Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

লুকান আলমগীরের গ্রীন আর্কিটেকচার

মোহাম্মদ তারেক: ছেলেটির বয়স কতইবা হবে। সাত অথবা আট। প্রতিদিনই বাসায় চাচাদেরকে ড্রাফটিং টেবিলে আঁকতে দেখত, নিজেও কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়ত ছবি আঁকতে। ছোটবেলা থেকে এটাই শিখেছেন, এবং এটা দেখতে দেখতেই বড় হয়েছেন। তখন থেকে ড্রাফটিং-এর প্রতি এমনভাবে আগ্রহী হয়ে পড়ে যে, আর্কিটেক্ট ছাড়া অন্য কিছু হওয়ার ইচ্ছাও কখনো ছিল না তার। ছেলেটির লালিত স্বপ্ন শেষমেশ বাস্তবে রূপ লাভ করে। আজ তিনি হয়েছেন সফল একজন স্থপতি। তার নাম লুকান আলমগীর। ইট, কাঠ, বালু ও কংক্রিকেটের মাঝেই তিনি খুঁজে ফেরেন প্রকৃতির সান্নিধ্য। আর তাই তার প্রতিটি স্থাপনায় থাকে সবুজের ছোঁয়া। ঘর-বাড়ি, ফ্যাক্টরীসহ প্রতিটি ডিজাইনের ক্ষেত্রে আলো, বাতাস, সবুজসহ প্রকৃতিকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। লুকান আলমগীর বিদেশ থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে নিজের দেশেই সুনিপুণ ভাবে তৈরি করে চলেছেন একের পর এক বিশ্বমানের স্থাপত্য। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অপার সম্ভাবনাকে ত্যাগ করে বাংলাদেশের উন্নয়নকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।
দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় লুকান আলমগীর। তার গ্রামের বাড়ি ভৈরবে। কিন্তু তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। বাবার নাম মৃত আবু জাফর মোহাম্মদ আলমগীর। তিনি খ্যাতিমান একজন স্থপতি ছিলেন। মা সেলিনা আফরোজাও একজন খ্যাতিমান স্থপতি। বর্তমানে তিনি শান্ত মারিয়াম ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। স্কুলে পড়াকালীন স্থপতি লুকানের কার্টুন আঁকাআঁকির প্রতি ছিল প্রচÐ ঝোক। গান গাওয়া ছিল পছন্দের বিষয়। তবে পড়াশোনার চাইতে ড্রইং এ মনোযোগ ছিল অনেক বেশি। যেখানেই ছবি আঁকার প্রতিযোগিতা হতো সেখানেই তাকে দেখা যেত। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে তিনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। ছোটবেলা থেকেই স্থাপত্য শিল্পের সাথে জড়িত লুকান। পরবর্তীতে এটাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। আজ তিনি বর্তমান সময়ের সফল স্থপতিদের একজন। বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল টিউটিরিয়াল থেকে তিনি ওলেভেল পাস করেন ২০০০ সালে। ২০০২ সালে স্কলাস্টিকা থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এ লেভেল পাস করে ভর্তি হন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগে। সেখানে দুই বছর পড়ার পর তিনি পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্র্যাট ইন্সটিটিউট-এর স্থাপত্য বিভাগ থেকে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। পাস করে বের হওয়ার পরই লুকান আলমগীর যোগ দেন নিউইয়র্কের এ এ ডিজাইন নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। তারপর