Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

সাইফ উল হকের স্থাপত্য ভাবনা

মোহাম্মদ তারেক

স্থাপত্য হলো সেই শিল্প, প্রতি মুহূর্তের অভিজ্ঞতায় যা আমাদের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়। এই শিল্প কেবল চোখের দেখার নয়, আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের সকল গ্রাহ্যতাই তাকে অনুভব করে। যে কোনো নির্মাণই স্থাপত্য নয়, যদি না প্রকাশ হয় তার অভিবাস থেকে, তার সংস্কৃতি, জলবায়ু আর ভূমিরূপ থেকে। কথাগুলো বললেন স্থপতি সাইফ উল হক। চার ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড় স্থপতি সাইফ উল হক। তার গ্রামের বাড়ি বরগুনা জেলায়। কিন্তু জন্ম ঢাকায়। সাইফ উল হকের বাবার নাম আব্দুল হক। তিনি সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। মা জাকিয়া সুলতানা গৃহিণী। ছোটবেলা থেকে আঁকাআঁকির প্রতি ছিল প্রচণ্ড নেশা। গল্পের বই পড়া ছিল তার পছন্দের বিষয়। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প পড়তে তার ভীষণ ভালো লাগত। স্থাপত্যে অধ্যয়নের সময় তিনি উম্মাদ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ‘চেতনা’তেও স্থপতি মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে কাজ করেন। ছোটবেলা থেকে স্থপতি সাইফ উল হকের ইচ্ছা ছিল স্থপতি হওয়ার। তার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে।

আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন ১৯৭৫ সালে। ১৯৭৭ সালে নটর ডেম কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগে। স্থাপত্য নিয়ে পড়াশোনা চলাকালীন তার সহপাঠী বন্ধুদের মধ্যে আছেন স্থপতি খালেদ আশরাফ, জালাল আহমেদ, এহসান খান, সালাউদ্দিন আহমেদ ও রাজিউল আহসান। এরা সবাই প্রতিষ্ঠিত আর্কিটেক্ট। একমাত্র রাজিউল আহসান পৃথিবীতে নেই। ১৯৮৩ সালে তিনি ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। পাস করে বের হওয়ার পরই তিনি কাজী খালেদ আশরাফ, খালেদ নোমান ও জালাল আহমেদ এই তিন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘ডায়াগ্রাম আর্কিটেক্টস নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম।

দুই বন্ধু খালেদ আশরাফ ও খালেদ নোমান বিদেশে যাওয়ার ১৯৯৬ সাল পর্যনৱ জালাল আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিষ্ঠানের দেখাশুনা করেন সাইফ উল হক। এরপর ১৯৯৭ সালে স্ত্রী স্থপতি সালমা পারভীন খানকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘সাইফ উল হক স্থপতি’ নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। ধানমন্ডিতে সুন্দর অফিস সাজিয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠানে বেশ কয়েকজন অভিজ্ঞ স্থপতিসহ মোট ১০ জন কর্মী কাজ করছেন। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি দেশের নামকরা ট্রেনিং সেন্টার, লাইব্রেরী, ছাত্রাবাস, শিক্ষা প্রকল্প, পোশাক কারখানা, ব্যাংক, অফিস বিল্ডিংসহ অসংখ্য ভবনের ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করেছে। তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামে গোবিন্দ গুণালঙ্কার ছাত্রাবাস। দুই পর্যায়ে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ সালে নির্মিত হয় এ প্রকল্পটি। প্রকল্পের স্থানটির বিদ্যমান বৈশিষ্ট্য চাহিদার যোগান দেয়া এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের আলোকে একটি ছাত্রাবাসের রূপ দেয়া হয় এটিতে। কীভাবে এক সঙ্গে অনেক ছাত্রাবাস করবে এবং কি হবে সেই বাসস্থানের রূপ এই ভাবনাগুলোকে নিয়ে রচিত হয় তার এই কর্মটি। ২০০১ সালে গোবিন্দ গুণালঙ্কার ছাত্রাবাস প্রকল্পের ডিজাইনের জন্য ভারতের জে কে সিমেন্ট প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত বৎসরের সেরা স্থপতি পুরস্কার ১৯৯৯ এর প্রশংসা পুরস্কার লাভ করেন।

তার আরেক উল্লেখযোগ্য প্রকল্পের মধ্যে আছে কেরানীগঞ্জে ‘আর্কিডিয়া শিক্ষা প্রকল্প’। তার এই প্রকল্পটি একটি বহুমাত্রিক উপযোগী কাঠামো। এটি সকালে শিশুদের স্কুল, অপরাহ্ণে মহিলাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং সাপ্তাহিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে ফরিদপুরের ব্র্যাক ট্রেনিং সেন্টার, যশোরের বাঁচতে শিখা ট্রেনিং সেন্টার, বগুড়ায় ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদদের আবাস ভবন, ধানমন্ডিতে আলিয়ঁস ফ্রসেস-এর লাইব্রেরীর ইন্টেরিয়র, কাকরাইল ও ধানমন্ডিতে এএনজেড গ্রীন লেইজ ব্যাংকের ইন্টেরিয়রসহ অসংখ্য ভবনের ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র।

