Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

স্বাধীনতা প্রিয় স্বাধীনতা

একবার ভাবুন তো বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভালো খেললো। দাপটের সাথে যদি লড়াই করে তাহলে স্বাধীনতার এই মাসে এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কী হতে পারে! ভারতে বিশ্বকাপ টি-২০ খেলতে গেছে বাংলাদেশের আশা-ভরসার প্রতীক লড়াকু ক্রিকেটাররা। গত বছরও এমন সময়ে বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলেছে তারা। দুর্দানত্ম লড়াই করেছে। বিশ্বকাপের মাঠে প্রিয় জাতীয় পতাকা মাথায় বেধে জাতীয় দলের গর্বিত অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা ক্রিকেটের জয়কে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী সকল বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতি উৎসর্গ করেছিলেন। এবারও সেরকম এক মুহূর্ত এসেছে। আমরা আশায় আছি এবারও চমক দেখাবেন আমাদের গর্বের ধন ক্রিকেট তারকারা। স্বাধীনতার মাসে আনন্দ আলোর চলতি সংখ্যাটি বীর ক্রিকেটারদের প্রতি উৎসর্গ করা হল।

ওরা ১১ জন

সম্পর্কিত

ওরা ১১ জন। মাঠে খেলে। কিন্তু ওরা আসলে ১৫ জন। দেশের ১৬ কোটি মানুষের আশা-ভরসার প্রতীক। ওরা হাসলে বাংলাদেশ হাসে ওরা কাঁদলে বাংলাদেশও কাঁদে। ওদের হাসি আর কান্নায় জড়িয়ে আছে দেশের ১৬ কোটি মানুষের জীবনচিত্র। বলছি বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের ১৫ জন লড়াকু ক্রিকেটবীরের কথা। ক্রিকেট বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। পাশাপাশি এই একটি খেলাই দলমত নির্বিশেষে দেশের ১৬ কোটি মানুষকে একসূত্রে গেঁথেছে। যেনো ১৬ কোটি মানুষের এক বিরাট বন্ধন- বিনিসুতোর মালায় বেঁধেছি প্রাণ…।

ক্রিকেট, একমাত্র ক্রিকেট বাংলাদেশের মানুষের কাছে কতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তার প্রমাণ তো প্রতিদিনই মিলছে দেশের পত্র-পত্রিকা ও প্রচার মাধ্যমের আয়নায়। বাঙালি যেন এক ক্রিকেট পাগল জাতিতে পরিণত হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত এশিয়া কাপ টি২০ টুর্নামেন্টের কথাই ধরা যাক। সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পাকিসত্মান ও শ্রীলংকাকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। আর তাই বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যাশার পারদ এতোটাই উপরে উঠেছিল যে ধরেই নেয়া হয়েছিল ফাইনালে বাংলাদেশ জিতবে। সেজন্য সেকি উত্তেজনা আর সাফল্য উদযাপনের আগাম আয়োজন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে জাতীয় দলের প্রতীকসহ প্রোফাইল পিকচার জুড়ে দেন। দেশজুড়ে শুরু হয় আনন্দ আয়োজনের অভিনব সব আয়োজন। পাড়া মহল্লায় বড় পর্দায় খেলা দেখার আয়োজন তো ছিলই পাশাপাশি ছিল পিকনিক উৎসবেরও ব্যবস্থা। রাজধানীর অনেক ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে বড় পর্দায় খেলা দেখার পাশাপাশি ভুরিভোজের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অনেকে দামি হোটেলে পার্টিও দিয়েছিলেন। হোটেলে বসেই খেলা দেখা আর খাওয়া-দাওয়ার আনন্দ আয়োজনেও মেতে উঠেছিলেন অনেকে। দেশের প্রত্যনত্ম অঞ্চলেও সাধারণ পরিবারে জাতীয় দলের মঙ্গল কামনায় মুনাজাত করা হয়েছে। দেশের অনেক স্থানে মমতাময়ী মায়েরাও বাংলাদেশ দলের মঙ্গল কামনায় মুনাজাত ধরেছিলেন। যে মা হয়তো ক্রিকেট তেমন বোঝেনও না। শুধু বোঝেন খেলাটায় জিতলে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ জিতবে। তাই দেশের মঙ্গল কামনায় মুনাজাত ধরেছিলেন হে আল্লাহ, ইয়ামাবুদ… বাংলাদেশকে জিতিয়ে দিও।

