Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

সংসারে আমি একজন কমপ্লিট মা হয়ে যাই

-ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের আইন অঙ্গনে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজের নাম বেশ জনপ্রিয়। শুধু জনপ্রিয় বললে ভুল হবে। জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে সফল আইনজীবি হিসেবেও রয়েছে তার বেশ সুনাম। সদা প্রাণবনত্ম ও কাজের প্রতি নিষ্ঠাবান এই আইনজীবি নিজের সফলতার নানান গল্প শেয়ার করেছেন আনন্দ আলো’র সঙ্গে। নারী দিবসের বিশেষ সংখ্যায় আনন্দ আলো’র মুখোমুখি হয়েছেন আনত্মর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের এই সফল প্রসিকিউটর। নগরীর উত্তরায় তাঁর বাসায় বসে বলেছেন নিজের সফলতা, ভবিষ্যৎ ইচ্ছা এবং কাজের নানান অভিজ্ঞতাসহ ছোটবেলার স্মৃতি। লিখেছেন সৈয়দ ইকবাল।

আনন্দ আলো: আপনার বেড়ে ওঠার গল্পটা বলবেন-

তুরিন আফরোজ: আমার ছোটবেলা কেটেছে ঢাকার হাতিরপুলে। হলিক্রস স্কুলে পড়তাম। ২৫ বছর হাতিরপুলে থেকেছি। ছোটবেলা থেকেই আমি পড়াশুনার পাশাপাশি গান শেখা, ছবি আঁকা, ডিবেট করা, অভিনয়, আবৃত্তি সহ নানান সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যুক্ত ছিলাম। তাই বলা যায় ছোটবেলা থেকেই আমার ব্যসত্মতা ছিলো বেশ। আর আমার কথা বলা ও শেখার জন্যও একজন শিক্ষক ছিলেন। কোন মানুষের সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হবে তা তিনি শিক্ষা দিতেন। আমি বিটিভিতে ১৯৭৮ সালে নতুন কুঁড়িতে অভিনয়ে চ্যাম্পিয়ন হই। ১৯৮২ সালে আবৃত্তিতে প্রথম হয়েছিলাম। ছোটবেলা থেকেই একটা ভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বড় হয়েছি। গান শিখতাম সুধীন দাশের কাছে। অভিনয় শিখতাম তারানা হালিম এবং ছবি আঁকা শিখেছি শামসুন্নাহার আর্ট ইনস্টিটিউটে। মিউজিক শিখেছি অগ্নিবীনা থেকে। মোট কথা ছোটবেলা থেকে একজন মানুষ যেভাবে যতোগুলো জায়গা থেকে শিক্ষা নেয়া প্রয়োজন এবং যা যা করলে চিনত্মার উন্মেষ ঘটবে আমার বাবা-মা তাই শিখিয়েছেন। এজন্য আমার ছোটবেলাটা সত্যি মধুময় ছিলো। আর আমি রেডিও এবং টেলিভিশনে তালিকাভুক্ত আর্টিস্টও ছিলাম। আমার পড়ালেখা ছোটবেলায় যেমনি ভালো ছিলো তেমনি সাংস্কৃতিক জায়গাগুলোতেও সফল ছিলাম। ছোটবেলা থেকেই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জিতেছি। স্কুল জীবন শেষ করে কলেজ জীবনে প্রবেশ করার পর আমি ইন্টার কলেজ ডিবেট চ্যাম্পিয়ন হই পুরো বংলাদেশে। এটা ১৯৮৮ সালে। বাবা-মায়ের একটা কঠোর অনুশাসনের মধ্যে দিয়ে বড় হলেও তাদের একটা কথাই ছিলো যাই কর প্রথম হতেই হবে। আমার জীবনেও তাই হয়েছে। আমি ইন্টারমিডিয়েটে ১৯৮৮ সালে সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করি। এরপর ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকোনোমিক্স এ অনার্স করার জন্য চলে যাই। সেখানে আমি অনার্স এবং মাস্টার্স করি। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই তাহলো- দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় আমি বেস্ট অলরাউন্ডার হিসেবে কমলা নেহেরু অ্যাওয়ার্ড পাই। যেটা ছিলো বিদেশি হিসেবে আমার পাওয়া প্রথম অ্যাওয়ার্ড। আজ পর্যনত্ম কোনো বিদেশি ছাত্র-ছাত্রী এই অ্যাওয়ার্ড পায়নি। আমিই প্রথম পেয়েছিলাম এবং এখনো আমার নামটিই আছে। অনেক সম্মানজনক একটা অ্যাওয়ার্ড। পড়াশুনা, আবৃত্তি, গানবাজনা, ডিবেট, অভিনয়সহ সবকিছু মিলিয়ে এই অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে আমি এলএলবিতে অনার্স এবং ইউনিভার্সিটি অব সিডনি থেকে মাস্টার্স করি ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ল’তে। আমার ক্যারিয়ারে দুটি অনার্স এবং দুটি মাস্টার্স রয়েছে। এরপর অস্ট্রেলিয়া থেকে বারেট ল’কমপ্লিট করি।