ভ্যালমন্ট ফ্রিম্যান আর্কিটেক্টস এবং কিম ডিপোলী ডিজাইন ফার্মেও কাজ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে তিনি পাঁচ বছর কাজ করেছেন। ২০১২ সালে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি দেশে ফিরে আসেন। দেশেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন। বাবার গড়া ‘আর্কিটাইপ লিমিটেড’ এ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেক্টরে দেখাশোনা করতেন। পরবর্তীতে এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব বুঝে নেন। তিনি তার জ্ঞান, পারিবারিক শিক্ষা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকেই গড়ে চলেছেন একের পর এক কৃতিত্বপূর্ণ স্থাপনা। তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছেÑ গাজীপুরের কলম্বিয়া ওয়াশিং প্ল্যান্ট লিমিটেড, ইউনিটি ফেব্রিকস ইন্ডাস্ট্রি, এক্সক্লুসিভ ক্যান ফ্যাক্টরী, ভালুকায় এডার্মস স্টাইল লিমিটেড ক্যাম্পাস, ধামরাই এর গø্যামার ড্রেসেস লিমিটেড, আশুলিয়ার জেড ফোর লিমিটেড ফ্যাক্টরী, গাজীপুরের জেনেসিস ওয়াশিং প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরী, গাজীপুর কোর্টস বাংলাদেশ ইটিপি, সিলভার লাইন মাল্টিপল ফ্যাক্টরী, ধানমন্ডির রূপায়ণ জেড আর প্লাজা, গুলশান-এর দ্য পার্ল রেসিডেন্স বিল্ডিং, উত্তরার লুনারিয়াম অ্যাপার্টমেন্ট, বরিশালের দি ওয়েসিস হোটেল অ্যান্ড ফাতেমা সেন্টার শপিংমল, গোলাপবাগের আনোয়ার ল্যান্ডমার্ক গোলাপবাগ অ্যাপার্টমেন্ট, বসুন্ধরার শাহবুদ্দীন স্কয়ার অ্যাপার্টমেন্ট, গুলশান-এ কলওয়েড সেন্টার, কোনাবাড়ির পিএন কম্বোজিড ফ্যাক্টরী, উত্তরার শাহবুদ্দীন অ্যাপার্টমেন্ট, চাঁদপুরের ১৪তলা কমার্শিয়াল বিল্ডিংসহ অসংখ্য বিল্ডিং ও ফ্যাক্টরীর ডিজাইন করেছেন। এছাড়াও তিনি বেশ কিছু নতুন প্রজেক্টের কাজ করছেন।
২০১১ সালে তিনি বিয়ে করেন। স্ত্রীর নাম নাদিয়া মেহজাবীন। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের এইচ আর এর দায়িত্বে আছেন। এই দম্পতি দুই সন্তানের জনক-জননী। ছেলের নাম ইশান আলমগীর নাইল ও মেয়ে আজওয়াহ আলমগীর জুন।
স্থপতি লুকান আলমগীর বলেন, বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই। অনেক বাধা প্রতিক‚লতা থাকা সত্তে¡ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে পৃথিবীর অনেক বড় বড় দেশের থেকে এগিয়ে আছে। যেমন গত ফেব্রæয়ারি মাসেই সম্মাননা দেয়া হলো বিশ্বের শ্রেষ্ঠ লীড প্লাটিনিয়াম ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে। সেখানে ১৩টি ইন্ডাস্ট্রি বাংলাদেশের। তার মধ্যে প্রধান তিনটি স্থাপনার ডিজাইন আমারই করা।
