Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

ময়ূরপাড়া চিংহং

শাকুর মজিদ

শিশুয়াং পাননার রাজধানী শহর জিংহতে নেমেই টের পেলাম, যে যাই বলুক- এটা আসলে ময়ূরের শহর। যদিও, রাসৱাঘাটে হাতির প্রাধান্য বেশী, কিন্তু সাজসজ্জায় হাতি কি পারে ময়ূরের সঙ্গে! সুতরাং ময়ূরের জয় জয়কার।

সম্পর্কিত

রাসৱার মাঝখানে কিংবা হাইওয়েতে, যেখানেই ল্যাম্পপোস্ট আছে, সেখানেই দেখি ময়ূরের সাজ।

স্বর্ণাকে জিজ্ঞেস করি, ভালো উত্তর পাই না। সে তাঁর বান্ধবী ডেবরাকে ডাকে।

ডেবরা এই শহরের মেয়ে, চাকরি করে এখানকার শিল্পকলা একাডেমিতে। সুতরাং

তাঁর কাছে এসবের তথ্য আছে।

শিশুয়াং পাননার মানে ‘বারো হাজার ধান ক্ষেত’। একসময় হয়তো এমনটিই ছিল এই অঞ্চলের অবস্থা। এখন অবশ্য সময় পাল্টেছে। দক্ষিণ সীমানেৱ মিয়ানমার আর লাওসের সীমানার কাছাকাছি এই অঞ্চলটি বিখ্যাত অন্য কারণে। চীনের ৫৬টি নৃ-গোষ্ঠির ১২টিরই বাস এখানে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির আদিবাসীরা এই অঞ্চলে বসবাস করছেন তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে।

অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে আধুনিক জীবন যাপনে অভ্যসৱ হলেও হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্যের চিহ্নসমূহ এখন শুধু তাদের একার নয়, পর্যটকদেরও দেখার বিষয়। এই বিষয়টি নিজের চোখে দেখার জন্য ইয়ুন নান প্রদেশের রাজধানী শহর খুন মিং থেকে উত্তর পূর্ব কোনাকুনি ৬০০ কিলোমিটার দূরের শহর শিশুয়াং পাননাতে আমরা এসে পড়ি।

দাই নৃ-গোষ্ঠির জনগণ অধ্যুষিত এই এলাকাকে এক সময় বলা হতো বন্যপশুর রাজত্ব। হাতি ছিল এই অঞ্চলের প্রধান পশু। শিকার, যুদ্ধবিগ্রহ এবং মালামাল পরিবহনে এই হাতির ব্যবহার ছিল সবচেয়ে বেশি। দাই জনগোষ্ঠি যেহেতু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর, ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে এই পশুটি তাদের কাছে পরম শ্রদ্ধার বিষয়ও। সে কারণেই হয়তো রাসৱাঘাটে, বড় সড়কের মোড়ে, বিভিন্ন আকারের হাতি মূর্তি এই শহরে দেখা যায়।

এই সব হাতিরা এই এলাকার মানুষের জীবন চারণের সাথে মিলেমিশে একাকার। কখনো এইসব হাতিরা এসেছে জীবনের সৌভাগ্যের প্রতীক হয়ে। জীবনে-মরনে হাতি শিশুয়াং পাননাবাসীর একটা বড় অংশ দখল করে আছে। তারই বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল তাদের এইসব উপস্থাপনার মাধ্যমে।

কিন্তু ময়ূরও আমার মাথা থেকে সরছে না। ডেবরা বলেছে আমরা এই চিংহংকে তো ময়ূরের গ্রামও বলি। কেনো বলি তোমাকে কাল দেখাব।

এই কথা রাখার জন্য আজ শুরু হয়েছে আমাদের ময়ূর বিহার। ডেবরা আর স্বর্ণা আমাকে নিয়ে ছুটে চলে শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরের এক জঙ্গলের রাজ্যে।

এটাই ময়ূরের গ্রাম!