সার্বিক বাসত্মবতায় ক্রিকেট একমাত্র ক্রিকেটই এখন একসূত্রে বেধে রেখেছে দেশের মানুষকে। এশিয়া কাপের ফাইনালে বাংলাদেশ খুবই বাজেভাবে হেরেছে। ফাইনালের দিন মাঠের গ্যালারীতে বসে থাকা সাধারণ মানুষের করুণ মুখ দেখে অনেকেই বেদনার্ত হয়েছেন। তবুও আশা ছাড়েননি কেউ। এশিয়া কাপে চূড়ানত্ম সাফল্য আসেনি। তাতে কী? বিশ্বকাপে নিশ্চয়ই আসবে।

এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলেই জাতীয় দলের ১৫ ক্রিকেটার উড়ে গেছেন ভারতের ধর্মশালায় বিশ্বকাপ টি২০ প্রতিযোগিতায় লড়ার জন্য। এই রিপোর্ট লেখা পর্যনত্ম ধর্মশালার স্টেডিয়ামে বাছাই পর্বের প্রথম খেলায় নেদারল্যান্ডের সাথে লড়াই করে জিতেছে। বৃষ্টির কারনে আয়ারল্যান্ডের কাছে পয়েন্ট ভাগাভাগি হয়েছে। এখন ওমানের সাথে লড়ে মূল পর্বে যেতে হবে।

ক্রিকেট অনিশ্চয়তার খেলা। তবুও সাম্প্রতিক পারফরমেন্সের বিচারে আমরা ভাবতেই পারি মাশরাফির লড়াকু বাংলাদেশ দল বাছাই পর্বে সেরা হয়েই মূল পর্বে পা রাখবে। আর সেজন্য উন্মুখ হয়ে আছে দেশের ১৬ কোটি মানুষ।

এখন যে স্বপ্নের কথা বলছি তা শুনে হয়তো অনেকে ভাবতে পারেন স্বপ্নটা আকাশ কুসুম কল্পনার মতোই। কিন্তু আমরা তা মনে করি না। আমরা মনে করি বাংলাদেশ এশিয়া কাপে যে মানের খেলা খেলেছে সেই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে দেশের মানুষের জন্য আবারও একটি ফাইনালের রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত আসতে পারে। ভাবুন একবার সকল বাধা ডিঙ্গিয়ে বিশ্বকাপ টি২০ তে বাংলাদেশ উঠেছে ফাইনালে। ঐতো মাঠে দেখা যাচ্ছে দেশের ১১ ক্রিকেট তারকাকে। ওরা ১১ জন। আসলে ওরা ১৫ জন যথাক্রমে মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদ উল্লাহ রিয়াদ, সৌম্য সরকার, সাব্বির রহমান, মুসত্মাফিজ, তাসকিন, আরাফত সানি, আবু হায়দার রণি, নাসির, আল আমিন, নূরুল হাসান ও মিঠুন ১৬ কোটি মানুষের আশা ভরসার প্রতীক। আসুন আমরা বাংলাদেশের জয়ের জন্য সমবেত প্রার্থনা করি।

আমাদের ক্রিকেট এবং একটি সাধারণ গল্প

রেজানুর রহমান: বাসার ড্রয়িং রুমটাকেই সিনেমা হল বানিয়ে ফেললেন আসাদুজ্জামান। সিনেমা হলের প্রধান শর্ত হলো একটা বড় পর্দা থাকা চাই। সেজন্য ৫৫ ইঞ্চি সাইজের একটা বড় টেলিভিশন কিনে আনলেন। বাংলাদেশে এর চেয়ে বড় সাইজের টেলিভিশন এখনো আসেনি। দোকানদারকে বলে এসেছেন যখনই এর চেয়ে বড় সাইজের টেলিভিশন আসবে তখনই যেন তাকে খবর দেয়া হয়। সাথে সাথে বদলে ফেলবেন।