বর্তমানে ডিজাইনের কাজ চলছে চট্টগ্রামে কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনের পোশাক কারখানা এবং শ্রমিকদের আবাসন ভবনের। সাইফ উল হক তার সব ধরনের কাজ স্থাপত্য নীতি ও রাজউকের নিয়ম মেনেই করেন। স্থাপত্যের অনুশীলনের পাশাপাশি এআইইউবি ও স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ-এ খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করছেন। বর্তমানে স্থপতি সাইফ উল হক বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের বেঙ্গল ইনস্টিটিউট-এ গবেষণা ও ডিজাউন বিভাগের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৯৪ সালে তিনি বিয়ে করেন। স্ত্রীর নাম সালমা পারভীন খান। তিনিও আর্কিটেক্ট। এই দম্পতি দুই সনৱানের জনক-জননী। সাইফ উল হক বলেন, আমরা একটি পরির্তনশীল পৃথিবীতে বসবাস করি। জন্ম থেকে মৃত্যু, পরিবর্তনের একটি অভিজ্ঞতা। মানুষের জীবনে এবং তার সৃষ্টিতে যেভাবে পরিবর্তন ঘটে তেমনি প্রকৃতিতেও ঘটে পরিবর্তন। স্থাপত্য মানুষের একটি কর্মকাণ্ড এবং এটিও পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনশীল পরিবেশে স্থাপত্য রচিত হয় এবং একই সঙ্গে পরিবেশের পরিবর্তন ঘটায় স্থাপত্য। আমাদের এই বৈচিত্র্যপূর্ণ পৃথিবীতে একক মানদণ্ড দ্বারা সকল স্থাপত্য বিচার করা হয়তো কিছুটা দুরূহ হতে পারে কিন্তু আমাদেরকে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য কর্মগুলোকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। কারণ এগুলো যাতে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করে। সৃজনশীল কাজের জন্য অনুপ্রেরণা অত্যনৱ গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের কাজগুলো অবশ্যই সবার জানার দরকার রয়েছে। যার ফলে সেগুলো বিচারিক প্রক্রিয়ায় অনৱর্ভুক্ত হতে পারে।

Shah-Cement-Projectতিনি আরও বলেন, আমরা আরেকটি পরিবর্তন লক্ষ্য করি। এটি হলো টেকসই। জীবনের জন্য স্থাপত্য। যদিও অনেক সময় এই পরিবর্তনটি অর্থনৈতিক উন্নয়নের বর্তমান ধারার বিপরীতে অবস্থান  নেয়। এর অন্যতম প্রতিপাদ্য হচ্ছে ব্যবহার কমান, পুনঃ ব্যবহার এবং পুনঃচক্রায়ন। এই পরিবর্তনটির প্রভাব স্থানীয় ও বৈশ্বরিক দুটিতেই। উন্নয়ন এখন টেকসই জীবনের একটি মুখোমুখি অবস্থান। জনসংখ্যার বৃদ্ধি এবং জীবন যাপনের ধারা পৃথিবীর ভবিষ্যৎকে বিপদের দিতে ঠেলে দিচ্ছে। বৈশ্বিক উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। স্থপতিরা পরিবর্তনের সহায়ক এবং পৃথিবীর বেশির ভাগ ভৌত পরিবর্তন স্থপতিদের কাজের সাথে সম্পর্কিত। আমাদের দেশের মানুষ নিজেদের জন্য উন্নত জীবনের প্রচেষ্টায় নিয়োজিত এবং স্থপতিরাও এই প্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মানুষের অনেক ভিন্নতাকে জীবনের সমৃদ্ধতা এবং অনেক ভিন্নতা জীবনের দৈনতা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যদিও একক মানকরণ অনেক কিছুর সমরূপ তৈরি করেছে এবং একই সঙ্গে অনেক সমাজের মাধ্যমে অনেক সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের উদ্ভাবন ঘটিয়েছে। এই একক মানকরণ ও স্থাপত্য কোনো ভাবেই অবস্থিতিকে বাদ দিয়ে ভাবা সম্ভব নয়। স্থাপত্য ব্যক্তি ও সমষ্টির উভয়ের সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের বহিঃপ্রকাশ। স্থাপত্যে সাংস্কৃতিক পরিচয় এরই অংশ। স্থাপত্য যেহেতু একটি সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশের দাবি রাখে এবং একই সাথে ভৌগোলিক কারণগুলো একটি বিশিষ্ট স্থাপত্যের সৃষ্টিতে ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রতিটি অবস্থিতি এক একটি কৌতূহল উদ্দীপক সৃজনশীল কর্মের অনুপ্রেরণা হতে পারে। বাংলাদেশের  আবহাওয়া, জলবায়ু, প্রকৃতিকে ঠিক রেখে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ডিজাইনের দিকে নজর দেন স্থপতি সাইফ উল হক। এই স্থপতি তার নিজের কাজ সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে করতে ভালোবাসেন। নিজের পেশার কাছে দায়বদ্ধ থেকে সেটাকে সততার সঙ্গে শেষ করতে চান।

স্থাপত্য নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে স্থপতি সাইফ উল হক বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা ঔপনিবেশিক উত্তর পরিচয় বিতর্ক হতে টেকসই বৈশ্বিক ভবিষ্যতের কথা নিয়ে এখন বেশি চিনিৱত। সেখানে ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠী তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে কীভাবে পৃথিবীর জীব বৈচিত্র্য টিকিয়ে রেখে ও সম্পদের সুষম ব্যবহারের মাধ্যমে একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনা করবে, সেটাই এখন প্রধান বিষয়। পরিবর্তন ও অবস্থিতির সঠিক অনুধাবন এই ভবিষ্যতের জন্য একটি লাগসই স্থাপত্য রচনার সহায়ক বলে আমি মনে করি। চাপিয়ে দেয়া অথবা অন্ধ অনুকরণ হতে আমরা সুবিবেচিত স্থাপত্যের দিকে অগ্রসর হতে পারি।