Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

সময়টাই মিউজিক ভিডিওর

সময়ের চাহিদা এটি। একসময় ক্যাসেটের ফিতায় শ্রোতারা গান শুনতো। এরপর এলো সিডি ডিভিডির প্রচলন। আর বর্তমান সময়ে স্মার্টফোনে ইউটিউব কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই গান শুনছেন সঙ্গীতপ্রেমীরা। তবে এখনকার সময়ে গান শুধু শোনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটা দেখারও বিষয়। আর তাইতো দিন দিন মিউজিক ভিডিও সঙ্গীতশিল্পী ও কলাকুশলীদের মধ্যে বেশ আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয় একসময় মিউজিক ভিডিও শুধু অ্যালবাম কিংবা গানের প্রমোশন হিসেবে ব্যবহার করা হলেও বর্তমানে এটা প্রফেশনাল হিসেবেই চাহিদা বাড়ছে। আর তাইতো একটি মাত্র গান এখনকার সময়ে ইউটিউবে আপলোড হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুএকদিনেই লাখ লাখ ভিউয়ারস হয়ে যায়।  এক্ষেত্রে শিল্পী একদিকে যেমনি শ্রোতাদের কাছে খুব সহজেই পৌঁছে যেতে পারেন, তেমনি অডিও কোম্পানি ও মডেলও জনপ্রিয় হচ্ছেন খুব দ্রুত। একটি মাত্র লিংকে ক্লিক করে শ্রোতারা খুব সহজেই এখন গান শুনছেন। বর্তমান সময়ে মিউজিক ভিডিওর অবস্থান কোথায়, মিউজিক ভিডিও নির্মাণে লগ্নিকৃত টাকা ফেরত আসে কি না, মানহীন মিউজিক ভিডিও সহ নানান বিষয়ে কথা বলার জন্য আনন্দ আলোতে এসেছিলেন এই সময়ের মিউজিক ভিডিও নির্মাতা রোম্য খান, তানিম রহমান অংশু এবং সঙ্গীতশিল্পী জয় শাহরিয়ার ও বেলাল খান। লিখেছেন সৈয়দ ইকবাল

আলোচনা শুরু হয় বর্তমানের মিউজিক ভিডিও নিয়ে। এখনকার সময়ে মিউজিক ভিডিও নির্মাণ থেকে শুরু করে সঙ্গীত অঙ্গনে একটা স্ট্রাকচার যে দাঁড়াচ্ছে সে বিষয়ে ইতিবাচক মন্তব্য তুলে ধরেন নির্মাতা রোম্য খান। তিনি বলেন, মিউজিক ভিডিওর জনপ্রিয়তার ফলে আমাদের সঙ্গীতাঙ্গণ একটা স্ট্রাকচার এ দাঁড়াচ্ছে। এটা প্রাথমিক অবস্থা বলা যায়। এখন একটি মিউজিক ভিডিওর জনপ্রিয়তা পেলে সেটার মূল্যায়ন হচ্ছে। আগে যেমন- মিউজিক ভিডিও শুধু অ্যালবাম কিংবা শিল্পীর প্রমোশনের জন্য নির্মাণ করা হতো, এখন কিন্তু তা নয়। এখন গুগল এডসেন্সের মাধ্যমে ইউটিউবে মিউজিক ভিডিওটি আপলোডের করে নির্দিষ্ট একটা ভিউয়ারসের পর টাকা পেতে শুরু করেছেন। এটা অবশ্যই আমাদের সঙ্গীতাঙ্গনের জন্য ইতিবাচক একটা দিক। তাই এখনকার সময়ে মিউজিক ভিডিও থেকে শিল্পী, নির্মাতা ও মডেলসহ সংশ্লিষ্ট সকলের আয় করা সম্ভব।