BD-TEAM-2টেলিভিশনটা ড্রয়িংরুমে বসানো নিয়ে অনেক ঝামেলা পোহাতে হল। দোকানের লোকজনই দেয়াল ফুটো করে টেলিভিশন বসিয়ে দিয়ে গেল। কিন্তু ওরা বড়ই তাড়া দেখাচ্ছিল। কেমন যেন একটা দায়সারা ভাব। শুধুই তাড়াহুড়া করছিলো। কাজ কেমন হয় হোক। সেদিকে তাদের মনযোগ নাই। দেয়াল ফুটো করতে গিয়ে অযথাই দেয়ালে গর্ত করে ফেলল। আসাদুজ্জামান ছেলেটাকে ধমক দিলেন- অ্যাই তোমরা এসব কি করতেছো? দেয়াল কী এভাবে ফুটো করে? তাড়াহুড়া করতেছো কেন? তোমরা তো মিয়া মানুষ সুবিধার না। তোমাদের মালিকের ফোন নম্বর দাও তো… আমি তার সাথে কথা বলব। কই ফোন নম্বর দাও।

যে ছেলেটি দেয়াল ফুটো করছিলো তার বয়স বেশ অল্প। ১৭ কী ১৮ হবে। ভয় পেয়েছে। অপরাধী চেহারায় কাঁপতে কাঁপতে বলল, স্যার তাড়াতাড়ি করতে গিয়া একটা ভুল হয়ে গেছে…।

ছেলেটির কথা কেড়ে নিলেন আসাদুজ্জামান। ধমক দিলেন, অ্যাই ছেলে তাড়াতাড়ি করতেছ কেন? আমি কি তোমাকে তাড়া দিয়েছি? আমি কি বলেছি একঘণ্টার কাজ ১০ মিনিটে করতে? বল, বলেছি? ছেলেটি মাথা নীচু করেই বলল, না স্যার আপনি তা বলেননি। আমাদেরই একটু তাড়া আছে…

আবার ছেলেটির কথা কেড়ে নিলেন আসাদুজ্জামান। এবার জোরে ধমক দিয়ে বললেন, তোমাদের তাড়া আছে মানে? তাড়া থাকলে তোমরা আসছ কেন? তোমাদের মালিকের ফোন নম্বর দাও। আমি তার সাথে কথা বলব।

ওরা একসাথে দু’জন এসেছে টেলিভিশনটা দেয়ালে বসিয়ে দেবার জন্য। এতোক্ষণ আসাদুজ্জামানের সাথে কম বয়সী ছেলেটাই কথা বলছিলো। এবার একটু বয়সী ছেলেটা মুখ খুললো। বিনীত কণ্ঠে আসাদুজ্জামানকে বলল, স্যার ওর কথায় মাইন্ড করবেন না। আসলে হয়েছে কি স্যার, আজ তো এশিয়া কাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের ফাইনাল। তাই আমরা বন্ধুরা মিলে এক সাথে টেলিভিশনে খেলা দেখব। একসাথে খাব। তাই আনন্দ আর টেনশনে কাজে ভুল হয়ে যাচ্ছে… স্যরি স্যার…

আসাদুজ্জামান এবার ধমক দিতে গিয়েও দিলেন না। ওরা বন্ধুরা একসাথে মিলেমিশে টিভিতে এশিয়া কাপের ক্রিকেট ফাইনাল দেখবে। একটা ইতিহাসের স্বাক্ষী হবে। কাজেই ওদেরকে মাফ করে দেয়া যায়। কিন্তু ওরা কি জানে আজ এই বাসায়ও একটা নতুন ইতিহাস হবে। নতুন ঘটনা ঘটবে। গত ৫/১০ বছরেও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যাদের সাথে দেখা হয়নি তারা আজ এই বাসায় আসবে। টিভিতে এশিয়া কাপে বাংলাদেশের খেলা দেখার পাশাপাশি চলবে খাওয়া দাওয়া। সাথে আড্ডা। ওরা কি জানে একথা?

