Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

হায়াৎ মামুদ : বাঙালি বলিয়া তাঁর লজ্জা নাই

সালমা বাণী: আর মাত্র কয়েক দিন। আমরা আনন্দের সাথে উদযাপন করবো চলমান সময়ের অন্যতম গদ্যকার আমাদের  প্রিয় লেখক হায়াৎ মামুদ-এর আশিতম জন্ম বার্ষিকী। বিন¤্র শ্রদ্ধা বিরল প্রসাদগুণসম্পন্ন গদ্যকার, গবেষক, অনুবাদক, পরিশ্রমী সম্পাদক, শিশুসাহিত্যিক, ভাবুক, চিন্তক সেরা মানুষটির প্রতি । সার্বক্ষণিক হৃদয় উজাড় করা হাসি মুখের মানুষটির সাথে যে কোনো আলাপই হয়ে ওঠে মূল্যবান ও শিক্ষণীয়। যদিও বলেন- দায়ে না পড়লে লেখা আমার ধাতে নেই এবং সেই দায় আচমকা হঠাৎ- হঠাৎ আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেন আমার চেনাশোনা মানুষজন। এভাবেই আমার যাবতীয় সকল লেখালেখি। আসলে বিষয়টি তা নয়।   হায়াৎ মামুদ লেখেন প্রাণের তাগিদে, সামাজ, দেশ ও জাতির প্রতি দায় বোধ থেকে। একদিন আলাপকালে প্রশ্ন করলাম, সফল ব্যবসায়ী পিতার পুত্র কখনো ব্যবসা করতে ইচ্ছা জাগেনি? না, কারণ লেখা ছাড়া যে আর কিছুই শিখিনি। তা ছাড়া অর্থাভাবে একসময় আমার বাবা পড়াশোনার খরচ চালাতে পারেননি। তিনি চেয়েছেন তার সন্তানেরা লেখাপড়ার ভেতরে বসত করুক। পিতার ইচ্ছার মর্যাদা দান করেছেন যোগ্য পুত্র আর করেছেন বাংলা সাহিত্যকে ঋদ্ধ। সেদিন অনেক প্রশ্ন গুছিয়ে গেলাম হায়াৎ মামুদের কাছে তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে চাই…

কিন্তু হায়াৎ মামুদের সর্দিগর্মি। আর খুকু ভাবীর ( হায়াৎ মামুদের স্ত্রীর ডাক নাম) পায়ে প্লাসটার দেয়া, অন্ধকারে বিছানা থেকে নামার সময় পায়ের কড়ে আঙ্গুলে ব্যথা পেয়েছেন। এই রকম অবস্থায় গতানুগতিক সাক্ষাৎকার  নেয়ার চিন্তা বদলে গেল। হায়াৎ মামুদ প্রচÐ আড্ডা প্রিয় মানুষ। তার বই গুলোর ফ্লাপের লেখক পরিচিতির সবগুলোতে পাওয়া যাবে তার প্রিয় বিষয় আড্ডা, বইপড়া আর গান শোনা। আর বইয়ের ফ্লাপের কথাই বা বলি কেন। খুউব কাছে থেকে হায়াৎ মামুদ এর সাথে আড্ডা জমেছে কানাডার টরন্টোতে।

সত্তোরর্ধ্ব গ্রন্থের রচয়িতা হায়াৎ মামুদ সমৃদ্ধ করেছেন সাহিত্যের প্রায় সকল শাখা। জাতির মানস গঠনের অঙ্গীকারে তিনি প্রথমেই বেছে নিয়েছেন শিশুর মানসিক  বিকাশ। শিশুর সুস্থ মনোবিকাশ একটি সুস্থ জাতির প্রথম ও প্রধান শর্ত। আজকের শিশু আগামী দিনের প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিক। এই চিরন্তন গভীর ভাবনা থেকে মনোনিবেশ করেছেন শিশুতোষ সাহিত্য রচনায়। রচনা করেছেন শিশু-কিশোর পাঠ্য জীবনী ও অনদিত গল্প। শিশু কিশোরদের রবীন্দ্রনাথ, লালন সাই এমনকি মেঘনাদবধ কাব্যের গদ্য রূপায়ণ।

