষ, সৈয়দ আব্দুল হাদী, কনকচাঁপা, রক্সি আপার মতো জনপ্রিয় শিল্পীরা ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। আমার ধারণা ছিল কেউ আমাকে চেনে না। এত বড় বড় শিল্পীদের মধ্যে আমি একেবারে নতুন একজন। আমার গান দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হলো। আঁখি আলমগীর নামটা বলার সঙ্গে সঙ্গে হল ভর্তি মানুষের আনন্দ চিৎকার। তখন বুঝতে পারলাম মানুষ আমাকে চেনে, অনেক পছন্দ করে। গানটা ছিল ‘পিরিতি বিষের কাঁটা, বিধল আমার গায়’।
হ ১৯৮৪ সালের ঘটনা। আমি জীবনের প্রথম প্লে ব্যাক করি দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ‘বিদ্রোহী বধূ’ ছবিতে। ডুয়েট গানটিতে আমার সহশিল্পী হিসেবে ছিলেন সাগর। সংগীত পরিচালক ছিলেন আনোয়ার জাহান নান্টু। প্রথম পারিশ্রমিক হিসেবে সেদিন ৫০০০ হাজার টাকা পেয়েছিলাম। এটা আমার জীবনের সেরা একটা স্মৃতি।
হ আমি প্রথম যেদিন মায়ের সঙ্গে স্টুডিওতে যাই সেদিন শওকত আলী ইমন আমার মায়ের লেখা কিছু গান অন্য শিল্পীর জন্য করছিলেন। ওই সময় গানগুলো শুনে আমি গুন গুন করে গাইতে থাকি। আমার গাওয়া দেখে শওকত আলী ইমন বললেন, তুমি তো ভালো গান গাও। এই গানটা গেয়ে শোনাও তো। তখন আমি প্রথম মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে গান গাইলাম। সম্ভবত গানের কথা ছিল ‘প্রথম চিঠি পেলাম’ । সেদিন একটা গান গাওয়ার পরে উনি আমাকে দাঁড় করিয়ে আরো পাঁচটা গান করান। এই স্মৃতি এখনো মনে পড়ে।
হ গান ছাড়া বই পড়তে আমার খুবই পছন্দ। ক্লাস সিক্স থেকে চশমা পড়ি বই পড়ার জন্য। আব্বু-আম্মু রাত ৯/১০টার দিকে আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। সেই সুযোগে আমি মোম জ্বালিয়ে বাথরুমে গিয়ে বই পড়তাম। আমার বই পড়ার প্রচÐ নেশা ছিল। বিছানার পাশেও বিভিন্ন ধরনের অনেক বই থাকত। সেই সময়কার স্মৃতি এখনো আমার মনে পড়ে।
হ ২০০২ সালের ঘটনা। আমি একবার গান করতে জাপানে গিয়েছিলাম। সেই অনুষ্ঠানে অনেক বড় বড় শিল্পী ছিলেন। তাদের মধ্যে একমাত্র জুনিয়র শিল্পী ছিলাম আমি। সেই অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করছিলেন আমাদের দেশের স্বনামখ্যাত একজন উপস্থাপক। স্টেজে উঠার আগে তিনি বলেছিলেন তুমি দুইটার বেশি গান গাইবে না। কারণ বাকি অনেক বড় বড় শিল্পীরা অপেক্ষা করছেন। এটা আমার ক্যারিয়ারের প্রথম দিকের ঘটনা। তখন কিন্তু আমার বিষের কাঁটা গানটা বাজারে সুপার হিট। উনি বারবার বলে দিলেন দুইটা, বেশি গান করবে না। আমি তখন মনে কষ্টে নিয়েই স্টেজে উঠি গান গাইতে। ঠিক দুইটা গান গেয়ে আমি যখন স্টেজ থেকে নেমে যাব ভাবছি তখন জাপানের হল ভর্তি ৫০০০ হাজার বাঙালি দর্শক আমার নাম ধরে চিৎকার করতে থাকে। হল ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থা। দেখলাম আঁখি আঁখি বলে চিৎকার করছে। কিন্তু আমার সিনিয়র উপস্থাপক বলেছেন দুইটা গান করতে, তার সঙ্গে তো আমি বেয়াদবি করতে পারি না। মাথা নিচু করে স্টেজ থেকে নেমে পড়ি। উপস্থাপক স্টেজে উঠে পরবর্তী শিল্পীর নাম বলতে যান। তখন দর্শক তার কথা আর শুনছেন না। তিনি বাধ্য হয়ে আমাকে আবার স্টেজে ডাকেন। তখন আমি চার পাঁচটা গান গাই। সেই কনসার্টের স্মৃতি আমার কাছে এখনো স্মরণীয় হয়ে আছে।