আসাদুজ্জামান বয়সী ছেলেটাকেই প্রশ্ন করলেন, তোমরা কি জানো আজ আমার বাসায়ও অনেক লোকজন আসবে। সবাই মিলে টেলিভিশনের বড় পর্দায় বাংলাদেশের খেলা দেখব। সবাই মিলে খাব। আনন্দ ফুর্তি করব। তোমরা জানো এইসব?

ছেলেটি মৃদু হেসে বলল, এসব কথা জানি স্যার। গত কয়েকদিনে আমাদের দোকান থেকে বড় সাইজের টেলিভিশনই বেশি বিক্রি হয়েছে। সবাই আপনার মতো বাসায় ক্রিকেট পার্টির আয়োজন করেছে। গুলশানের একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে গরু আর খাসি জবাই করেছে। বিল্ডিং এর ছাদে বড় পর্দায় খেলা দেখা হবে। সাথে থাকবে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন। লটারীর আয়োজনও নাকি থাকবে। প্রথম পুরস্কার এক লাখ টাকা…।

ছেলেটিকে থামিয়ে দিলেন আসাদুজ্জামান। জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কী মনে হয়? আজ এশিয়া কাপ ফাইনালে বাংলাদেশ জিতবে?

এবার ছোট ছেলেটি সাহস করে জবাব দিল। তার চোখে মুখে দৃঢ় প্রত্যয়- স্যার আইজ বাংলাদেশই জিতব। ইন্ডিয়া বাংলাদেশের সাথে পারব না। যদিও একটা ঝামেলা আছে। মুসত্মাফিজতো খেলতেছে না। মুসত্মাফিজ দলে থাকলে ১০০ ভাগ সিউর ছিল স্যার…। তবুও ইন্ডিয়া পারবে না। বাংলাদেশ স্যার হেব্বি ফর্মে আছে। পাকিসত্মান ও শ্রীলংকারে হারাইছে। ইন্ডিয়াকেও হারাবে…।

দেয়াল ফুটো করার অপরাধে ছেলে দুটোর প্রতি রুষ্ঠ হয়েছিলেন আসাদুজ্জামান। ছেলে দুটোর ওপর রাগ হয়েছিল। এখন রাগ কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে ছেলে দুটো বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলায় আসাদুজ্জামান নিজেকে শানত্ম করলেন। আজ এশিয়া কাপের ক্রিকেট ফাইনালে বাংলাদেশ খেলবে। আজ আনন্দের দিন। উৎসবের দিনও বটে। কাজেই রাগারাগি করা ঠিক হবে না।

আসাদুজ্জামানের মোবাইল বাজছে। নূরুজ্জামান ফোন করেছে। আসাদুজ্জামানের চাচাতো ভাই। বয়সে এক বছরের বড়। হাউজিং ব্যবসার সাথে জড়িত। পানির মধ্যে জমি কেনে। তারপর জমি ভরাট করে বিক্রি করে। কোটি কোটি টাকার মালিক। বোধকরি ৫/৭ বছর পর ফোন করেছেন নূরুজ্জামান। আসাদুজ্জামান অবাক হয়ে বললেন, ভাই ভালো আছেন?

হ্যা ভালো আছি। খবর কি বলতো? তোর বাসায় কি আজ কোন বিশেষ অনুষ্ঠান আছে। তোর ভাবী বলল… আসাদুজ্জামান মৃদু হেসে বললেন, ঘটনা হল ভাই আমরা একসাথে এশিয়া কাপে বাংলাদেশের ফাইনাল খেলা দেখব। একসাথে খাব… আড্ডা দিব। এই আর কী…

নূরুজ্জামান বললেন, ভালো উদ্যোগ। অনেকদিন তোর সাথে দেখা হয় না। আর কে কে আসবে?