টরন্টোতে যখন ছিলেন হায়াৎ মামুদ তখন আমরা টরন্টোর প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিশেষ করে লেখক, কবি সাহিত্যিক, শিল্পী সবাই তাকে খুউব কাছে পেয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে টরন্টোর সেই দিনগুলোতে সকলের সাথে আমিও স্থান পেতাম হায়াৎ মামুদ-এর সাথে আড্ডায়। প্রবাস জীবনে দেশের মানুষ কাছে পেলে প্রবাসীরা যেন আপনজনকে কাছে পায়, প্রাণের সবটুকু শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আবেগদিয়ে উপভোগ করে তাদের সান্নিধ্য। হায়াৎ মামুদও আপনজন হয়ে যান খুউব স্বল্প সময়ে। সম্পূর্ণ আত্মভোলা নিমগ্ন এক মানুষ। আড্ডা জমে উঠেছে, সবাই যখন আড্ডার সাথে নানা ধরনের খাবার আস্বাদনে ব্যস্ত হায়াৎ মামুদের সেদিকে কোনো লক্ষ্য নেই, মনে হয় একেবারে আগ্রহ নেই।

হায়াৎ ভাইয়ের নিকট সান্নিধ্য যারা পেয়েছে তারা জানে হায়াৎ ভাই প্রাণের ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ এক লেখক। সারাক্ষণ কথা গল্প জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় ঘোরের ভেতরে থাকেন। সাক্ষাৎকারে যেসব প্রশ্নের উত্তর সাধারণত খোঁজা হয় সেসবই হায়াৎ মামুদের অসংখ্য বই পাঠে পাওয়া যায়।

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। একথাটা হায়াৎ মামুদের মতো এত গভীর ভাবে আর কেউ ভেবেছেন কী না জানি না। তিনি বলছেন” আমি শিশু মনস্ক ব্যক্তি; ছোটদের শুভাশুভ, মানসিক অগ্রগতি, রসবোধ ও রুচির বিকাশ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করি বলে লিখি” (উৎসে ফেরার ছলচাতুরী  শিশু ও শিশু সাহিত্য গ্রন্থ, অনিন্দ্য প্রকাশ, প্রথম মুদ্রণ ফেব্রæয়ারি ২০১৪)।