আনন্দ আলো: ছোটবেলা থেকে আপনি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে বেশী আগ্রহী ছিলেন। অথচ হলেন আইনজীবি, কেন? আপনি চাইলেই তো অভিনয়, সঙ্গীত কিংবা আবৃত্তিতে ক্যারিয়ার গড়তে পারতেন?

তুরিন আফরোজ: প্রশ্নটা খুবই সুন্দর। আমার বাবা-মায়ের ইচ্ছে বা স্বপ্ন ছিলো আমি যাই করি না কেন পড়াশুনা যেনো ঠিকমতো করি। তাই আমি ছোটবেলা থেকে এখন অবধি সব কাজই মনোযোগ দিয়ে করি। ফলে পড়াশুনার পাশাপাশি গান, অভিনয়, আবৃত্তি কিংবা ডিবেট করার সময়ও মন দিয়ে করার ফলে ভালো হয়ে যেতো। কিন্তু বাবা-মায়ের ইচ্ছে ছিলো আমি যেন পড়াশুনায়ও ভালো করি। তাই আমি যাই করতাম না কেন মূল বিষয় কিন্তু ছিলো পড়াশুনা ঠিক মতো করা। আমার ব্যারিস্টারি পড়া কিংবা আইন পেশায় আসাটা একদিনে হুট করে হয়নি। মজার বিষয় হচ্ছে আমি যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি তখন একটি রেডিও অনুষ্ঠানে আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল বড় হয়ে আমি কী হতে চাই? তখন আমি কিছু না বুঝেই বলে দিয়েছিলাম। আমি বারেট’ল পড়ে দেশের প্রথম নারী রাষ্ট্রপতি হতে চাই। সেদিন অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে বাবা-মায়ের কাছে আসার পর তাদের কথোপকথনে বুঝলাম, বাবা ভেবেছেন আমাকে একথা মা শিখিয়ে দিয়েছেন আর মা ভাবছেন এই কথা বাবা শিখিয়ে দিয়েছেন। অথচ মজার বিষয় হচ্ছে আমাকে এই কথা তাদের কেউই শেখায়নি। আমি কী বুঝে যেনো বলেছিলাম এখন সেই কথা তা মনে নেই। আর অবাক করা বিষয় হচ্ছে আমি বর্তমানে বারেট ল’ পড়ে ব্যারিস্টারই হয়েছি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে কাজ করছি। আমার এই অগ্রগতি একদিনে হয়নি। ছোটবেলা থেকে মুক্তিযুদ্ধের উপর অনেক বই পড়েছি। এখনকার বাচ্চারা বই পড়তে চায় না। অথচ আমার বাবা-মা আমাদের ছোটবেলা থেকেই আমাকে প্রচুর বই পড়িয়েছেন। তখন বই ছিলো বিশাল বড় একটা গিফট। বই পেলেই আমরা তখন সবচেয়ে খুশী হতাম। মুক্তিযুদ্ধের আবহে ছোটবেলা থেকেই মানুষ হয়েছি। আমার পরিবারের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আমার মামা, দাদাসহ অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা। এটাই আমার সবচেয়ে বড় প্রেরণা।

আনন্দ আলো: বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নারী, জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী, বিরোধিদলীয় নেত্রী নারী। এই যে নারী জাগরন কিংবা ক্ষমতায়ন এটাকে আপনি কিভাবে দেখেন?