আসাদুজ্জামান খুশী হয়ে বললেন, আত্মীয়স্বজন সবাইকে বলেছি… কাউকে বাদ দেই নাই। সবাই কথা দিয়েছে আসবে।

আসাদুজ্জামানের কথা শুনে নূরুজ্জামান জানতে চাইলেন, তোর বাসাটা যেন কোথায়?

গুলশান নিকেতনে… ব্রীজের পাশে…

তোর বউকে একটু দেতো…

ওতো ভাইজান রান্নাবান্নায় ব্যসত্ম। আপনার জন্য কলিজা ভুনা করতেছে। টাকি মাছের ভর্তাও থাকবে…

আসাদুজ্জামানকে থামিয়ে দিলেন নূরুজ্জামান- তুই তাহলে ধরেই নিয়েছিস আমরা আসব…

BD-TEAM-3আসাদুজ্জামান বললেন, হ্যা ভাইজান। ভাবীকে নিয়ে আসেন। অনেকদিন কেউ কাউকে দেখি না। খেলা দেখার অছিলায় দেখা হবে। কথা হবে। আড্ডা হবে…।

নূরুজ্জামান ফোন কেটে দেয়ার আগে বললেন, ঠিক আছে আমরা আসতেছি…।

ছেলে দুটোর কাজ শেষ। দেয়ালে ঝুলানো নতুন টেলিভিশনে ঝলমলে অনুষ্ঠান দেখা যাচ্ছে। স্ত্রীকে ডাক দিলেন আসাদুজ্জামান- অ্যাই রাশেদা… রাশেদা… দেখে যাও। বড় টেলিভিশনের বড় কারবার।

রান্নাঘর থেকে রাহেলা দৌঁড়ে এলেন। নতুন টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে খুশী হয়ে বললেন, এমা… দারুন তো… যাক বাবা এশিয়া কাপ ক্রিকেট দেখার সুবাদে আমাদের বাসায় নতুন টেলিভিশন এল। দেখ কি ঝকঝকা ছবি… একটু সাউন্ড বাড়িয়া দেও তো…।

আসাদুজ্জামান রিমোট টিপে টেলিভিশনের সাউন্ড বাড়ালেন। রাশেদা খুশিতে এবার চেঁচিয়ে উঠলেন- এতো দেখি সত্যি সত্যি সিনেমা হলের মতো। বড় ছবি, বড় আওয়াজ… আজ খেলা দেখে বেশ মজা পাওয়া যাবে। আল্লাহ আজ বাংলাদেশকে জিতিয়ে দিও… বলেই রান্নাঘরের দিকে দৌঁড় দিলেন রাশেদা।

ছেলে দুটো যাবার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আসাদুজ্জামান দুজনের হাতে একশ টাকা করে বকশিস দিতে চাইলেন। দুজনই মৃদু হেসে বলল, স্যার আইজ আমরা বকশিস নিব না। তবে একটা জিনিস চাইব… আসাদুজ্জামান অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, বল কী চাও?

বাংলাদেশের জন্য দোয়া চাই স্যার। দোয়া করবেন আইজ বাংলাদেশ যেন এশিয়া কাপে জিতে… বলেই ছেলে দুটো হঠাৎ কেঁদে ফেলল। আসাদুজ্জামান ব্যসত্ম হয়ে বললেন, অ্যাই কি হয়েছে? তোমরা কাঁদতেছো কেন?

বয়সে ছোট ছেলেটি বাম হাত দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল, গতবার এশিয়া কাপে হারার পর সাকিব ভাইকে স্যার কাঁদতে দেখছি…। বুকটা ফাইট্যা যাইতেছিল। এইবার স্যার তার মুখে হাসি দেখতে চাই। মাশরাফি ভাই স্যার আজব মানুষ। তার কথা শুনলেও ভালো লাগে। কী তার মিষ্টি কথা। তার হাসিটা দেখছেন। স্যার আইজ বাংলাদেশ জিতব তো? আপনার কি মনে হয়?