কিন্তু কোথায় ময়ূর?

গ্রামটির চারপাশেই উঁচু উঁচু পাহাড়। এর মাঝখানে একটা স্বচ্ছ জলের লেক। এই লেকটির মাঝ বরাবর একটা চৌচালা দেয়ালহীন ঘর। বেশ পুরনো। মনে হয় শত বছরের পুরনো হবে। লেখা আছে- প্রিন্সেস প্যাভিলিয়ন।

জানা গেলো, শিশুয়াং পাননার কোনো এক রাজকুমারী এই প্যাভিলিয়নে বসে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতেন।

এক সময় প্রিন্সেস প্যাভিলিয়নের ঠিক সামনাসামনি আরো সাতটি প্যাভিলিয়ন ছিল। সেখানে বসে এই এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতেন রাজপরিবারের অন্য সদস্যরা।

এই লেকটিকে চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছে পাহাড়। এইসব পাহাড় থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ময়ূরেরা এসে বসতো লেকের পাড়ে। আর তাদের এই ওড়া-উড়ির দৃশ্য প্রাণভরে উপভোগ করতেন রাজকুমারী আর তার রাজন্যবর্গরা। মাঝখানের চত্বরটিতে রাজকুমারীর সাথে দেখা করতে আসতেন তার পানি প্রার্থী অপর রাজ্যের রাজকুমার। এখানে বসেই কথাবার্তা হতো তাদের।

এখানকার লোকজন মনে করে যে রাজকুমার আর রাজকুমারী যখন প্রেমের যুগলবন্দি সে সময়ে উত্তর দিকের পাহাড় থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ময়ূর এসে এই উপত্যাকায় জড়ো হতো। রাজকুমারীর প্রেমের মধুর ক্ষণের সাথে যোগ হতো উড়নৱ ময়ূরের নৃত্য।

কালের খেয়ার আর ইতিহাসের নিষ্ঠুরতায় রাজকুমারী নেই। কিন্তু পাহাড়ী জঙ্গলের ময়ূরগুলো আজও আছে। তাদের ওড়া-উড়ি এবং পেখম মেলে নৃত্যও আছে। সে কারণেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রানৱ থেকে পর্যটকেরা ছুটে আসেন এখানে। আসে চীনা পর্যটকেরাও।

ময়ূয়ের ওড়া-উড়ির একটা নির্দিষ্ট দিক আছে। ময়ূর সবসময় উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে উড়ে। সে কারণেই উত্তর দিকের পাহাড় থেকে ময়ূরগুলো দক্ষিণ দিকের এই উপত্যাকায় এসে নামে।

এককালে এপ্রিল-মে মাসের দিকে ঐ দূরের পাহাড় থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ময়ূর উড়ে আসতো এই উপত্যকায়। লেকের এই মনোরম পরিবেশে বসে ময়ূরের সে উড়াউড়ি দেখতেন দাই রাজারা। এখন দূরের ঐ পাহাড় থেকে আর ময়ূর উড়ে আসে না। কিন্তু সে কারণে পার্কে বেড়াতে আসা পর্যটকেরা ময়ূরের নাচন দেখা থেকে বিরত থাকবেন কেন! সে কারণেই পর্যটকদের জন্য এমন আয়োজন।

ময়ূরের উপত্যকায় এসে আমাদের নামতে হয়। এটি বড়সড় এলাকাকে তারের নেট দিয়ে ঘিরে বানানো হয়েছে ময়ূর বাগিচা। ভিতরে ঢুকতেই দেখা মেলে অসংখ্য ময়ূর বিক্ষিপ্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

