Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

স্থপতি গড়ার কারিগর

ড. মো: জাকিউল ইসলাম। বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য স্থপতি। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগ থেকে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি মাস্টার্স সম্পন্ন করেন আমেরিকার অস্টিন শহরের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস থেকে। ১৯৯৯ সালে জাকিউল ইসলাম দেশে এসে বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। ২০০৫ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৯ সালে তিনি দেশে ফিরে এসে আবারও যোগ দেন বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগে। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগে প্রফেসর হিসেবেই দায়িত্ব পালন করছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি স্থাপত্য চর্চা করে যাচ্ছেন নিয়মিত। তার আরেকটি পরিচয় তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ ঢাকা শহরে শিশুদের নিয়ে গবেষণা করছেন। ভবনের নকশায় কীভাবে পর্যাপ্ত আলো, বাতাস ও জায়গা রাখা যায় এ বিষয়টি নিয়ে তার বিস্তর ভাবনা রয়েছে। এছাড়া ঢাকা শহরে যেভাবে বসতি নির্মাণ হচ্ছে তাতে করে শিশুদের খেলার জায়গা বিনষ্ট হচ্ছে। এসব বিষয় নিয়েও তিনি কাজ করছেন। স্থাপত্য বিষয় পড়ানো ও নকশা করার পাশাপাশি তিনি তার কাজের বেশির ভাগ সময় ব্যয় করছেন শিশু বিষয়ক গবেষণার কাজে। এবার শাহ সিমেন্ট সুইট হোমে তাকে নিয়েই প্রতিবেদন। লিখেছেনÑ মোহাম্মদ তারেক।
আর্কিটেক্ট ড. মো: জাকিউল ইসলাম, ইট, কাঠ, বালু ও কংক্রিটের মাঝে খুঁজে ফেরেন প্রকৃতির সান্নিধ্য। আর তাই তার প্রতিটি স্থাপনায় থাকে সবুজের ছোঁয়া। প্রতিটি ডিজাইনের ক্ষেত্রে আলো, বাতাস, সবুজ সহ প্রকৃতিকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। চার ভাইয়ের মধ্যে সেঝ আর্কিটেক্ট জাকিউল ইসলাম। তার গ্রামের বাড়ি পাবনা জেলায়। কিন্তু জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। জাকিউলের বাবার নাম মরহুম সিরাজুল ইসলাম। তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। মা মরহুম ইফ্ফাত আরা গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই আঁকা আঁকির প্রতি ছিল তার প্রচÐ ঝোঁক। যেখানেই ছবি আঁকার প্রতিযোগিতা হতো সেখানেই তাকে দেখা যেত। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। বাবার প্রজেক্টের বিভিন্ন কাজ দেখে ছোটবেলা থেকেই আর্কিটেকচারের প্রতি তার আগ্রহ জন্মায়। সেই আগ্রহ থেকেই আজ তিনি হয়েছেন সফল একজন স্থপতি। গর্ভনমেন্ট ল্যাবরেটরী হাইস্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন ১৯৮৪ সালে। ১৯৮৬ সালে ঢাকা কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগে। ১৯৯৪ সালে তিনি ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। পাস করে বের হওয়ার পর পরই মো: জাকিউল ইসলাম যোগ দেন খ্যাতিমান স্থপতি মাযহারুল ইসলামের অধীনে বাস্তুক লাবিদ-এ। সেখানে তিনি এক বছর কাজ করেন। এরপর ১৯৯৭ সালে স্কলারশিপ নিয়ে চলে যান আমেরিকার অস্টিন