ছেলে দুটোর দেশাত্ববোধ দেখে যারপর নাই অবাক হলেন আসাদুজ্জামান। কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আসো দোয়া করি আজ বাংলাদেশ যেন এশিয়া কাপে জিতে।

ছেলে দুটো সত্যি সত্যি দুহাত তুলে মুনাজাতের ভঙ্গি করল। আসাদুজ্জামানও তাদের সাথে নিজেকে যুক্ত করলেন, হে আল্লাহ, ইয়া মাবুদ আজ বাংলাদেশ যেন এশিয়া কাপের ফাইনালে জয় পায়। ইয়া মাবুদ…।

হঠাৎ করেই আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা শুরু হল। ফর্সা আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল। শুধু বৃষ্টি নয় ঝড়ও আসবে। সাথে সাথে ফোনের পর ফোন আসতে থাকল। প্রথম ফোন করলেন লালমাটিয়া থেকে সৌরভ জাহাঙ্গীর। আসাদুজ্জামানের ব্যবসায়িক পার্টনার। ভাই সব কিছু তো দেখা যাচ্ছে মাটি হয়ে যাবে। যেভাবে আকাশ অন্ধকার করেছে তাতে তো খেলা হবে না। খেলা না হলে তো ভাই পয়েন্ট ভাগাভাগি হয়ে যাবে। বাংলাদেশ ভারত দুই দেশকেই চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হবে। আমরা তো ভাই সেটা চাই না। আমরা খেলতে চাই। তারপর যা হবার তাই হবে….।

সৌরভের কথার সাথে সুর মিলিয়ে আসাদুজ্জামান বললেন, আমারও একই কথা। কিন্তু পরিস্থিতি যা বলছে তাতেতো খেলা হবে কিনা সন্দেহ। মোবাইলে কেউ ফোন করেছে। তাই আসাদুজ্জামান বললেন, সৌরভ সাহেব আমার একটা ফোন এসেছে। আপনাকে পরে ফোন করতেছি।

সৌরভের লাইন কেটে দিলেন আসাদুজ্জামান। সাথে সাথে রিং বেজে উঠলো। উত্তরা থেকে বড় বোনের স্বামী আজগর চৌধুরী ফোন করেছেন। আসাদ, তোমার কী মনে হয়? আজ কী ফাইনাল খেলা হবে? আকাশের যা অবস্থা… তোমাদের বাসায় কি আসব?

একসাথে অনেক প্রশ্ন। আসাদুজ্জামান ব্যসত্ম হয়ে বললেন, দুলাভাই আমার মন বলতেছে এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলা হবেই। ঝড়বৃষ্টি থেমে যাবে। আমাদের বাসার আয়োজনও চলবে। আপনি আপাকে নিয়ে আসেন।

আসাদুজ্জামানের কথা শেষ হতে না হতেই আজগর চৌধুরী উৎকণ্ঠার সুরে বললেন, আসাদ খেলা মনে হয় হবে না। টিভিতে স্ক্রল দিচ্ছে মীরপুরে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে… রাখি আসাদ। ঝড়বৃষ্টি থেমে গেলে আবার ফোন করব।

আজগর চৌধুরী ফোন কেটে দেয়ার পর পরই ঝড়বৃষ্টির দাপট বেড়ে গেল। রান্নাঘর থেকে দৌঁড়ে এলেন রাশেদা। আসাদুজ্জামানকে প্রশ্ন করলেন, অ্যাই ফাইনাল খেলা কি শেষ পর্যনত্ম হবে? কত আশা করেছিলাম। আজকের খেলায় বাংলাদেশ জিতবে। ড্রয়িংরুমে বড় টিভিতে খেলা দেখব আর আড্ডা দিব। ইস আনন্দটাই মাটি হয়ে গেল।