একজন সত্যিকারের দেশ প্রেমিক, মাতৃভাষা প্রেমিক হায়াৎ মামুদ। জন্মসূত্রে কানাডার নাগরিক হওয়া সত্তে¡ও তিনি তার দুই নাতিকে দেশে নিয়ে চলে আসেন। যখন আড্ডার  ভেতরে থেকে যুক্তি এসেছে, কানাডার উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা, উন্নত জীবন ইত্যাদি মাথা নেড়ে নেড়ে প্রতিবাদ করেছেন – না, না, তা হয় না, আমার ছেলের ছেলেরা কখনো পরবাসে বড় হবে, অন্য ভাষায় কথা বলবে, অন্য ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করবে, তারা বাংলা ভুলে যাবে! এ হতেই পারে না।  বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত হায়াৎ মামুদ যেমন করেছেন বাঙালির শিশুসাহিত্য নিয়ে বর্ণনাত্মক জরিপ, তেমনি করেছেন বিশ্লেষণাত্মক রচনা। কাজ করেছেন শিশুমনস্কতা, শিশুতোষ কবিতা ও ছড়া, কিশোর পাঠ্য অভিধান ইত্যাদি বিষয়কে নিয়ে। কিন্তু শুধু শিশু কিশোরদের সাহিত্য নিয়েই নয়, তার প্রাণ কাঁদে সমাজের অধিকার বঞ্চিত শিশুদের জন্য। তিনি লিখছেন ” যে বাঙালির জীবনে শিশুকে ঘিরে এত ছড়া, গান, উপকথা এখনও নিত্য উপস্থিত সেই বাঙালিই শিশুর প্রতি যে অবহেলা, ঔদাসীন্য ও নিষ্ঠুরতা দেখায় তা অবিশ্বাস্য। এই পরিবর্তন অবশ্যই একদিনে ঘটেনি এবং আমাদের সামাজিক- অর্থনৈতিক ইতিহাসে তার কারণও প্রথিত হয়ে থাকার কথা। কিন্তু এ সত্য নিশ্চয়ই আজ নিরঙ্কুশভাবে উচ্চারণ করা চলে যে, আমরা আর শিশুমনস্ক জাত নই। প্রসঙ্গত, শিশুত্বের সংজ্ঞা এখানে একটু বাড়িয়ে নেয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক ও দৈশিক আইন মিলিয়ে ন্যূনপক্ষে অষ্টাদশ বর্ষ বয়ঃক্রম এই সীমানায় আসবে। নবজাত শিশু থেকে আঠারো বছরের ছেলে মেয়েদের এই যে শিশুদল, তাদের প্রতি আমরা-বাংলাদেশের মানুষ- প্রতিনিয়ত যে নির্মম অমানবিক ও ক্ষমতাদম্ভী অত্যাচার করে থাকি তা একদিকে যেমন আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের পরিপন্থি তেমনি আমাদের শিশুমনস্কতার বিপরীতেই রায় দেয়। আমাদের সমাজে আজ এদের চেয়ে অক্ষম নিরুপায় প্রতিবাদহীন অত্যাচারিত আর কেউ নেই। সম্পন্ন সংসারে গৃহভৃত্য আব্দুলের দল, গৃহপরিচারিকা কাজের মেয়ে, চায়ের দোকান ও নি¤œ আয়ের ছোটখাটো দোকানপসারিতে বা কারখানায় তাদের যেভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে, অনেক দিন থেকেই হচ্ছে, তা অবর্ণনীয় বেদনাদায়ক। ইদানিং এর সাথে যুক্ত হয়েছে পোশাক তৈরির কারখানা। এতখানি কায়িক শ্রম ও আর্থিক প্রতারণার শিকার তারা কোনো সভ্য দেশেই হয় না।

সারা দেশব্যাপী রাস্তার পাশে গজিয়ে ওঠা ছাপরা চায়ের দোকানে, কিংবা রাজধানী  ঢাকায় টেম্পো গাড়ির হেলপারের চাকরিতে আট-দশ বছরের ছেলে সব সময়ই  চোখে পড়ছে। শিশু- নির্যাতনের সংবাদ কোনো না কোনো ছদ্মবেশে প্রতিদিনই দৈনিক সংবাদপত্রের পৃষ্টায় থাকে। চোখ খুললেই, কান পাতলেই এইসব অমানবিক ঘটনার সংস্পর্শে যেতে যেতে ক্রমশ আমাদের মনুষ্যসহজাত বেদনাবোধও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। এই অমানবিকীকরণের প্রক্রিয়া এদেশে মুহূর্তের জন্যও থেমে নেই। আন্তর্জাতিক আইন/কনভেনশন, দেশের প্রচলিত আইন ইত্যাদি এ ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয়। সচেতন, সহজেই দুঃখে কাতর, সহৃদয় মানুষ দু-চার জন নিশ্চয়ই আছেন। কিন্তু তাঁরা কী করতে পারেন? সর্বব্যাপ্ত নির্দয়তার পরিবেশে তাঁর ব্যক্তিগত করণীয়  কিছু অবশ্যই আছে, আর সেটুকুই হয়তো-বা তিনি করনে, কিন্তু সমষ্টির ব্যাধির তুলনায় তাঁর একক প্রচেষ্টার  ওষুধ হাস্যকারভাবে অপ্রতুল।