এখানে তিনটি প্রজাতির প্রায় ১০০০ ময়ূর আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে দামী প্রজাতি হলো গোল্ডেন পিকক্‌ বা সোনালী ময়ূর। আর সব থেকে বেশী যে ময়ূরটি চোখে পড়ে সেটি হলো ভারতীয় ময়ূর। এই ময়ূরই ভারতের জাতীয় পাখি। এই ময়ূর বাগিচায় একটি মাত্র সাদা জাতের ময়ূর আছে।

এই ময়ূর বাগিচায় বছরে একবার একটি উৎসব হয়। চীনারা মনে করে ময়ূর সৌভাগ্য আর মমতার প্রতীক। এর মধ্যে সোনালী ময়ূর সবচেয়ে বেশী সৌভাগ্য বয়ে আনে।

এই ময়ূরবাগান নিয়ে অনেক কিংবদনিৱ আছে। একসময় পাশের গ্রামের এক রাখাল বালক খেলার ছলে একটি সোনালী ময়ূরকে মেরে ফেলে। তারপর থেকে তাদের জীবনে দুঃখ দুর্দশা নেমে আসে। তখন তারা তাদের গ্রামের সবচেয়ে বড় শুকুরটিকে সেই সোনালী ময়ূরের নামে উৎসর্গ করে শুকুরের মাথাটি নিয়ে এনে রাখে এই উপত্যাকায়। তারপর থেকে এই উপত্যাকায় ময়ূরগুলো আবার ফিরে আসতে শুরু করে। সে প্রথা এখনও চলে আসছে। এখনও এপ্রিলের ১৪ তারিখে দাই সম্প্রদায়ের যুবকেরা একটি শুকুর জবাই করে সোনালী ময়ূরের নামে উৎসর্গ করে এই ময়ূরবাগে। এপ্রিল মাসেই ময়ূরেরা বসনেৱর আবাহনে সেজে থাকে বেশী। আমরা এসেছি নভেম্বরে। একটু শীত শীত ভাব। যদিও বলা হয়ে থাকে, শিশুয়াং পাননায় বছরে ৮ মাসই নাকি বসনৱ থাকে। তবে এই বসনৱ শেষ হয় অক্টোবরে। মার্চ মাস থেকে আবার বসনৱ শুরু হয়ে যায়। তাই এই নভেম্বর মাসে পেখম মেলে ময়ূরের নৃত্য দেখতে পাবো এমন আসা করা যায় না। এপ্রিল-মে তে ময়ূরেরা পেখম মেলে নাচে। সে সময়ে পরুষ ময়ূরেরা তাদের রঙিন পেখম মেলে নেচে নেচে তার সঙ্গী ময়ূরীর মনোরঞ্জনের চেষ্টা করে তার মন পাওয়ার জন্য। কিন্তু এখন এই অবেলায় অসময়ে কোন ময়ূর কি নেচে উঠবে। আমি ক্যামেরা তাক করে রাখি। পেয়ে যাই দুই রসিক ময়ূরকে। তারা তাদের ময়ূরীর মন পাওয়ার জন্য নাচতে শুরু করেছে। খুব একটা বেশী সময় দেখা যায় না তাদের নৃত্য। হয়তো এই জনসমাগমের মধ্যে তাদের লাজ সরমে পেয়ে বসে।

এখানে যে সব পর্যটক আসেন তাদের বেশীর ভাগের খায়েস থাকে একটি ময়ূর পেখম মেলে নাচবে আর সে ওই ময়ূরের সাথে তার ছবিটি তুলে স্মরণীয় করে রাখবে তার মুহূর্তটিকে। কিন্তু ময়ূরের নাচের মুডের তো ঠিক নেই। পর্যটক কি সেই সময় পর্যনৱ অপেক্ষা করবে। অথবা ময়ূর কি পর্যটকের চাহিদা মতো পোজ দেবে? কিন্তু পর্যটকের ইচ্ছা তো পূরণ করতে হবে। তার জন্য আছে ব্যবস্থা। পর্যটকেরা একটি ময়ূরকে তার কোলের উপরে ধরে রাখবে আর পেছন থেকে এখানকার পরিচারিকারা ময়ূরের পেখমটা মেলে ধরবে সামনে থেকে দেখলে মনে হবে যেন ময়ূরটা পর্যটকের কোলের উপরে বসে পেখম মেলে আছে। সাথে সাথে দৃশ্যটা বন্দি হয়ে যাবে ক্যামেরায়। এভাবেই পর্যটকেরা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটান।