মিউজিক ভিডিও এই সময়ে নির্মাণের এক অন্যরকম আধুনিক মাধ্যম বলে উল্লেখ করেন শিল্পী জয় শাহরিয়ার। তিনি বলেন, এখনকার সময়ে নির্মাণে অনেক স্মার্ট এবং আধুনিক চিন্তা-ভাবনার সব ছেলেরা এসেছে। এমনকি প্রায় সকল নির্মাতাদেরই স্বপ্ন একদিন সিনেমা বানাবে। তাই তাদের মধ্যে থেকে যারাই একটি মিউজিক ভিডিও বানাচ্ছেন সেখানে ফিল্মের ছোঁয়া থাকছে। ফলে খুব সুন্দর দৃষ্টিনন্দন এবং ক্রিয়েটিভ কাজ হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে গত দুএক বছরে মানুষের মধ্যে ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন ইউজার বেড়েছে। ফলে মানুষ ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিনোদন নির্ভর হয়ে উঠছে। তাই ঐ যে আধুনিক একটি মিউজিক ভিডিও খুব সহজেই মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে এবং জনপ্রিয় হচ্ছে ফলে মিউজিক ভিডিওর চাহিদাও বাড়ছে। আর গান এখন শুধু দেখার বিষয় নয় কিংবা সিডি প্লেয়ারে অন করে আলাদা সময় বের করেও শোনার সময়টা নেই। ফলে মিউজিক ভিডিওই এখন সঙ্গীতের ভিন্ন এক মাধ্যম হয়ে উঠেছে।

সুন্দর এবং ক্রিয়েটিভ সব মিউজিক ভিডিওর কারণে দিন দিন শ্রোতাদের কাছে অন্যরকম জায়গা দখল করে নিচ্ছে। নির্মাতা তানিম রহমান অংশু বলেন, এখনকার সময়ে মিউজিকে ভিডিওর কারণে খুব দ্রুত একটি গান শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। কারণ এখন শুধু গান শোনার বিষয় নেই। এটা দেখারও বিষয়। তাই স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় মিউজিক ভিডিওটি খুব সহজেই শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। তাই আমরা নির্মাতারাও চেষ্টা করছি পেশাদারিত্বের মনোভাব নিয়ে মিউজিক ভিডিও বানানোর। সেই চেষ্টাটা থেকে দেশে প্রচুর ভালো মানের মিউজিক ভিডিও নির্মাণ হচ্ছে। এটা গাঙচিল বেশি নির্মাণ করছে। কারণ লগ্নিকৃত টাকাটা তারা রিটার্ন করছেন। হয়তো পুরোপুরি এখনো হয়ে উঠেনি। তবে গাঙচিল চেষ্টাটা অব্যাহত রাখছেন। এখন সামনের দিকে যখন টেলিফোন কোম্পানিগুলো (ফোরজি আসার পর) একটাকা পঞ্চাশ পয়সায় একেকটি মিউজিক ভিডিও দেখার সুযোগ করে দিবে তখন আরো এক্সক্লুসিভ মিউজিক ভিডিও নির্মাণ হবে। কারণ একেকটি গান দশ লক্ষ ভিউয়ারস হলে সেটা দশ পয়সা করে মিউজিক ভিডিওর কোম্পানি পেলেও কিন্তু অনেক টাকা হয়ে যায়। বর্তমানে গাঙচিল নির্মাতাদের ভিউয়ারসের উপর একটা নির্দিষ্ট পরিমান ভাগ দিয়ে থাকে। এটা অবশ্যই প্রফেশনালিজম-এর একটা অনেক বড় বিষয়। সামনে আরো অনেক স্ট্রাকচার তৈরি হবে বলে আমার বিশ্বাস। একটা সময় যেখানে মিউজিক ভিডিও গানের প্রমোশনে ব্যবহার করা হতো সেখানে বর্তমানে টাকা রিটার্ন পাচ্ছে। সামনে মোবাইল কোম্পানি, টেলিভিশন চ্যানেল থেকেও টাকা আসবে। কারণ প্রযুক্তি আরো উন্নত হওয়া মানে ইন্টারনেট দুনিয়া আরো বড় হবেই। সহজলভ্যও হবে।

