Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

র‌্যাম্পে যোগ দেয়ার কারনে বাবা এক বছর কথা বলেননি : হিরা

রুখসানা আলী হিরা একজন র‌্যাম্প মডেল ও অভিনেত্রী।  শোবিজে খুব পরিচিত ও জনপ্রিয় মুখ।  র‌্যাম্পের পাশাপাশি হিরা অনেকদিন ধরে অভিনয়ও করছেন।  আনন্দ আলোর সাথে আলাপচারিতায় তিনি নিজের কাজ ও ব্যক্তিজীবনের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন।  আলাপচারিতার উল্লেখযোগ্য অংশ থাকছে পাঠকদের জন্য।  লিখেছেন প্রীতি ওয়ারেছা

আনন্দ আলো: এত বিষয় থাকতে শোবিজের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হল কেন?

রুখসানা আলী হিরা: ছোটবেলা থেকেই মডেলিংয়ের প্রতি আমার খুব আগ্রহ ছিল।  মডেলিংয়ের কারণেই মিডিয়ার প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়।  তবে আমার পরিবার ছিল এর বিপক্ষে।  আর তাইতো প্রথম দিকে পরিবারের কাউকে আমার শখের কথা বলতে পারিনি।  সাহস ছিল না।  আমার এক কাজিন আমাকে খুব উৎসাহ দিলো।  সে আমাকে ফটোগ্রাফার ইকবাল আহমেদের কাছে নিয়ে যায় ফটোশুট করার জন্য।  সেই ছবি দেখে বাংলালিংক আমাকে তাদের একটি স্টিল ফটোগ্রাফি করার সুযোগ দেয়।  তখন আমার ছবি দিয়ে বাংলালিংক পোস্টার ও বিলবোর্ড করেছিল।  কাজটি করে প্রচুর সাড়া পেয়েছিলাম।  এটা ২০০৬ সালের ঘটনা বলছি।  বাংলালিংকের কাজটি করার পর পরিবার পড়ালেখার অজুহাতে মিডিয়ায় কাজ করতে নিষেধ করে দেয়।  যে কারণে পরের বছর ২০০৭ সালে আমি কোন কাজই করিনি।  পরিবারের সাথে এক প্রকার যুদ্ধ করেই ২০০৮ সালে লাক্স চ্যানেল আই সুপার স্টার প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়েছিলাম।

আনন্দ আলো: র‌্যাম্পের সাথে পথ চলা কীভাবে?

রুখসানা আলী হিরা: লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার থেকেই আমার র‌্যাম্পে পথ চলা।  ২০০৮ সালে আমি একজন প্রতিযোগী হিসেবে লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতায় অংশ নেই।  র‌্যাম্পে হাঁটার জন্য প্রতিযোগীদের গ্রুমিং করানো হয়।  ট্রেইনার ছিল আজরা আপু, টুম্পা আপু।  যেহেতু ছোটবেলা থেকেই আমার মডেলিংয়ের প্রতি আকর্ষণ ছিল, প্রতিযোগিতার গ্রুমিং সেশনে র‌্যাম্পের প্রেমে পড়ে যাই।  র‌্যাম্পের গ্রুমিং খুব উপভোগ করছিলাম।  আমার ক্যাটওয়াক দেখে ট্রেইনাররা খুব প্রশংসা করতো।  সবমিলিয়ে ইচ্ছেটা আরো বেড়ে যায়।  ভেতরে ভেতরে উদ্বুদ্ধ হই দেখি না চেষ্টা করে, পারি কী না! অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম আমার ক্যারিয়ারের ফোকাস পয়েন্ট হবে র‌্যাম্প।  সেই থেকে যাত্রা শুরু।

আনন্দ আলো: পরিবার নিয়ে কিছু বলুন?

Rokhsana-Ali-Heraরুখসানা আলী হিরা: আমরা পরিবারের সবাই নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় থাকি।  বাবা-মা আর আমরা তিন বোন মিলে মোট পাঁচ সদস্যের পরিবার।  আমি বাবা-মায়ের বড় মেয়ে।  মেঝোবোন খুব ভালো ফোক গান করে।  আমি নিজে তার বড় ফ্যান।  আমার ছোট বোনের মিডিয়ার প্রতি কোন আগ্রহ নেই।  পড়াশোনায় ঝোঁক বেশি।

আনন্দ আলো: শোবিজে আসার ক্ষেত্রে পরিবারের সাপোর্ট পাননি।  পরবর্তীতে কীভাবে তাদের সমর্থন আদায় করেছেন?