তুরিন আফরোজ: আসলে আমি বিষয়টাকে ভিন্নভাবে দেখি। বর্তমানে আমাদের দেশ মধ্যম আয়ের  দেশ। এটার পেছনে আমাদের জাতীয় অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচক গার্মেন্টস সেক্টর থেকেই এসেছে। যেখানে প্রায় নব্বই ভাগ নারী কাজ করছেন। কিন্তু তারা কী কেউ ক্ষমতায়নে আসছেন? আসছেন না। মানে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখা নারীরাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। কিন্তু যে নারীরা বিভিন্ন সেক্টরে ক্ষমতাবান তাঁরা কিন্তু অনেক বেশি প্রিভিলাইজড। হ্যাঁ, একথা সত্যি যে, তাঁদের মধ্যে সকল নারীই স্ট্রাগল করেছেন। আমি বলবো না যে বিভিন্ন সেক্টরে ক্ষমতায় বসে থাকা নারীরা এমনি এমনিই সব পেয়ে গেছেন। কিন্তু একইসাথে যে নারীরা প্রানিত্মক অর্থনীতিতে অংশ রাখছেন তাঁদের কাজের স্বীকৃতি দরকার। কৃষিতে প্রায় ৭৫% নারী অবদান রাখছেন। নির্মাণ শিল্পে নারীরা কাজ করছেন, তাদের  প্রত্যেক নারীই কিন্তু একজন মা। তারমানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একেকজন নারীই তৈরি করছেন। নারীর এই ভূমিকাকে গুরুত্ব দেয়ার সময় এসেছে।

আনন্দ আলো: আইনজীবী হিসেবে আপনার একটা জনপ্রিয়তা আছে। এটার মূলমন্ত্রটা কী?

তুরিন আফরোজ: আসলে জনপ্রিয়তটা ঐভাবে নির্ণয় করা যায় না। মিডিয়ায় হয়তো কাউকে নিয়ে বেশি লেখা হল সেটাকে আমরা জনপ্রিয়তা বলে থাকি। আমার কাছে বিষয়টা তা না। আমি এটাকে ভিন্নভাবে দেখি। দেখা যায় আমি কোথাও গিয়েছি সেখানে একজন সাধারণ মানুষ আমার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হয়তো লোকটি বৃদ্ধ। তিনি যখন মা বলে ডাকেন তখন আমার অন্যরকম লাগে। আবার যখন কেউ বলে মা তুমি আমাদের দেশের জন্য কাজ করছো, দোয়া করি বড় হও। এটা হচ্ছে আমার পরিতৃপ্তির জায়গা। তখন আমি ভাবি আমার কাজ কোথাও হয়তো একটা পজিটিভ পরিবর্তন আনছে। তখন সত্যিই গর্বে বুকটা ফুলে ওঠে। নিজেকে সত্যিকারের একজন মানুষ মনে হয়। আবার একই সঙ্গে দেখা গেছে, আমি মৌলবাদী শক্তির কোনো হুমকি ধমকির ফোন পাচ্ছি ঠিক তার পরবর্তী সময়ে কোনো অজপাড়া গা থেকে কোনো বীরঙ্গনার আশীর্বাদ এলো তখন ঐ মৌলবাদীর বিষয়টা আমার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। আসলে তখন আমার মনে হয় মানুষ তো একদিন না একদিন চলেই যাবে, কর্মটাই থাকবে।

আনন্দ আলো: অবসর পেলে কী করেন?