বেলাল খান ভালো গানের মিউজিক ভিডিওর উপর জোর দিয়ে বলেন, একটি ভালো গানের মিউজিক ভিডিও ভালো হলে অবশ্যই দর্শকরা পছন্দ করেন। আর গানটা যদি ভালো না হয়, অনেক ভালো মিউজিক ভিডিও হলেও সেটা দর্শক পছন্দ করেন না। বেলাল খানের সঙ্গে মিল রেখে জয় শাহরিয়ারও একই কথা বলেন। আর রোম্য খান বলেন, অনেক জনপ্রিয় গানের মিউজিক ভিডিও অনেক পরে নির্মাণ হয়েছে। যেমন- বাচ্চু ভাই (আইয়ুব বাচ্চু) একদিন আমাকে বললেন, সেই তুমি গানটির মিউজিক ভিডিও করতে। তাই সময়ের সঙ্গে আমাদের সবকিছুই এগুতে হবে। এখন যেহেতু ট্রেন্ডটাই মিউজিক ভিডিওর। তাই নতুন পুরাতন সব গানেরই মিউজিক ভিডিও হতে পারে। কারণ এতে করে তাড়াতাড়ি দর্শক শ্রোতাদের কাছে পৌঁছানো যায়।

আড্ডার এই পর্যায়ে আসে মানহীন মিউজিক ভিডিও নিয়ে আলোচনা। এই বিষয়ে শুরুতেই তানিম রহমান অংশু বলেন, আসলে কোনটা যে ভালো আর কোনটা মানহীন সেটার বিচার কিন্তু দর্শক করবেন। ভিউয়ারস দিয়ে কিন্তু শিল্পের মান বিচার করা যায় না। অনেক গান আছে যেগুলোর ভিউয়ারস লাখ লাখ কিন্তু সেটা সবশ্রেণির দর্শকদের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। আবার পৃথিবীতে অনেক সিনেমারই দর্শক খুব কম ছিল কিন্তু সেটা দেখা গেছে অস্কার পেয়েছে। তাই মান এবং মানহীন বিবেচনা করার বিষয় নিয়ে অনেক বিষয় আছে। যেটা আমার কাছে প্রিয় সেটা দেখা গেছে অন্যজনের কাছে ভালো নাও লাগতে পারে। কথা হচ্ছে শিল্পমান। এখন শিল্পমান কিন্তু ভিউয়ারস দিয়ে বিবেচনা করা যাবে না। রোম্য খান বলেন, ভিউয়ারস দিয়ে আসলে জনপ্রিয়তার বিবেচনা করা ঠিক না। ভিউয়ারস দিয়ে হয়তো আয় করা সম্ভব। তবে শিল্প মানটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

