Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

মেয়েদের ক্রিকেট এগিয়ে যাবার গল্প

মেয়েরা আবার ক্রিকেট খেলে নাকি? ওরাতো দৌড়াতেই পারে না। এরকম নেতিবাচক কথামালার বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে মেয়ে ক্রিকেটারদেরকে। মাঠের ক্রিকেট লড়াইয়ে ব্যর্থ হবার পর ক্রিকেট কর্তৃপক্ষও তাদের নিয়ে কত কথাই না বলেছেন। কিন্তু আমাদের নারী ক্রিকেটাররা তাদের প্রতিভার ঝলক দেখানোর পর থেকেই পাল্টে গেছে পরিবেশ। মেয়েদের ক্রিকেট এবার সমীহ পেতে শুরু করেছে। কিন্তু ওদের চলার পথ কি এখনও মসৃণ? টি-২০ দলের অধিনায়ক সালমা খাতুন ও ওয়ানডে দলের ক্যাপ্টেন রুমানা আহমেদের সংগ্রামী ক্রিকেট জীবনের গল্প নিয়ে সাজানো হয়েছে বিশেষ প্রতিবেদন। লিখেছেন মামুনুর রহমান…

স্বপ্নের সাথেই হেঁটেছেন সালমা

সম্পর্কিত

মরহুম জয়নাল সরদার ও ফরিদা বেগমের দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে সালমা সবার ছোট। দাদাবাড়ি ফরিদপুরে। সালমার জন্ম নানাবাড়িতে ১৯৯০ সালে। শৈশবও কেটেছে সেখানে। কৈশোরেরও অনেক দিন। রূপসার মিলকি দোয়ারায় মামার বাড়িতে মামাতো ভাইদের কাছেই ক্রিকেটে হাতেখড়ি সালমার। দিন পার হতো ক্রিকেট খেলেই। মায়ের বকুনিও খেতেন দিনভর। আবার মা-ই অনুপ্রেরণা। প্রথম প্রথম গাঁয়ের ছেলেরা তাঁকে খেলায় নিতে চাইত না। কিন্তু সালমা এত ভালো খেলতেন যে ছেলেরাও হার মানত। কোন দল তাঁকে নেবেÑতা নিয়েও টানাটানি হতো। বলছিলেন, তখন কী আর জানতাম দেশে মেয়েদের ক্রিকেট দল হবে। ২০০৭ সালে মামাতো ভাই সবুজের বন্ধু মঈন পত্রিকা দেখে জানলেন মেয়েদের ক্রিকেট টিম হবে। তিনি আমাকে একদিন খুলনা জেলা ক্রীড়া সংস্থায় নিয়ে যান। তত দিনে দুই-তিন দিন প্রশিক্ষণ হয়ে গেছে। তখন আমি থ্রি পিস পরে ক্রিকেট খেলতাম। ক্রীড়া সংস্থায় কোচ ছিলেন সালাউদ্দিন স্যার। তিনি জানতে চাইলেন, আমি কতটা কী পারি। বললাম, ব্যাট করতে পারি। পেস বোলিং পারি, আর স্পিনও পারি। স্যার আমার পরীক্ষা নিলেন। খুশিও হলেন। আমাকে খেলার ড্রেস কিনে দিলেন।