রুখসানা আলী হিরা: আমি যে সময়ে মিডিয়ায় কাজ করতে শুরু করি তখন পরিবারের কেউ ধারণাও করতে পারতো না তাদের বাড়ির মেয়ে মিডিয়ায় কাজ করবে।  তাদের ধারণা মিডিয়া মানেই ঝামেলাযুক্ত বিষয়।  মেয়ে কোথায় যাবে? কী করবে? মাধ্যমটা কেমন ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে ভীতি কাজ করতো।  একই ভীতি কাজ করেছে আমার পরিবারের ক্ষেত্রেও।  সুতরাং মিডিয়া নিয়ে তাদের মূল্যায়ন ছিল এখানে কাজ করার কোন দরকার নেই, তারচেয়ে মন দিয়ে পড়ালেখা কর।  এতকিছুর পরেও যখন আমি নিজের পছন্দের জায়গায় অটল থেকেছি তখন আম্মু ছাড় দিয়েছে তবে আব্বু আমার সাথে কথা বলেনি এক বছর।  অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে নিজের মনের সাথে।  একসময় আব্বু আমার কাজগুলো দেখতে থাকে।  তার মনোভাব ধীরে ধীরে দূর হয়ে যায়।  তবে আত্মীয়-স্বজন আমার বাবা-মাকে খুবই বিভ্রান্ত করেছে।  তারা সবসময় বলতো হিরা মিডিয়ায় কী করে? কই যায় না যায়, র‌্যাম্প আবার কী জিনিস? এটা করে কী লাভ? ইত্যাদি ইত্যাদি।  টিভিতে ফ্যাশন শো দেখায় না কিংবা দেখালেও খুব কম।  একারণেই র‌্যাম্প প্রসঙ্গে পরিবারের সদস্যরা অন্ধকারে ছিল।  পরবর্তীতে বাবা আমাকে একটা কথাই বলেছে, যা করছো আত্মবিশ্বাসের সাথে করবে এবং সবসময় নিরাপদে থাকার চেষ্টা করবে।

আনন্দ আলো: র‌্যাম্পে কাজ করতে করতে একসময় সবাই কোরিওগ্রাফি করে।  আপনি করেছেন কখনো?

রুখসানা আলী হিরা: হ্যাঁ আমিও করেছি তবে আমারটা ছিল অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মত।  আমার একজন বড় ভাই একবার একটি শোয়ের আয়োজন করে।  সে খুব করে অনুরোধ করলো ফ্যাশন শোটির কোরিওগ্রাফি করে দেয়ার জন্য।  আমতা আমতা করে শোটি করেই ফেললাম।  এভাবে পরবর্তীতে আরো কয়েকটি শোয়ের কোরিওগ্রাফি করেছি।  তবে সচেতনভাবে একেবারেই কোরিওগ্রাফি করার চিন্তা করি না।  মডেল, পোশাক, কিউ, মিউজিক একাধারে সবকিছুর তৎক্ষনাত সমন্বয় করতে হয়।  কোরিওগ্রাফি অনেক কঠিন কাজ।

আনন্দ আলো: প্রেমকে কীভাবে দেখেন? নিজের জীবনে প্রেম বিষয়ক উপলব্ধি কী?

রুখসানা আলী হিরা: প্রেম বলতে আমি যেটা বুঝি বা বিশ্বাস করি সেটা হল- প্রেমের ক্ষেত্রে দুজন মানুষের মধ্যে বোঝাপড়া, কেয়ারিং এবং পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধ থাকতে হবে।  এগুলো হল প্রেমের মূলমন্ত্র।  প্রেম সবার জীবনেই আসে।  শুধু একবার না, একাধিকবার আসে।  সবাইকে প্রেমে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে প্রেমের সেই তিনটা মন্ত্র আমি একজনের মধ্যে পেয়েছিলাম।  যার কারণে তার প্রেমেও পড়েছিলাম।  একসময় দেখলাম প্রেমের মন্ত্রগুলো তার মধ্যে থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।  অনেক ব্যাপারে আমার ইচ্ছের সাথে তার ইচ্ছে মিলছে না।  আমি যার প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকবো তার কাছ থেকে আমার প্রতি বিশ্বাসটা অবশ্যই আশা করবো।  খেয়াল করছিলাম আমার কাজের মাধ্যমকে সে সম্মান করতে পারছে না।  তখন আর সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে আগ্রহবোধ করিনি।  যাইহোক প্রেম জীবনে এসেছে, চলেও গেছে।

