Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

শাহীন আজিজের স্থাপত্য ভুবন

দেশ প্রেম, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রকৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে আধুনিক স্থাপত্য শিল্পে দেশের জন্য সৃষ্টিশীল কাজ করে চলেছেন শাহীন আজিজ। তিনি ইট, কাঠ, কংক্রিটের চেনা জগতের থেকে বেরিয়ে প্রকৃতিকে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। ২০০১ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগ থেকে ¯œাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পাস করে বের হওয়ার পর চার বন্ধু মিলে নিজেদের স্থাপত্য উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান শুরু করেন এবং সিনিয়র স্থপতিদের সাথে খন্ডকালীন কাজ শুরু করেন। ২০০৩ সালে নিজেই গড়ে তোলেন ‘পরিসর উপদেষ্টা’ নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। এ যাবৎ তিনি বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার ডিজাইন করেছেন। স্থাপত্যের পাশাপাশি তিনি লেখালেখিও করেন। এবার শাহ্ সিমেন্ট সুইট হোমে তাকে নিয়ে প্রতিবেদন। লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক

শৈশব থেকেই বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ সবুজ আমাকে আলোড়িত করেছে। গহন বর্ষার কালো মেঘের চলাচল অথবা বয়ে যাওয়া কাল বৈশাখীর শো শো শব্দে বিমোহিত কৈশোর আর বন্যার ঘোলা জলের দুরন্ত ঘূর্নির মাঝেই দেখেছি দুর্বার প্রকৃতির দুরন্ত শক্তি। বেদনার সাথে লক্ষ্য করেছি বন্যায় ভেসে যাওয়া আশ্রয়হীন মানুষের হাহাকার আর টিকে থাকার সংগ্রাম। অদম্য মানুষের সঠিক আর সীমিত চাহিদাকে কখনো কখনো স্থাপত্যের সাথে মেলানো যায়। আধুনিক স্থাপত্যের পরিভাষায় পরিমিতি সম্পন্ন স্থাপত্যকে বলা হয় ‘মিনিমালিষ্ট আর্কিটেকচার’। আবহমান বাংলার সীমিত সম্পদ আর স্বল্প চাহিদার পল্লী ঘরবাড়ি আমাকে আধুনিক ‘মিনিমালিষ্ট’ স্থাপত্য চর্চায় উদ্বুদ্ধ করেছেÑ কথা গুলো বললেন স্থপতি শাহীন আজিজ।
তিনি ইট, কাঠ, বালু ও কংক্রিকেটর মাঝে খুঁজে ফেরেন প্রকৃতির সান্নিধ্য। আর তাই তার প্রতিটি স্থাপনায় থাকে সবুজের ছোঁয়া। প্রতিটি ডিজাইনের ক্ষেত্রে আলো, বাতাস, সবুজ সহ প্রকৃতিকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় আর্কিটেক্ট শাহীন আজিজ। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা শরীয়তপুরে। শাহীন আজিজের বাবার নাম এম এ আজিজ। পেশায় তিনি একজন অধ্যাপক ছিলেন। মা আনোয়ারা বেগম শিক্ষিকা। ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক কর্মকাÐের সাথে জড়িত ছিলেন। বই পড়া, লেখালেখি করা তার পছন্দের বিষয়। অবসর পেলেই কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়েন গল্প লিখতে। ছোটবেলা থেকেই তার ইচ্ছা ছিল আর্কিটেক্ট হওয়া। তিনি হয়েছেন সফল একজন স্থপতি। নিজের ইচ্ছা থেকেই আর্কিটেক্ট হয়ে ওঠা তার। পালং তুলাসার গুরুদাস সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন ১৯৯০ সালে। ১৯৯২ সালে ঢাকা কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগে।