রাশেদার গলা ধরে এসেছে। পাশের ঘরে চলে গেলেন। ঝড়ের দাপট বেড়ে গেছে। আসাদুজ্জামান অসহায়ের মতো নতুন টেলিভিশন সেটের দিকে তাকিয়ে আছেন। স্ক্রলে ভাসছে… মীরপুরে ঝড়বৃষ্টি… এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলা নিয়ে অনিশ্চয়তা… রাত সাড়ে আটটার মধ্যে খেলা শুরু না হলে ওভার কমে যাবে। সাড়ে ১০টার মধ্যে খেলা শুরু করা না গেলে দুই দলকেই চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হবে।

ঝড়বৃষ্টি থেমে গেছে। কিন্তু অনিশ্চয়তা কাটেনি। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ঐ একই খবর দিচ্ছে- রাত সাড়ে ৮টার মধ্যে খেলা শুরু করা না গেলে ওভার কমে যাবে। সাড়ে ১০টার মধ্যে খেলা শুরু না হলে উভয় দলকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হবে। ড্রয়িংরুমে একা বসে আছেন আসাদুজ্জামান। হঠাৎ পুরনো ঢাকা থেকে জাহেদুল ইসলামের ফোন এলো। জাহেদ আসাদুজ্জামানের ভার্সিটি জীবনের বন্ধু। আজ তারও আসার কথা ছিল। বৃষ্টির কারণে আসতে পারেনি।

ফোনে জাহেদুল বেশ উত্তেজিত- দোসত্ম এইটা কি হইল? বৃষ্টি আর আসার সময় পাইল না। শেষ পর্যনত্ম খেলা না হলে দুই দলকেই নাকি চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হবে। আমরা তো ভাই এইটা চাই না। আমরা খেলতে চাই। বাংলাদেশকে এখন আর কেউ দাবায়া রাখতে পারবে না। খেলা যদি হয় তাহলে ইন্ডিয়া হারবেই…

বলেই ফোন কেটে দিল জাহেদ। কোন ফাঁকে রাশেদা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তা টেরই পাননি আসাদুজ্জামান। রাশেদা নতুন টিভির দিকে তাকিয়ে আছেন। মৃদুস্বরে স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন- খেলা তাহলে হবে না?

তাই তো মনে হচ্ছে।

তাহলে কেউ তো আসবেও না। ইস কত আশা করেছিলাম সবাই আসবে। আড্ডা হবে। গল্প হবে… আচ্ছা এই যে এতো রান্না করলাম তার কি হবে?

সদর দরজায় কলিং বেল বাজছে। কাজের মেয়েটা দরজা খুলে দিল। ড্রয়িংরুম থেকেই কে এসেছে জানতে চাইলেন রাশেদা।

সাথে সাথে ধীর পায়ে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়াল পাশের বাসার কাজের ছেলেটি। ওর নাম জালাল। আসাদুজ্জামান জিজ্ঞেস করলেন, জালাল বল… কোনো কাজে এসেছ? জালাল ইতসত্মত করে বলল, আমাদের স্যার পাঠিয়েছেন। তিনি জানতে চাচ্ছেন ক্রিকেটের ফাইনাল খেলাটা কি হবে?

আসাদুজ্জামান অবাক হয়ে বললেন, টিভিতে তো লেটেস্ট খবর দিচ্ছে। তোমার স্যারকে টিভি দেখতে বলো।

আমাদের টিভি একটু আগে ঝড়ের সময় হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেছে। তাই স্যার বললেন, আপনাদের বাসায় কি খেলা দেখা যাবে?