জয় শাহরিয়ার বলেন, একটা গানের হয়তো পঞ্চাশ লাখ ভিউয়ারস আছে। সেটাকে অবশ্যই খুব হালকাভাবে দেখা যাবে না। কারণ পঞ্চাশ লাখ ভিউয়ারস যে শিল্পীর গানের সেটা তো ঐ শিল্পীর জন্য অনেক বড় পাওয়া। অনেক সময় দেখা যায় অনেক গানের ভিউ বেশি কিন্তু গানটা বেশি ভালো হয় নাই। আবার অনেক গানের ভিউয়ারস কম কিন্তু গানটা দেখা গেছে অনেক সুন্দর। এখন আসলে কোন গান কখন যে শ্রোতারা টানে সেটা বুঝাও মুশকিল। তবে পজিটিভ জিনিসটা নেয়াই ভালো। দর্শকদের প্যাটার্ন এর উপর গানের ভিউয়ারস নির্ভর করে বলে মন্তব্য করেন রোম্য খান। তিনি বলেন, আমাদের দেশে ক্ল্যাসিক্যাল সঙ্গীতের যে একটা বিশাল শ্রোতা আছে সেটা কিন্তু বোঝা গেছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে গিয়ে। সেখানে একটা গ্রুপ আড্ডা দিতে গেছে সেটা ঠিক। কিন্তু ঐ সঙ্গীতের অনেক ভিউয়ারস অবশ্যই আছে। তাই কোন গান কোন দর্শকদের ভালো লাগবে সেটা বলা মুশকিল। তবে সব গানেরই আলাদা আলাদা ভিউয়ারস আছে। বেলাল খান বলেন, ভিউয়ারস দিয়ে দর্শকপ্রিয়তা মাপা যায় না এটা ঠিক। তবে একজন শিল্পীর জন্য অবশ্যই বিষয়টা একটা ফ্যাক্টর। এখন কথা হচ্ছে দর্শকদের গানটা ভালো লেগেছে কি না সেটা। আমরা অনেক সময় স্টেজশো করতে গিয়ে যখন কোনো গানের রিক্যুয়েস্ট পাই তখন দেখা যায় গানটির লাখ-লাখ ভিউয়ারস আছে। অনেক জনপ্রিয় শিল্পীর গানে ইউটিউবে ভিউয়ারস কম। তার মানে উনি কী জনপ্রিয় নয়? অবশ্যই না। তানিম রহমান অংশু অবশ্য একটু অন্যভাবে এই বিষয়ে মতামত দিলেন। তিনি বলেন, ভিউয়ারসের চেয়ে আমি গান এবং মিউজিক ভিডিওর কোয়ালিটিকে প্রাধান্য দিবো। পৃথিবীতে অনেক মানহীন ভিডিও কিংবা ফিকশনের অনেক ভিউয়ারস আছে, তার মানে আমি সেটাকে জনপ্রিয় বলবো না। আমি কোয়ালিটি এবং শিল্পমান সম্পন্ন কাজকেই এক্ষেত্রে এগিয়ে রাখবো। আড্ডায় এবার উঠে আসে মিউজিক ভিডিও নির্মাণে লগ্নিকৃত টাকা উঠে আসার বিষয় নিয়ে। প্রথমেই জয় শাহরিয়ার বলেন, একটি গান তৈরি করা এবং মিউজিক ভিডিও বানানোর যে খরচ তা এখনো পুরোপুরি উঠে আসেনি। তবে এখন যে প্রসেসটায় আমরা আছি তা ইতিবাচক। ফোর জি চলে এলে এটা আরো ভালো হবে। মিউজিক কোম্পানি থেকে শুরু করে শিল্পী কলাকুশলী সকলে লাভবান হবে। এতে এখন যারা কাজ করে যাচ্ছেন সবাই ইনভেস্টের মধ্যেই আছেন। গত কয়েক বছর থেকে শুধু চলতি বছরের কথা যদি বলা হয় তাহলে ইন্ডাস্ট্রি অনেক এগিয়েছে। এটা দু’তিন বছর পর আরো এগুবে। তানিম রহমান অংশু বলেন, জয় শাহরিয়ারের কথায় আমি একমত। তবে আগের চেয়ে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি একটা প্রপার স্ট্রাকচারের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এখন কয়েকটি অডিও কোম্পানির দেখাদেখি অন্যরাও ভালো মিউজিক ভিডিও নির্মাণ করছেন। এটা অবশ্যই ইন্ডাস্ট্রির জন্য ইতিবাচক দিক। বেলাল খান বলেন, কয়েক বছর আগেও অডিও ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা একেবারেই খারাপ ছিল। সিডি ডিভিডি বিক্রি হতো না বললেই চলে। তবে এখন ইউটিউবে আমাদের মিউজিক ভিডিওর কল্যাণে শ্রোতা ফিরেছে। এটা অবশ্য আমাদের অডিও ইন্ডাস্ট্রির একটা ট্রানজিট পিরিয়ড বলা যায়। কয়েক বছর পরই এর আসল রূপ দেখা যাবে। রোম্য খান বলেন, এখনকার সময়ে আমরা যে প্রসেস-এ আছি এটা অবশ্যই ইতিবাচক একটা দিক। তবে বিশ্বে এই প্রসেসিংগুলো বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে হয়ে থাকে। আমাদের দেশে এটা এখনো চালু হয়নি। আমার বিশ্বাস খুব শিগগিরই এই প্রক্রিয়া চালু হবে। তার আগে আমাদের সকলের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টাটা চালিয়ে যেতে হবে।