এক চীনা পর্যটককে দেখলাম অদ্ভুত এক কাজ করতে। সে একটি ময়ূরের সামনে একটি লাল চাদর দুলিয়ে দুলিয়ে নাচছে। হয়তো বা সে নেচে নেচে ময়ূরটিকে উদ্ভুদ্ধ করছে নাচার জন্য। পর্যটকের মনোভাবটা এমন যেন দেখো আমি তোমার ময়ূরী আমি নাঁচছি … আমার মন পাওয়ার জন্য তোমারও তো নাচা উচিত। কোনভাবেই ময়ূরের মন ভোলে না। পর্যটকটি হাল ছেড়ে দেন। কোন কোন পর্যটক আবার এই ময়ূরগুলোকে খাইয়েই আনন্দ পান।

পর্যটকদের জন্যে সাজিয়ে রাখা ময়ূরের গ্রামে আছে অনেকগুলো সুভেনিয়ের শপ। তাঁর সবকিছুই বানানো হয়েছে ময়ুরের পেখম দিয়ে। আমি কয়েকটা বল পয়েন্ট কলম কিনি । ডেবরা বলে, আগের দিনের রাজারা এই রকম কলম ব্যবহার করতো। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে যেমন কলম বানানো হতো, ময়ূরের পালক দিয়েও তা। পার্থক্য এইটুকু যে, আগে ব্যবহার হতো কালি, এখন শিশ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।

আমার দুই সঙ্গিনীরা ব্যসৱ হয়ে কানের দুল কিনছে। স্বর্ণা সঙ্গে সঙ্গে একটা দুল কানে লাগিয়ে নেয়।

এই ময়ূর পূজারি দাই সম্প্রদায়ের রাজবাড়িটাও একবার দেখেছিলাম । এখানে এখন আর কোনো রাজা থাকেন না। কিন্তু আছে রাজকীয় কীর্তিকলাপের সব নিদর্শন। সেই ড্রাগন, সেই কচ্ছপ, সেই ফিনিক্স, প্রাচীন চিত্রকলা, চিত্রভাষা, এসব।

এক সময় এই যাদুঘরটি দাই সম্প্রদায়ের রাজবাড়ি ছিলো। যদিও পুরো এলাকাটাই পাহাড়ী তারপরেও একটি উঁচু টিলার উপরে যাদুঘরটির অবস্থান। রাজা বাদশাহরা সব সময়ই উঁচু টিলা বা পাহাড়ের উপরই তাদের প্রাসাদ বা দুর্গ বানাতেন। এখানেও সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। কয়েকটি সিঁড়ি মাড়িয়েই তবে মূল যাদুঘরটিতে ঢুকতে হবে।

যাদুঘরটিতে উঠার সিঁড়ির রেলিংটা পাহারা দিয়ে আছে বেশ বড়সড় দুটি ড্রাগন। ড্রাগন হলো রাজার প্রতীক। ড্রাগন তাদের শৌর্য্য বীর্জ এবং সৌভাগ্যের প্রতীকও। যাদুঘরটির উপরে একটি সাইন বোর্ড ‘মিংলি মিউজিয়াম’। মিংলি অর্থ হলো বড় জায়গা। মিং অর্থ বড় লি অর্থ জায়গা। যেহেতু এটি রাজপ্রাসাদ ছিলো সেহেতু নিঃসন্দেহে এটি বড় জায়গা। সে কারণেই এর নামকরণটি এরকম।