06গ্রীন আর্কিটেকচার বা গ্রীন বিল্ডিং প্রসঙ্গে আমি বলব, পৃথিবীর চারপাশে যদি আমরা ওজন স্তরের মতো করে একটা স্ট্রাকচার তৈরি করে পৃথিবীকে মুড়ে দেই? এটা হবে অতিভাবনা। কারণ মানুষের পক্ষে এখন আর সেটা সম্ভব নয়। আবার যদি বলি পৃথিবীর সব সালফার ডাই অক্সাইড গ্যাস ব্যালান্স করব সেটাও সম্ভব নয় মানুষের পক্ষে। তবে এই সকল স্বপ্নের মতো ভাবনাগুলোর শুরু হতে পারে গ্রীন আর্কিটেকচার থেকে। কীভাবে? এই যে পৃথিবীর সবকিছুর প্রাকৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক একটা সম্মেলিত ভাবে ব্যালান্স করে স্থাপত্য করাই গ্রীন আর্কিটেকচারের প্রধান ধাপ। বর্তমানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে এনার্জি মডেলিংয়ের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারকে কন্ট্রোল করা যাচ্ছে। রিনিউবল এনার্জি যেমন সূর্যরশ্মি, বাতাস, জিওথারমল এনার্জি সম্পদকে ব্যবহার করে ননরিনিউবল সম্পদ যেমন তেল, কয়লা সংরক্ষণে সক্ষম হচ্ছি। এসব কিছু মিলিয়েই স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যও বদলে যাচ্ছে। আর এটাই সূচনা করছে গ্রীণ আর্কিটেকচারের। তিনি আরো বলেন, গ্রীন স্থাপনা শিল্প হচ্ছে এমনই সম্ভাব্য ভবিষ্যতের শুরু যা মানুষ এখন শুধু স্বপ্ন দেখে। আমরা যে ধরনের গ্রীন বিল্ডিং প্র্যাকটিস করছি সেটা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে এনার্জি সংরক্ষণ করি। সাধারণ ভাবে গ্রীন বিল্ডিং অর্থ হচ্ছে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ এর মতো লিমিটেড রিসোর্চকে কম ব্যবহার করে আনলিমিটেড রিসোর্চকে বেশি কাজে লাগিয়ে বিল্ডিংয়ের ফাংশনকে অব্যাহত রাখা। আমার ডিজাইন শুধু মানুষের জন্য নয়। যেমন প্রকৃতিতে থাকবে মাছ, পশুপাখি, গাছ পালা এবং তাদের ইকো সিস্টেম। তেমনইভাবে একটি বিল্ডিংও হতে পারে এই ইকো সিস্টেমের একটি অংশ। যেমন ধরুন আমাদের ডিজাইন করা ফ্যাক্টরীতে আমরা মানুষের বর্জ্য পদার্থ রিসাইকেল করে এনার্জিতে রূপান্তর করছি। এটা ক্লোসলুপ সিস্টেমে কাজ করছে। এতে করে আমরা সীমিত ন্যাচারাল রিসোর্চকে অপচয় রোধ করছি। এছাড়াও বিভিন্ন রকম প্লানটেশন তো থাকছেই। একই সাথে মাছ ও সবজি চাষ করা হচ্ছে বিল্ডিংয়ের ভেতরেই হাইড্রোফোনিক ও এরোফোনিক সিস্টেমে। বিল্ডিংটি এমনভাবে রূপধারণ করেছে এতে মনে হতে পারে এটি একটি প্রাকৃতিক ভাবেই তৈরি স্থাপনা। বাংলাদেশের আবহাওয়া, জলবায়ু, প্রকৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিটি কাজে নজর দেন স্থপতি লুকান আলমগীর। এই স্থপতি তার কাজ সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে করতে ভালোবাসেন।
GDL-ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে স্থপতি লুকান আলমগীর বলেন, আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বলতে গেলে আসলে গ্রীন আর্কিটেকচার নিয়েই। ধরা হচ্ছে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর অনেক শহরই সাস্টেনেবল শহরে পরিণত হবে। আমার ডিজাইনগুলো যেন তারই একটা বিশেষ অবদান রাখার অংশ হতে পারে। ভবিষ্যতের এই চাহিদাকেই সামনে রেখে আমার পথ চলা। আমার স্বপ্ন হচ্ছে বাংলাদেশকে এমন একটা সাস্টেনেবল দেশে রূপান্তর করা। যেন ভবিষ্যতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে এসে থাকবে, ব্যবসা-বাণিজ্য করবে। বাংলাদেশকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বসবাসযোগ্য দেশগুলোর একটি হিসেবে তুলে ধরা আমার স্বপ্ন।