আনন্দ আলো: র‌্যাম্পের উল্লেখযোগ্য কাজের ব্যাপারে জানতে চাই-

রুখসানা আলী হিরা: জীবনে অসংখ্য ফ্যাশন শো করেছি।  তার মধ্যে ‘ঢাকা ফ্যাশন উইক’ এর কথা বলতেই হবে।  বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য এই ফ্যাশন শোটি তিনদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।  সেখানে আমি কাজ করেছি।  ২০১২ সালে আমাকে বেস্ট র‌্যাম্প মডেল হিসেবে আমাকে পুরস্কৃত করেছে ‘ঢাকা ফ্যাশন উইক’।  এটি আমার ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তি।  গত দুবছর থেকে ‘ঢাকা ফ্যাশন উইক’ আর হচ্ছে না।  কেন হচ্ছে না জানি না তবে আমি শোটি খুব মিস করছি।  এছাড়া বাটেস্কপোর ফ্যাশন শো আমার খুবই পছন্দের।  ইউনিলিভার কয়েক বছর ধরে আয়োজন করছে পন্ডস্‌ ফ্যাশন শো।  সেখানে ধারাবাহিকভাবে কাজ করেছি।  এছাড়া জাপানসহ দেশের বাইরে বেশ কয়েকটি ফ্যাশন শো করেছি সেগুলো আমার দৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য।

আনন্দ আলো: র‌্যাম্প ইন্ডাস্ট্রিতে প্রচুর মডেল তারপরেও টিভিসিতে র‌্যাম্প মডেলদের কম দেখা যায় কেন?

রুখসানা আলী হিরা: টিভিসির ক্ষেত্রে একটা ব্যাপার সবসময়ই ঘটছে যেটা আমি মেনে নিতে পারি না।  অন্য র‌্যাম্প মডেলদের ক্ষেত্রেও হয়তো একই কথা প্রযোজ্য।  আমি মনে করি টিভিসির পারিশ্রমিক কখনো ফটোশুটের পারিশ্রমিক হতে পারে না।  ডাকসাইটে কোম্পানির প্রোডাক্টে কাজ করার অফার দিয়ে যখন জঘন্যরকম কম পারিশ্রমিকের কথা বলে তখন বিষয়টা সত্যিই মেনে নিতে পারিনা।  তাই টিভিসিতে কাজ করি না।  এজেন্সিগুলো কম টাকায় কিংবা অনেক ক্ষেত্রে বিনে পয়সায় অভিনেত্রীদের মডেল বানিয়ে টিভিসি নির্মাণ করে।  তারপরেও ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে অমিতাভ রেজা ও সরয়ার ফারুকীর কয়েকটি টিভিসি করেছি।

আনন্দ আলো: এখন প্রচুর নাটক করছেন।  সিনেমার খবর কী?

রুখসানা আলী হিরা: আগে একরকম গোঁ ধরেই বসে ছিলাম যে সিনেমা করবো না।  আমাদের দেশের সিনেমার মান সেসময় ভালো ছিল না।  নাটকের ব্যাপারেও ঐরকম মনোভাব কিছুটা ছিল তবে এখন সেটা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছি কারণ শুধু র‌্যাম্প দিয়ে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।  অনেকদিন হলো র‌্যাম্পের পাশাপাশি নাটক করছি।  গত ঈদে ৬টি এক ঘন্টার নাটক প্রচারিত হয়েছে।  এছাড়া ৩টি ধারাবাহিকে অভিনয় করছি।  আগের চেয়ে সিনেমার প্রেক্ষাপট এখন অনেক ভালো।  তাই সিনেমার প্রতিও আগ্রহ ফিরে এসেছে।  ভালো ছবিতে অফার পেলে অবশ্যই অভিনয় করতে চাই।