যাদুঘরটিতে ঢুকতেই দেয়ালে বড় একটি দেয়ালচিত্র। দেয়ালচিত্রটিতে দাই রাজার শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানটি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। অনেকগুলো চিত্রের সমন্বয়ে একটি সমন্বিত দেয়াল চিত্র এটি।

দাই সম্প্রদায়ের কোন ফ্যামিলি টাইটেল নেই। সে কারণে দাই রাজাদের কোন টাইটেলও পাওয়া যায় না।

দাই রাজাদের শপথ গ্রহণ প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। প্রথমে একজন কবিরাজ পাহাড়ে গিয়ে বিভিন্ন রকম ঔষুধ সংগ্রহ করেন। তারপর বিভিন্ন নদী থেকে পানি সংগ্রহ করে এই পানিকে সংগৃহীত ঔষুধগুলো দিয়ে জীবাণুমুক্ত করেন। রাজা এই পানি দিয়ে গোসল করেন। কিন্তু গোসলের আগে রাজা গ্রামের একজন বয়োজ্যেষ্ঠ বৃদ্ধের কাছ থেকে গৌতম বুদ্ধের কিছু বাণী শোনেন। গোসল শেষে ৭০ বছরের বেশি বয়স্ক একজন প্রজা সকল প্রজার পক্ষ থেকে রাজাকে শুভেচ্ছাপত্র পাঠ করে শোনান। এরপরে রাজা বেইজিং থেকে আসা মহাচীনের রাজার একজন প্রতিনিধি এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের পাঠানো রাষ্ট্রদূতদের প্রতিনিধিদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।

এ সময় এ সকল রাষ্ট্রদূতেরা তাকে শপথ গ্রহণের অনুমতি দেন। শপথ গ্রহণের অনুমতি পাওয়ার পরে দাই সম্প্রদায়ের একজন বৌদ্ধধর্মীয় নাগরিক রাজাকে শপথ বাক্য পাঠ করান। সব শেষে কেন্দ্র থেকে আসা কেন্দ্র সরকারের একজন মন্ত্রী রাজার হাতে একটি সিল তুলে দেন। তিনি যে এ এলাকার শাসক এই সিলটি তারই প্রতীক।

রাজার শপথ গ্রহণ চিত্রের পাশেই একটি সাদা কাপড়। কাপড়ের উপরে একটি ফিনিক্স আঁকা। ফিনিক্স হলো রাণীর প্রতীক। সাদা কাপড়ের উপরে ফিনিক্স অংকীত এই প্রতীকটিই হলো দাই সম্প্রদায়ের পতাকা। রাজা যেখানে যান সেখানে সবার আগে একজন পতাকাবাহি থাকেন যার হাতে থাকে এই পতাকাটি। পাশের শো’কেসটিতে রাজাদের পোষাক আশাক সাঁজিয়ে রাখা হয়েছে।

Peacok-1পাহাড়ের ঢালুতে যখন একটি দাই গ্রাম গড়ে ওঠে, তখন সব সময় গ্রামটি গড়ে ওঠে একটি পাহাড়ী ঝর্ণার পাশে। পানির উৎসকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে একটি গ্রাম। কারণ পাহাড়ে জীবন ধারনের জন্য সব কিছুই সহজ প্রাপ্য, শুধু পানি ছাড়া। পাহাড়ে পানির একমাত্র উৎস পাহাড়ি ঝর্ণা। ঝর্ণার এই পানি পাহাড়ের উপরে উঠিয়ে নেবার জন্য তাদের একটা নিজস্ব পদ্ধতি ছিল। হাইড্রোলিকস এর এই পদ্ধতিটি এখনকার দাইবাসির কাছে শুধুই ইতিহাস, আর অনুসন্ধানী পর্যটকের কৌতুহল নিবৃতির উপকরণ হয়ে এখন এই যাদুঘরে।