জালালের কথা শুনে আসাদুজ্জামান খুশিতে হৈচৈ করে বললেন, খেলা দেখা যাবে না মানে? কোথায় তোমার স্যার…? চলতো দেখি।

জালালকে নিয়ে আসাদুজ্জামান বেরিয়ে গেলেন এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন পাশের বাসার কামাল আহমেদকে নিয়ে। পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকেন অথচ ভাব বিনিময়ও হয় না। এই নিয়ে কথা বলতে বলতেই আসাদুজ্জামানের ফ্ল্যাটে ঢুকলেন কামাল সাহেব- কি যে লাইফ মেইনটেইন করছি রে ভাই। একদম সময় পাই না। খেলাটা কি শেষ পর্যনত্ম হবে? দেখেন তো ঝড়বৃষ্টি আসার আর সময় পেলো না। শুনতেছি শেষ পর্যনত্ম খেলা না হলে দুই দেশই নাকি গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হবে। এইটা তো ভাই আমরা চাই না। আমরা খেলতে চাই। তারপর যা হবার তাই হবে।

সদর দরজায় আবার কলিং বেল বাজছে। আসাদুজ্জামান নিজেই দরজা খুলে দিয়ে অবাক। উপরতলা থেকে খোরশেদ আলম এসেছেন। আসাদুজ্জামানকে দরজা খুলতে দেখে ব্যসত্ম হয়ে বললেন, আপনার বাসার টিভি কি ঠিক আছে? ঝড়ের সময় আমাদের দুটো টিভিই নষ্ট হয়ে গেছে। ছাদে খেলা দেখার ব্যবস্থা করেছিলাম। বড় পর্দার আয়োজনও করা হয়েছিল। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু ঝড়বৃষ্টিতো সব লণ্ডভণ্ড করে দিল। শুনলাম আপনি নাকি খেলা দেখার জন্য নতুন টিভি আনছেন। তাই ভাবলাম আপনার বাসায়ই খেলা দেখি…

বলতে বলতে নিজেই ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়ালেন খোরশেদ আলম। আসাদুজ্জামান একটা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কারণ কামাল আর খোরশেদ দুজন বিপরীত মুখী রাজনৈতিক দলের নেতা। কেউ কাউকে পাত্তা দেন না। একজন অন্যজনের শুধুই বিরোধীতা করেন। কবে তারা দুজন মুখোমুখি হয়েছিলেন এটাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না।

কিন্তু না, অপ্রীতিকর কিছুই ঘটলো না। বরং দুজন দুজনকে দেখে অবাক হয়ে কুশল বিনিময় করলেন। পাশাপাশি বসে আমাদের ক্রিকেট, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ, মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক, মুসত্মাফিজুরসহ জাতীয় দলের ক্রিকেট তারকাদের নিয়ে খোশগল্পে মেতে উঠলেন।

আসাদুজ্জামান আর রাশেদা যারপরনাই অবাক। তাদের চোখেমুখে বিস্ময়, শুধুই বিস্ময়। রাশেদা স্বামীর কাছে জানতে চাইলেন, এটা কিভাবে সম্ভব হল? তেল আর জল মিশে গেল?

আসাদুজ্জামান গর্বের ভঙ্গিতে বললেন, এর নাম ক্রিকেট। আমাদের অহংকার। আমাদের ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বাংলাদেশের ক্রিকেট যেখানে, সেখানে সবাই একসাথে দাঁড়াবে এটাই এখন বাসত্মবতা।

আসাদুজ্জামানের ড্রয়িংরুম সেদিন শেষ পর্যনত্ম একটা মিনি স্টেডিয়ামে পরিণত হয়েছিল। খবর ছড়িয়ে পড়েছিল পরস্পর বিরোধী দুই জনপ্রিয় নেতা একসাথে বসে টিভিতে বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা দেখছেন। তাই ফ্ল্যাটবাড়ির অন্য সদস্যরাও ছুটে এসেছিলেন একসাথে বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা দেখতে। এ যেন এক মহামিলন। বাংলাদেশের ক্রিকেটের পক্ষেই এটা সম্ভব। সেদিন বাংলাদেশ জিতেনি। কিন্তু জিতেছে দেশপ্রেম। এটা এশিয়া কাপ জেতার চেয়েও বড় কিছু। জয় হোক বাংলাদেশের ক্রিকেটের। জয় হোক বাংলাদেশের। গুডলাক বাংলাদেশ।