শহরের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস-এ। সেখান থেকে তিনি মাস্টার্স ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি ন্যাচারাল লার্নিং ইনিশিয়েটিভ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে প্রফেসর রবিন মুরের অধীনে কাজ করেন। ১৯৯৯ সালে দেশে এসে জাকিউল ইসলাম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগে লেকচারাল হিসেবে যোগ দেন। ২০০৫ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৯ সালে দেশে ফিরে এসেই তিনি আবারও যোগ দেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগে। বর্তমানে এই স্থপতি বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগে প্রফেসর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের তিনি স্থাপত্যের নানা বিষয়ে হাতে কলমে শিক্ষা দিচ্ছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি স্থাপত্য চর্চাও চালিয়ে যাচ্ছেন।
ড. মো: জাকিউল ইসলাম নিজের কোনো প্রতিষ্ঠান গড়েননি। তিনি ব্যক্তিগত ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন স্থাপত্য শিল্পে। ইতিমধ্যে তিনি দেশের নামকরা অফিস বিল্ডিং, গামের্ন্টস ভবন, ক্লিনিক, স্কুল, ভ্যাকেশন হাউস সহ অসংখ্য ভবনের ডিজাইন করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছেÑ মতিঝিলে করিম পাইপস অফিসের ইন্টেরিয়র, আশুলিয়ায় কিছু গামেন্টস ভবন, প্রগতি সরনিতে রহমান টাওয়ার, বুয়েট ক্যাম্পাসে ১৮ তলা রেসিডেন্সশিয়াল টাওয়ার, টঙ্গী বোর্ড বাজারে জাগো ফাউন্ডেশনের স্কুল, টাঙ্গাইলের মোমিন নগরে ফেরদৌস-নাসির চ্যারিটি ক্লিনিক, কোনাবাড়ির শামসুদোজার ভ্যাকেশন হাউস, উত্তরার বেশ কয়েকটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবন সহ অসংখ্য ভবনের ডিজাইন করেছেন। স্থপতি জাকিউল ইসলাম তার সব ধরনের কাজ স্থাপত্য নীতি ও রাজউকের নিয়ম মেনেই করেন। নিয়ম মানার ক্ষেত্রে কোনো আপস করেন না গ্রাহকদের সাথে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য ভবনের ভেতরে ও বাইরের দিকে এবং নকশায় ফাঁকা জায়গা রেখে সেখানে গাছ লাগানোর জন্য তিনি যথেষ্ট জায়গা রাখেন।
Vacation-House-from-southস্থাপনার কাজে তার রয়েছে অসম্ভব সাফল্য। প্রতিযোগিতামূলক কাজে অংশ নিয়ে তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন। যার ফলশ্রæতিতে তার সাফল্যের ঝুড়িতে জমা হয়েছে সেরা কর্মের স্বীকৃতি। ২০০৫ সালে আইএবি এবং বার্জার এর উদ্যোগে ডিজাইন প্রতিযোগিতায় বেষ্ট ইয়ং আর্কিটেক্ট অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন ফেরদৌস-নাসির চ্যারিটি ক্লিনিক এর জন্য। আইএবি এবং বার্জারের উদ্যোগে বার্জার অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সিলেন্স ইন আর্কিটেকচার ২০১৭ তে ভ্যাকেশন হাউস ডিজাইনের জন্য কমেন্ডশান অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন ড. মো: জাকিউল ইসলাম। যার নকশা প্রণয়নের পেছনে রয়েছে তার সুদূর প্রসারি চিন্তা ভাবনা।