দাই পরিবারের কর্তা থাকে না, কর্ত্রী থাকে, তাঁর কোমরে থাকে ঘরের সিন্দুকের চাবি। এটা সে ছাড়া আর কেউ ব্যবহার করতে পারে না। মাথায় খোঁপার সাথে ফুল আটকানো থাকে। যখন কোনো দাই মেয়ে মাথার ডান দিকে ফুল গুজে রাখে বুঝতে হবে সে তার কোন প্রিয় মানুষকে দেখানোর জন্য এ ফুলটি গুজে দিয়েছে। আর সে যদি খোঁপার বাম দিকে ফুলটি গুজে রাখে তাহলে বুঝতে হবে সে কুকুরকে দেখানোর জন্য খোঁপায় ফুল গুজেছে।

আমরা রাজবাড়ি পাশ কাটিয়ে একটা পুরনো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াই। পুরোটাই কাঠ দিয়ে বানানো। লিউ বলে, দাই সম্পদ্রায়ের ঘর বাড়িগুলো হয় এরকম মাচার উপরে। নীচের ফাঁকা জায়গাটা গৃহপালিত পশুপাখিদের জন্য। দেখে মনে হলো- একেবারেই আমাদের পাহাড়ি অঞ্চলের বাড়ির মতোই তার রূপ। কিন্তু বাড়ির কতোগুলো বিশেষত্ব শুনে মজা পেলাম।

বাড়ির উপরের ধাপে উঠার জন্য যে সিঁড়ি আছে তা কচ্ছপরূপী একটি পাটাতনের উপরে। তাঁরা মনে করে এই ভারবাহী প্রাণীটি তাদের পরিবারের সকল ভার বহনের জন্য উপযুক্ত। আর যে সিঁড়িটা দিয়ে উপরে যাবে একে মনে করে ড্রাগন, যা সৌর্য-বীর্জ আর সৌভাগ্যের প্রতীক। এই সিঁড়ি দিয়ে যখন তারা উঠে তখন তারা মনে করে তারা সৌভাগ্যের শিখরে উঠছে।

যে বাড়িটি আমাদের সামনে, সেখানে এখন আর কেউ থাকেন না, এক সময় দাই সম্প্রদায়ের কোন পদস্থ কর্মচারীর ঘর ছিল এটা। আমাকে বলা হলো, চাইলেই এ ঘরের ভেতরটা আমি দেখে আসতে পারি।

দোতালার বারান্দায় উঠতেই দেখি আমার সঙ্গে থাকা দুই চীনা তরুণী অনেকক্ষণ ধরে নিজেদের মধ্যে কথা বলে, হাসাহাসি করে এবার ঠান্ডা হয়েছেন। ইউয়াং এসেছে আমার কাছে। দোতালার খাম্বাটিকে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে- এর অনেক কাহিনী আছে। এটা পরিবারের জামাইর জন্য ।

এ সম্প্রদায়ের ছেলেরা বিয়ের পরে কনের বাড়িতেই থাকে। কোন কারণে যদি ছেলের মন খারাপ হয় অথবা তার বাবা মাকে দেখতে মন চায় তখন সে এই কাঠের খাম্বার কাছে বসে থাকে। তখন তার শ্বাশুড়ি কিছু দিনের জন্য তার জামাতাকে ছেড়ে দেন মায়ের বাড়িতে নাইওর যাওয়ার জন্য।

দাই সম্প্রদায়ের কোন যুবতী যখন বিয়ের উপযুক্ত হয় তখন সে একটি নির্জন স্থানে গিয়ে পাতার বাঁশি বাঁজাতো। সে বাঁশি শুনে ছেলেরা এসে তার পাশে বসতো। যদি ছেলেটিকে তার পছন্দ না হয় তখন সে বাঁশি বাঁজানো বন্ধ করে দেয়, এই ছেলেটি তখন চলে যায়। আর যদি তার পছন্দ হয় তখন সে বাঁশি বাঁজাতেই থাকে।