Turin-Afroz-1তুরিন আফরোজ: আমি অবসর পাইনা। প্রসিকিউশনে যোগ দেয়ার পর নিজের অবসর নেই বললেই চলে। পেশাগত দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে মিডিয়াকেও সময় দিতে হয়। এটাও কাজের মধ্যে পড়ে। হয়তো তা চোখে পড়ে না। কিন্তু চ্যানলগুলোতে যাওয়া আসায় অনেক সময় যায়। এরমধ্যে যতটুকু সময় পাই ততটুকু আমার পরিবারও আমার মেয়ের জন্যই বরাদ্দ রাখি। ওকে পড়াই এবং ওর সঙ্গে আড্ডা দেই। কিছু একানত্ম অবসর আছে আমার। যদি সেটা পাই তাহলে নিজের মতো করে কাটাই। গান গাওয়া না হলেও অনেক গান শুনি। টেলিভিশন আমার দেখা হয়না। অনলাইনে ডেইলি নিউজ পেপার পরি। আর কখনো কেউ কিছু দেখতে বললে তবেই টিভি দেখা হয়। এমনিতেই চলচ্চিত্র বা টিভি নাটক দেখা হয় না। তবে একটা সময় দেখতাম। আমি সিনেমা দেখতে ভীষণ ভালোবাসি। কিন্তু সময় হয়না। তবে বাসায় আসার পর কমপ্লিট মা হয়ে যাই। সঙ্গে একজন গৃহিণীও হই।

আনন্দ আলো: আপনার কাছে বন্ধুত্ব কী?

তুরিন আফরোজ: বন্ধুত্ব হচ্ছে আস্থার জায়গা, বোঝাপড়ার জায়গাও। বন্ধুকে সময় দেয়া এবং সুযোগ দেয়া দুটোই জরুরি। তবে আমি এক্ষেত্রে আস্থার জায়গাকে এগিয়ে রাখবো। আমার একজন বন্ধু আছে অবশ্যই তার প্রতি আস্থা থাকতে হবে। তারও আমার প্রতি আস্থা থাকতে হবে। এটা না থাকলে বন্ধুত্ব হয় না। বন্ধুত্ব টিকে না।

আনন্দ আলো: আর পরিবারের সংজ্ঞাটা আপনার কাছে কেমন?

তুরিন আফরোজ: একসময় একান্নবর্তী পরিবার ছিলো সেটা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে সিঙ্গেল পরিবারে এসে ঠেকেছে। আমার পরিবারের কথা যদি বলতে হয় তাহলে বলবো আমি আর আমার সনত্মানই আমার পরিবার। বাসায় কাজের মানুষ, বাড়ির দারোয়ান সবাই আমার পরিবারের অংশ। সবার সুখ-দুঃখ দেখা, বোঝা এবং কাছে টেনে নেয়া-এটাই পরিবারের মূল শক্তি। আমার বাড়ির বিভিন্ন কাজের মানুষ বহুবছর ধরে আছে তাই তাদের সবকিছু আমাকেই দেখতে হচ্ছে। আমি অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে ফিরেছি প্রায় দশ বছর। এই দশ বছরে প্রথম  থেকে আমার বাড়ির বিভিন্ন কাজে যারা ছিলেন, তারাই আছেন।

আনন্দ আলো: নিজের কোনো স্বপ্ন বা ইচ্ছে পুরণের কথা বলবেন?

তুরিন আফরোজ: একটা সময় স্বপ্ন ছিলো যুদ্ধাপরাধীর বিচার যেন হয়। সেটা এখন বাসত্মবে রূপ লাভ করেছে। তবে আমার এখনকার স্বপ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের ভবিষ্যতটা যেনো সুন্দর হয় এবং আমাদের যে সমাজ এই সমাজ থেকে যেনো অস্থিরতা চলে যায়। আমি যেহেতু মা তাই বলবো আমার সনত্মান যেনো বাসা থেকে বেড়িয়ে নিশ্চিতভাবেই আবার আমার কাছ ফিরে আসে। সেটা সড়ক দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে যৌন হয়রানি কিংবা রাজনৈতিক সহিংসতা যেটাই হোক না কেন নিরাপদে বাড়ি ফেরার বিষয়টি দেশে থাকবে বলে আশা রাখছি। নিরাপদ একটা বাংলাদেশ চাই যেখানে শুধু আমার সনত্মান নয় সবার সনত্মান নিরাপদে বেড়ে উঠবে।