স্থপতি জাকিউল ইসলাম বলেন, এই বাগান বাড়িটি (ভ্যাকেশন হাউস) ঢাকার উত্তরে কোনা বাড়িতে অবস্থিত। জমির মালিক এখানে যাতায়ত করেন মূলতঃ শহরের কোলাহল থেকে কিছুটা সময় দূরে থাকার জন্য। তিন বিঘার এই জমিটিতে আছে মনোরম প্রাকৃতিক একটি পরিবেশ। জমিটির উত্তর পাশের নিচু জমিতে বর্ষার সময় প্লাবিত হয়ে থাকে যা একটি সুন্দর দৃশ্যের সৃষ্টি করে। বাগান বাড়ির মালিকের মূল চাহিদা ছিলো খুবই সাধারণ দুটি রুম, যেখান থেকে তিনি এই জমির প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগ করতে পারবেন। আমরা এই বাড়ির নকশাটি শুরু করার আগে তিনটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেই। সিদ্ধান্ত গুলো হচ্ছে-১. বাগান বাড়িটি এমন ভাবে নকশা করা হবে যে এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ যাতে করে নষ্ট না হয়। ২. জমির উত্তর দিকের সুন্দর দৃশ্যটি যেনো বাগান বাড়ি থেকে উপভোগ করা যায়। ৩. যেহেতু জমির মালিক বাগান করতে পছন্দ করেন সেহেতু বর্তমানে সেখানে সবজির বাগান আছে, সেই জায়গাটা নষ্ট করা যাবে না। উপরের সিদ্ধান্ত গুলোর উপর ভিত্তি করে আমরা যে বাগান বাড়িটি তৈরি করেছি সেটি একটি প্যাভেলিয়ন টাইপ বাড়ি। বাড়িটির চারিদিকে বারান্দা আর দুইটি রুমের মাঝখানে একটি বড় বারান্দার মতো স্থান তৈরি করা হয়েছে। বাড়ির সবাই জড়ো হয়ে একসাথে বাইরের প্রকৃতিকে উপভোগ করতে পারে। যেহেতু এই এলাকায় পানি সরবরাহ নেই সেহেতু এখানকার লোকেরা মাটির নিচ থেকে পানি পাম্পের সাহায্যে উত্তোলন করে থাকে। এই জন্য অনেক খরচ হয়। এই খরচটি কমানোর জন্য আমরা এই বাগান বাড়িটি এমনভাবে নকশা করেছি যাতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা যায়। এই বৃষ্টির পানি দিয়ে গোসল করা এবং বাগানে সেচ দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও বাড়িটির সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় চারটি সোলার প্যানেলের মাধ্যমে। অর্থাৎ এই বাগান বাড়িটি এক স্বনির্ভর বাড়ি, যা পানি এবং বিদ্যুৎতের জন্য কারো উপর নির্ভর করে না। বাড়িটির এমন ভাবে নকশা করা হয়েছে যে, বাড়িটি গরম কালে ঠান্ডা এবং শীতকালে গরম থাকে। সর্বোপরি এই বাড়িটির স্বকীয়তা আছে যা পশ্চিমা ধারার বাগান বাড়ি গুলো থেকে ভিন্ন।
শিক্ষকতা, ভবন নকশার কাজ ছাড়াও তিনি ঢাকা শহর ও শিশু বিষয়ক গবেষণার কাজ দীর্ঘদিন যাবৎ করছেন। তিনি মনে করেন স্থপতিদের কাজ শুধু নকশা করা নয়, নগরের প্রত্যেক মানুষের জীবনটাও যেন সুন্দর ভাবে চলে তা নিয়ে ভাবা। পেশার বাইরে জাকিউলের বড় শখ হলো ছবি তোলা ও বেড়ানো। এ পর্যন্ত তিনি আমেরিকা, মেক্সিকো, মরক্কো, ইংল্যান্ড, ইতালি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, মিশর, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ভারত, নেপাল সহ অনেক গুলো দেশ ভ্রমণ করেছেন। ড. জাকিউল ইসলাম ১৯৯৬ সালে বিয়ে করেন। স্ত্রীর নাম তাসমিন দোজা। তিনি পেশায় বাংলাদেশ বিমানের বৈমানিক। এই দম্পতি দুই সন্তানের জনক-জননী। বড় মেয়ে নুমা ইসলাম, ছোট মেয়ে রয়া ইসলাম। স্থাপত্য বিভাগে শিক্ষক ও স্থপতি হিসেবে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো শিক্ষার্থীদের ভালো স্থপতি হিসেবে গড়ে তোলা এবং শিশুদের নিয়ে আরো ব্যাপক পরিসরে কাজ করে তাদের জীবন যাপন, চলাফেরা যেন স্বাভাবিক হয় সেই বিষয়ের উন্নয়ন করা।
ছবি: মুনতাসির তানভীর