তারপর ছেলেটি তার অভিভাবকদের মাধ্যমে মেয়েটির পরিবারে বিয়ের প্রসৱাব পাঠাবে। মেয়েটির পরিবার যদি রাজি হয় তখন ছেলেটিকে পাঠানো হয় মেয়ের পরিবারে দুই বছরের জন্য, স্রেফ কাজের ছেলে হিসাবে। পশুপাখি লালন-পালন, ক্ষেতে খামারে সাহায্য করা, এসব কাজ তার। তবে ছেলেটি যদি এই দুই বছর অপেক্ষা করতে না চায়, তখন একটি সুপারী গাছের মাথায় উঠে ক্ষমা ভিক্ষা করবে। মেয়েটি তাকে ক্ষমা করে দিলে দু’বছরের আগেই বিয়ে করে এই বাড়িতে রেখে দেবে। তবে ছেলেটি যদি সুপারী গাছের মাথায় না উঠতে পারে তখন এই বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে যাবে। ছেলেটি নিজের বাড়িতে ফিরে গেলে েেময়েটি আবার নির্জনে গাছের তলায় বসে পাতার বাঁশি বাজাবে।

দাইদের এমন জীবনাচার এখন আর নাই। কিন্তু আছে তাদের সাহিত্য ও সংগীতে। দাই গ্রামে যে নৃত্যনাট্য দেখেছিলাম, সেখানেও ছিল এমন আয়োজন। আর সে আয়োজনের সূচনা হয়েছিলো ময়ূরও নাচ দিয়ে।

দাই পাড়ার এক নাচের অনুষ্ঠানে দাই রমনীকে দেখেছিলাম ময়ূরির বেশে। যন্ত্র সংগীতের তালে তালে একদল নট-নটি মঞ্চে প্রবেশ করে। তাদের ভাষার এক বর্ণও বুঝি না। কিন্তু কিছু শারিরীক ভাষা আছে সার্বজনিন। নাচের এই মুদ্রাটিও তেমন। এই নর্তকী তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহারে মুহূর্তের মধ্যে আমাদের কাছে ময়ূরী বলেই মূর্ত হয়ে যান।

হ্যাঁ এটিই ময়ূরনৃত্য। এই নাচটি দাই সম্প্রদায়ের অত্যনৱ জনপ্রিয় একটি নাচ। জনপ্রিয় হওয়ার অনেক কারণ। মূল যে নাচিয়ে থাকে তার পোষাকটি হয় আকর্ষণীয়। পেখম মেলা ময়ূরের আদলে যেহেতু পোষাকটি তৈরি করা হয় সে কারণে সাবলীলভাবেই নাচিয়ে তার গতিবিধি পরিবর্তন করেত পারেন। পেখম মেলা ময়ূরের পোষাকের মধ্যে যে মানবী থাকে তাকেও অনেক জীবনৱ মনে হয়। তাই বনের ময়ূর কখন যে মঞ্চে এসে মানবীর রূপ ধরেছে হঠাৎ করে তাকে আর আলাদা করা যায় না। দাই সম্প্রদায়ের কাছে ময়ূর অনেক পূজনীয়। এই সম্প্রদায়ের লোকজন মনে করে ময়ূর হলো সুন্দর ভবিষ্যৎ, সুখ, সৌন্দর্য আর দয়ার প্রতীক। সে কারণেই তারা কোন অনুষ্ঠানে শুরুতে এই ময়ূর নাচটিই পরিবেশন করে।

বছরে আট মাস বসনৱ থাকা এই ছোট্ট জনপদটি বিখ্যাত হয়ে আছে আসলে তাঁর প্রকৃতি, আদিবাসীদের সংস্কৃতি আর ময়ূরের কারনে। বছরে আট মাসই এই চিংহং পেখম মেলে নাচে।