হ বাবার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আসলে আমার গান শেখা পুরোটাই বাবার জন্য। গানের জন্য বাবা আমাকে অনেক বেশি উৎসাহ দিয়েছেন। মনে আছে অনেক ছোটবেলায় যেদিন আব্বুর শুটিং থাকত না সেদিন তিনি ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে আমাকে বলতেন, আঁখি হারমোনিয়াম নিয়ে রুমে এসো। আমি হারমোনিয়াম নিয়ে রুমে যেতাম। আব্বুকে আমি শুধু পুরনো দিনের বাংলা হিন্দি গান গুলো শুনতাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা উনি চোখ বন্ধ করে শুনে গান শুনতেন।
হ ছোটবেলায় তো ‘ভাত দে’ সিনেমায় অভিনয় করেছি। অভিনয় করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছি। এটা ১৯৮৪ সালের কথা। তখন সবাই ভাবত আমি অভিনেত্রী হবো। কিন্তু গান তো শিখেছি ছোটবেলা থেকে। আব্বুর কোনো চাপ ছিল না। যেটা করতে চেয়েছি, বেছে নিতে চেয়েছি সেই স্বাধীনতা দিয়েছেন। সিনেমায় অনেক বেশি অফার ছিল। সুযোগ ছিল। সবার ধারণাও ছিল নায়িকা হবো। বিএ পাস করে ল পড়তে ঢুকে গেলাম। পরে সেটা আর শেষ করা হয়নি।
হ মৈত্রী সম্মাননা দুই বাংলার মানুষদের দেয়া হয়। এটা সাধারণত কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদদের বেশি দেয়া হয়। দু-একবার শিল্পীরা পেয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় আমি পেলাম। আমার সঙ্গে তারা যোগাযোগ করলে তারপর আমি সম্মতি দেই। আমাকে পুরস্কার তুলে দেন কলকাতার পর্যটন মন্ত্রী ব্রাত্যবসু । তার সঙ্গে অনেক কথা হয়েছে, সংস্কৃতিমনা মানুষ তিনি। আমার বেশ কিছু সিডি তাকে উপহার দিয়েছি। আমি আলমগীরের মেয়ে সেটা তিনি জানতেন না। পরে তাকে বলেছি। পুরস্কার পাওয়াটা ছিল অনেক বড় একটা ব্যাপার।
হ আমরা দুই বোন, একভাই। আমি সবার বড়। সেদিক থেকে বাবার সঙ্গে এক অদৃশ্য বন্ধন অনুভব করি সব সময়। মজার বিষয় হচ্ছেÑ আমি এত বড় হয়েছি, দুই সন্তানের মা হয়েছি তবুও বাবার কাছে যেন এখনো সেই ছোট্টটি আছি। আমি গান করি বাবা এটা সব সময় চাইতেন। কিন্তু গানকে প্রফেশন হিসেবে নেই, সেটা চাইতেন না। আমার গানের বড় সমালোচক তিনি। ভুল হলেও ধরিয়ে দিতেন। খুব বন্ধুত্বপরায়ণ। বাবা অনেক বড় তারকা। সব সময় তার ব্যস্ততা ছিল। তবুও অবসর পেলে আমাদেরকে নিয়ে দেশের বাইরে ঘুরতে যেতেন। একারণে ছেলে বেলাতেই অনেক দেশ ভ্রমণ করার সুযোগ হয়েছিল। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাবা আমার গান শুনতেন। হারমোনিয়ামে বসে কত গান যে শুনতাম এই স্মৃতি এখনো মনে পড়ে।

সম্পর্কিত