Hayat Mahmud-1আমার যে কী প্রচÐ কষ্ট হয় কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। রাজধানীর সর্বাধিক জন অধ্যুষিত এলাকা পুরনো ঢাকায় আমার বাস বলে শিশু কিশোর শ্রমের যে ব্যাপকতা ও বৈচিত্র্য প্রত্যহ আমায় চাক্ষুষ করতে হয় তা অনভিজ্ঞ ব্যক্তিকে বিশ্বাস করানো কঠিন। আট থেকে চৌদ্দ-পনের বছরের বিষন্ন পরিশ্রমরত মুখ দেখলেই নিজেকে অপরাধী মনে হয়। মনে মনে আমি ওদের মুখে আমার ছেলেমেয়ের মুখ বসাই, ওদের দেহে আমার সন্তানদের কাপড়জামা পরাই, হাতের মধ্যে বইখাতা -পেন্সিল গুঁজে দিই। সবই মনে মনে বাস্তবে নয়। আমার কি ঐ ক্ষমতা আছে?  আর থাকলেও একার ।ঔদার্যে কি সকলকে পাল্টানো যায় যদি- না সম্মিলিত  ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা থাকে? কিন্তু এর ফলে আমার ভেতরের কষ্টটা বেড়ে যায়। গøানি আসে, অক্ষমতার চাপা ক্ষোভ ও ক্রোধ আসে। লজ্জা ও ভয়ও  আসে-ভাগ্যিস, আমার সন্তানেরা ঐ মনুষ্যেতর জীবনের মধ্যে পড়ে না। বিধি আমায় বাঁচিয়েছেন, আমি কতিপয় ভাগ্যবানের একজন। ভাগ্যের কাছে কৃতজ্ঞতা মেনে নিজের আচার-ব্যবহার সংস্কারের  প্রতিজ্ঞা নিই : আমার সীমিত সাধ্যের ছত্রছায়ায় যে দু-এক জনই আছে তাদেরকে যেন মমতার দৃষ্টিতে দেখি। মধ্যবিত্তের বিবেক এইভাবে নিজেকে রক্ষা করে।

বাংলাদেশে এই মুহূর্তে বয়স্ক অপেক্ষা শিশুরা (জাতিসংঘের নিয়মে ১৮ বছর বয়ঃসীমা পর্যন্ত) সংখ্যায় অনেক বেশি। অপূর্ণ ইচ্ছা, অবদমিত বাসনা, অবহেলাজনিত অপমানবোধ, অত্যাচারিত হওয়ার জন্য অসহায় অথচ অসহ্য ক্রোধ, ওদের অলক্ষ্যেই  ওদের মুখচোখ, ধীরে ধীরে পাল্টে দিতে থাকবে। প্ঞ্জুীভ‚ত ঘৃণা, বয়স্কদের চেয়ে ওদেরকে ক্রমশ অনেক বেশি নির্মম করে তুলবে। ওরা ধীরে ধীরে বিদ্রোহী হবে। সেটাই স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত। কিন্তু সমাজ- গড়নের দিক থেকে কাম্য তো নয়। শিশু অবহেলার ধন হলে সে ঐ পয়সা দিয়ে বড়োদের খাজনা শোধ করবে একদিন।

বাংলাদেশের অজ্ঞান ও অন্ধ বয়স্ক মানুষের সমাজ এখনো  জানে না যে, সে কোন আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখে শুয়ে সুখনিদ্রা যাচ্ছে।”

হায়াৎ মামুদের এই বক্তব্য আজ বারবার পুনঃমুদ্রণ ও পুনঃলিখন হওয়ার সময়। আমরা আগ্নেগিরির জ্বালামুখে শুয়ে সুখনিদ্রা যাচ্ছি।

মানবতাবাদী সাহিত্যিক হায়াৎ মামুদ দেশ কাতর, দেশ প্রেমিক। টরন্টোর স্বল্প প্রবাস জীবনে শুনেছি তার প্রাণের আকুতি।

বহু বছর পর হায়াৎ মামুদ-এর দুই নাতি দীপ্ত আর কুশলকে দেখে আমি অভিভ‚ত। হায়াৎ ভাই ঠিকই তার সমস্ত অহংকার দিয়ে এই বাংলাতেই বড় করেছেন তার দুই নাতিকে। তখন বারবার হায়াৎ মামুদের বইয়ের নাম আমার করোটির ভেতরে ক্রমাগত আঘাত করছে- বাঙালি বলিয়া লজ্জা নাই।