বুয়েটে পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি জড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন সাংগঠনিক কাজে। বন্ধুদের সাথে মৌলবাদ আর সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন আর বুয়েট ছাত্রদের ক্লাবগুলোতে সক্রিয় ছিলেন। সেই সাথে জাতীয় দৈনিক আর সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন গুলোতে লেখালেখি করতেন। একসময় তিনি জাতীয় দৈনিক ‘আজকের কাগজ’ এর বুয়েট প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি শাহীন আজিজ খÐকালীন কাজ করতেন বিভিন্ন উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠানের সাথে। ২০০১ সালে তিনি ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। বুয়েট থেকে পাস করে বের হওয়ার পরপরই চার বন্ধু মিলে নিজেদের স্থাপত্য উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান শুরু করেন এবং সিনিয়র স্থপতিদের সাথে খÐকালীন কাজ করতে থাকেন। ২০০৩ সালে তিনি নিজেই গড়ে তোলেন ‘পরিসর উপদেষ্টা’ নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। সেই থেকে আজ অব্দি এই প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এ পর্যন্ত দেশে ও বিদেশে প্রায় শতাধিক ভবনের নকশা প্রণয়নে যুক্ত ছিলেন। এ সব ভবনের মধ্যে রয়েছে যেমনÑ রেসিডেন্সিয়াল ভবন, অফিস বিল্ডিং, ফ্যাক্টরি ভবন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সাংস্কৃতিক ভবন, হোটেল, স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান, ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।
Shahin-Proশিল্পকলা একাডেমী, নির্বাচন কমিশন ভবন, নারায়নগঞ্জ স্টেডিয়াম, স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের ল্যান্ডস্কেপ, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান গেট হাউজ, ন্যাশনাল আর্কাইভ ভবনসহ অনেক জাতীয় প্রতিষ্ঠানের ডিজাইন টিমের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
দেশের গÐি পেরিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতেও তিনি নকশা প্রণয়নের কাজ করেছেন। ২০০৩ সালে তিনি বিয়ে করেন। স্ত্রীর নাম রাহাত মুসেলি। এই দম্পতি এক ছেলে সন্তানের জনক-জননী। ছেলের নাম রাইয়ান আজিজ।
স্থাপত্য চর্চার পাশাপাশি তিনি লেখালেখিও করেন। এ পর্যন্ত শিশুদের জন্য লেখা তার চারটি বই প্রকাশিত হয়েছে। অবসর সময় কাটে তার বই পড়ে। তবে ‘লং ডিস্টেন্স রান’ করা তার একটি অভ্যাস। দেশে হাতে গোনা কয়েকজন ফুল ম্যারাথন (৪২.২ কিলোমিটার) অফিসিয়াল ফিনিশারের একজন তিনি। দশ বছরের ছেলে রাইয়ান আজিজকেও সাথে নিয়ে দৌড়াতে যান মাঝে মাঝে। ছেলে রাইয়ান এ বছর যুব দিবসে হাতিরঝিলে অনুষ্ঠিত ৫ কি. মি. দৌড়ে সর্বকনিষ্ঠ ফিনিশারের ক্রেস্ট পেয়েছে।
মানুষের প্রতি বাবা মায়ের অপার ভালোবাসা আর নৈতিকতার প্রশ্নে কঠোর অবস্থানের শিক্ষা সর্বদাই পালনের চেষ্টা করেন নিজের জীবনে। স্থাপত্য ও প্রকৌশলে তার অনুপ্রেরণা এফ আর খান। সৃজনশীলতায় সত্য জিৎরায় আর মানসিক শক্তি হিসেবে সব সময় তার মনের গহীনে থাকেন রবীন্দ্রনাথ। দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করতে পারাটাই সবচাইতে আনন্দের বিষয় তার কাছে। একটি সুষম আধুনিক বাংলাদেশ নির্মাণে সম্পৃক্ত থাকাটাই তার কাছে বিদেশের হাত ছানি ছেড়ে দেশে থাকার মূল প্রেরণা।
স্থপতি শাহীন আজিজ বলেন, ডিজাইন করার ক্ষেত্রে আমি সব সময় প্রাধান্য দেই স্থানীয় জলবায়ু, আলো-বাতাসের সহজ চলাচল, সবুজ গাছ গাছালীর সহবস্থান আধুনিক নির্মাণ উপকরণের উপর। ক্রিটিকাল রিজিও নালিজমে বিশ্বাস করি। আমি মনে করি ভবন হতে হবে আধুনিক প্রযুক্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং টেকসই নির্মাণ উপকরণ দিয়ে নিমিত। এ কারণেই আমার পছন্দের উক্তি হচ্ছে “থিঙ্ক গেøাবাল অ্যান্ড অ্যাক্ট লোকাল”। যতটুকু দরকার ঠিক ততটুকু নিয়েই ডিজাইন করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। বাহুল্য বর্জিত মিনিমালিষ্ট ধারায় ডিজাইনের পরিমিতি বোধ দৈনন্দিন কাজ কর্মে এবং নিজস্ব জীবনাচরণে সংযুক্ত করতে চাই সর্বদাই।