সেবারই আরো ২৫-২৬ জনের সঙ্গে খুলনা জেলা দলে নাম লেখান সালমা। কোচ ইমতিয়াজ হোসেন পিলু আর সালাউদ্দিনের তত্ত¡াবধানে প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন। খুলনা জেলা দলে ভালো করে জাতীয় দলে যোগ দেন। তিনি ২০০৮ সালেই গ্রামীণফোন-প্রথম আলো বর্ষসেরা পুরস্কার লাভ করেছেন। খুলনা জেলা ক্রীড়া লেখক সমিতি পদকও পেয়েছেন। উল্লেখ্য, তাঁর নেতৃত্বেই এশিয়া কাপ জিতেছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। সর্বশেষ আয়ারল্যান্ডকে (১৪ জুলাই ২০১৮) হারিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বাছাই পর্বেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
সেই যে আমার নানান রঙের দিনগুলি
ছেলেদের ক্রিকেটের তুলনায় সুযোগ-সুবিধায় অনেক পিছিয়ে ছিলেন নারী ক্রিকেটাররা। সম্মানীও উল্লেখ করার মতো নয়। সাধারণ গাড়িতে চড়েই খেলতে গেছেন। কিন্তু হার মানেননি সালমারা। জাতীয় দলের কোচ জাফরুল এহসান সালমাদের হারতে দেননি। তিনিই সালমাকে বদলে দিয়েছেন। অনুশীলন ম্যাচগুলোতে ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব দিতেন সালমাকে। সালমা সেসব পরীক্ষায় পাসও করেছেন। পরে তাঁকে জাতীয় দলের ক্যাপ্টেন করা হয়। সেটা ২০০৮ সাল। তিনিই দেশের নারী ক্রিকেট দলের প্রথম ক্যাপ্টেন। তার পরও অনেক দুঃখের দিন গেছে। আজ কোচ সংকট তো কাল ম্যাচ নেই। সফরও ছিল না। তবে সালমারা অপেক্ষায় ছিলেন। শেষে ফাহিম স্যার (নাজমুল আবেদিন ফাহিম, এখন বিসিবির নারী ক্রিকেট কমিটির গেম ডেভলপমেন্ট ম্যানেজার) আবার আলো দেখালেন। সালমা বলছিলেন, আমরা এ বছর ভালো সফর ও ম্যাচ পাচ্ছি। আর ফাহিম স্যার তো আমাদের বড় সাপোর্ট। একসময় বোলিং আর ফিল্ডিংয়ে ভালো করলেও ব্যাটিংটা নড়বড়ে ছিল। এখন অবস্থা বদলে গেছে। ওপেনিং জুটি রান পাচ্ছে। ব্যাটসম্যানরা ভালো করছে। ফাহিম স্যারই আমাদের সাফল্যের নায়ক। আমরা এশিয়া কাপ জিতেছি। বিশ্বকাপ বাছাই ম্যাচের সাফল্যের পেছনেও স্যারের কথাই বলতে হয়।
সহযোগিতা দিন
আন্ত জেলা ক্রিকেট ও নিয়মিত লিগ আয়োজন হলে আমাদের উন্নতি হবে। নিয়মিত বড় বড় দলের বিপক্ষে খেলতে পারলেও আমাদের উন্নতি হবে। নতুন ক্রিকেটারদের অনেকে টিকে থাকতে পারছে না আর্থিক সংকটের কারণে। সামাজিক চাপ তো আছেই। আমরা দেশকে এশিয়া কাপ এনে দিয়েছি। বিশ্বকাপ জয়েরও স্বপ্ন দেখি। আমাদের সঙ্গে থাকুক বাংলাদেশ।
ক্রিকেটই আমার প্রেম
আমি ক্রিকেট পাগল মানুষ। ক্রিকেট নিয়েই বাঁচতে চাই। খেলা চালিয়ে যেতে চাই আরো পাঁচ-ছয় বছর। প্রতিটি ম্যাচই আমার কাছে বিশেষ কিছু। প্রতিটি ম্যাচেই নিজের সেরাটা দিতে চাই। প্রতি ম্যাচেই উন্নতি করতে চাই।

বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখেন রুমানা

টিভিতে খেলা দেখতে দেখতে ক্রিকেটকে রুমানার ভালো লেগে যায়। সেটা ছোটবেলার কথা। তারপর ভাইদের সমর্থন পেয়ে ব্যাট-বল নিয়ে বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায় নেমে পড়েন। জায়গাটা খুলনার খালিশপুরে। সেই মেয়েটি ক্যাপ্টেন, অলরাউন্ডার। ব্যাট হাতে যেমন, বল হাতেও তেমন। ডানহাতি ব্যাটসম্যান আর ডানহাতি লেগ ব্রেক বোলার। গড়নে ছোটখাটো কিন্তু দেশকে দিয়েছে বড় কিছু। ওডিআইতে হ্যাট্রিক করেছেন রুমানা। ২০১৬ সালের নভেম্বর থেকে তিনি ওডিআই অধিনায়ক। রুমানার ওডিআইতে অভিষেক ঘটে ২০১২ সালের ২৫ আগস্ট। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে। রুমানার জন্ম ১৯৯১ সালে। বাবা মরহুম শেখ হাতেম আহমেদ ও মা জাহানারা বেগম। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে রুমানা দ্বিতীয়। ভাইটি ইতালি প্রবাসী। বোনেরা গৃহিণী।
ফেলে আসা দিনগুলি
যেমনটা হয় ছেলেদের দল তাঁকে নিত না। কিন্তু মেয়েদের দল কোথায়? তারপর ২০০৮ সালে খুলনার দৈনিক পূর্বাঞ্চলের মাধ্যমে জানতে পারেন জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের কথা। এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছিল সবে। তাই অবসর ছিল। ভাই আর ছোটবোনকে নিয়ে হাজির হন খুলনা জেলা স্টেডিয়ামে। কিন্তু কোচ ইমতিয়াজ হোসেন পিলুর দেখা পেলেন না। জানলেন, কোচ ঢাকায়। ফিরতে সময় লাগবে। ২০ দিন পর আবার গেলেন। পিলু স্যারের দেখাও পেয়ে গেলেন। তিনি রুমানাকে ভর্তিও করে নিলেন। রুমানা বললেন, ‘সালমা-শুকতারা আপুদের জাতীয় দলে খেলতে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি। পিলু স্যার শিখিয়েও ছিলেন যতœ করে।’
জেদ ধরেছিলেন বলেই…
মা চাইতেন না মেয়ে ক্রিকেটার হোক। কিন্তু মেয়ের আগ্রহ দেখে আর নিষেধ করতে পারেননি। ভাই ও বোনেরা অবশ্য পক্ষেই ছিল। খালিশপুরের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ায় প্রতিবেশীরাও সে রকম যন্ত্রণা দিতে পারেনি। ২০০৯ সালে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে মেয়েদের ত্রিদেশীয় সিরিজ হয়েছিল দেশেই। কিন্তু অজানা কারণে ওই সিরিজে রুমানা জায়গা পাননি। কিন্তু রুমানার জেদ ধরে যায়। সেরা হয়ে দলে জায়গা নেওয়ার পণ করেন। শুরুতে ছিলেন অফ স্পিনার, জেদ করে বোলিংয়ের ধরনও বদলান। আয়ত্তে আনেন লেগ স্পিন। অস্ট্রেলিয়ার শেন ওয়ার্নকে দেখে দেখে শিখেছেন। এখন পর্যন্ত জাতীয় দলের নির্ভরযোগ্য লেগ স্পিনার তিনিই। রুমানা বললেন, ‘বাবা বেঁচে থাকতে তিনিও আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন। ভাই-বোনরা আমাকে নিয়মিত মাঠে নিয়ে গেছেন। জাতীয় দলে ঢুকতে খুব পরিশ্রম করেছি। সব সময় মনে করেছি, ক্রিকেট শুধু নিজের জন্য নয়, দল ও দেশের জন্য। ভাবি, আমি ভালো খেললে দল ভালো করবে। আর দল ভালো করলে দেশের সুনাম হবে। তাই সব সময়ই সবটা দিয়েই খেলি।’
ভবিষ্যৎ ভাবনা
ত্রিদেশীয় সিরিজ (২০০৯ সাল) থেকে বাদ পড়ায় খুব কষ্ট পেয়েছিলেন রুমানা। তবে ওই কষ্টই তাঁকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। সর্বশেষ ১০ জুন এশিয়া কাপের ফাইনালের দিনটির কথা মনে আছে রুমানার। ভারতকে তিন উইকেটে হারিয়ে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। সে ম্যাচে ব্যাটে-বলে দারুণ উজ্জ্বল ছিলেন। বল হাতে ২ উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি ব্যাটহাতে গুরুত্বপূর্ণ ২৩ রান করেছিলেন। হয়েছিলেন প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ। মেয়েদের ক্রিকেট নিয়ে কম প্রচারণা, কম আগ্রহ দেখেও কষ্ট পান। বলেন, ‘মেয়েদের ক্রিকেটের কথা অনেকে জানেও না। তাই প্রয়োজন তৃণমূল পর্যায়ে টুর্নামেন্ট আয়োজন করা। ক্রিকেটারদের সুযোগ-সুবিধাও বাড়াতে হবে। বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন নিয়ে এগোচ্ছি। চাই সারা দেশ একই স্বপ্ন দেখুক।’