আনন্দ আলো: কাজ করতে গিয়ে মানুষ মজার মজার অভিজ্ঞতালব্ধ হয়।  র‌্যাম্প বিষয়ক অপনার মজার কোন স্মৃতিকথা জানতে চাই-

Rokhsana-Ali-Hera-1রুখসানা আলী হিরা: অনেক মজার স্মৃতি আছে।  ব্যাক স্টেজে আমরা কত যে মজা করি! এই মুহূর্তে একটা স্মৃতির কথা মনে আসছে।  র‌্যাম্পে একটা কিউ শেষ হলে আমাদের খুব দ্রুত কাপড় বদলাতে হয়।  কাপড় বদলিয়ে আবার স্টেজে উঠব।  প্রস্তুত হয়ে আছি।  আগের কিউ ছিল ব্রাইডাল শাড়ি।  সেটা চটজলদি বদলিয়ে আমরা পরের কিউয়ের জন্য অপেক্ষা করছি।  এবারের কিউয়ে সবাই পড়েছে ব্রাইডাল লেহাংগা।  আমার সিনিয়র এক র‌্যাম্প মডেলও তাড়াহুড়ো করে কাপড় বদলিয়ে পরবর্তী কিউয়ের জন্য অপেক্ষা করছে।  তার লেহাংগার ওড়নার সাথে আগের শাড়ির ব্লাউজ লেগে আছে সেটা সে টেরই পায়নি।  সে পোজ মেরে কিউ ঘুরে আসলো।  এদিকে তার ওড়নার সাথে ঝুলছে ব্লাউজ।  ব্যাক স্টেজে আসার পরে আমাদের হাসতে হাসতে দম ফাটার অবস্হা।  এরকম অনেক ঘটনাই ঘটে র‌্যাম্পে।

আনন্দ আলো: র‌্যাম্পে কাজ করার ক্ষেত্রে একজন মডেলের কী কী গুণাবলী থাকা দরকার?

রুখসানা আলী হিরা: র‌্যাম্পের ক্ষেত্রে উচ্চতা খুবই জরুরি।  যদিও বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের মেয়েদের উচ্চতা খুব বেশি হয় না।  শারীরিক গঠনটা অবশ্যই ভালো হতে হবে।  ডায়েট মেনটেইন করতে হবে।  আর থাকতে হবে আত্মবিশ্বাস।  আত্মবিশ্বাস না থাকলে কেউ স্টেজে পুরোটা বিষয় উপস্হাপন করতে পারবেনা।  এছাড়া মডেলরা যদি কিছুটা গ্রুমিং করে আসে তাহলে তাদের জন্য কাজ করা অনেক সহজ হবে।  র‌্যাম্প শুরু করার আগে আমি তিন মাস লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতায় গ্রুমিং করেছি তাতেই অনেক আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে নিজের ভেতরে।  প্রতিযোগিতাটি আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।  আমি যে আজকের এই তার পেছনে লাক্স চ্যানেল আইয়ের অনেক অবদান।

আনন্দ আলো: এতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে র‌্যাম্পের যে বিষয়টা পরিবর্তন করার পরামর্শ দেবেন-

রুখসানা আলী হিরা: দেশের বাইরের কোরিওগ্রাফারের সাথে কাজের সুযোগ থাকা উচিত, ইভেন্ট পরিকল্পনা, পারিশ্রমিক কাঠামো থেকে শুরু করে অনেক কিছুতেই আয়োজকদের পরিবর্তন আনা দরকার।  তাদের মানসিকতার কিছুটা পরিবর্তন দরকার।  বিদেশের আয়োজকরা খুবই সিসটেমেটিক।  মডেলদের সাথে আয়োজকদের একটা চুক্তিপত্র থাকে।  আয়োজকরা সেটা পূরণে বাধ্য।  একারণেই বিদেশে র‌্যাম্প মডেলরা শুধুমাত্র র‌্যাম্পে কাজ করেই জীবিকার্জন করতে পারে।  আমাদের দেশে সিস্টেমের কোন বালাই নেই।  তাই আমরা শুধু র‌্যাম্পে কাজ করে টিকে থাকতে পারছি না।  আমাদের দেশের প্রেক্ষিত হচ্ছে টিকে থাকতে হলে মিডিয়ার বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করতে হবে।