Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

মা এবং মাতৃভুমিই আমার গানের দুনিয়া

মাহবুব আহমেদ, গীতিকার

আমার মায়ের সবুজ আঁচল হৃদয় ছোঁয়া শিরোনামে প্রকাশিত দেশাত্মবোধক গানের এই সিডির সবগুলো গানই লিখেছেন বিশিষ্ট গীতিকার মাহবুব আহমেদ। ছাত্র জীবন থেকেই লেখালেখির সঙ্গে জড়িত। এটি তাঁর প্রকাশিত প্রথম গানের সিডি। প্রসঙ্গ তুলতেই বললেনÑ আমার এই সিডিতে ১০টি গান আছে। মায়ের আঁচলের সঙ্গে আমি আমার দেশ ও প্রিয় জাতীয় পতাকাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। মা এবং মাতৃভুমি আমাদের কাছে সমান প্রিয়। মায়ের আঁচল যেমন আমাদের নিরাপদ আশ্রয় মাতৃভুমিও তাই। সে কারণেই এই সিডির নাম দেওয়া হয়েছে ‘আমার মায়ের আঁচল’।

সিডির কভারে মাহবুব আহমেদ লিখেছেন, ‘উত্তরে প্রতিবেশী হিমালয় আর দক্ষিণে দিগন্ত ছোঁয়া সমুদ্র। দুইয়ের মাঝে সবুজ-সোনালি গালিচায় মোড়া সুপ্রাচীন এই জনপদের মানুষের রয়েছে সহশ্রাব্দ প্রাচীন ঐতিহ্য। সময়ের বঁাঁকে বাঁকে রচিত এর গৌরব সমৃদ্ধ ইতিহাস। প্রথম পদ্মার ক‚লে ক‚লে মেঘনা যমুনার কলকল্লোলে এদেশের মানুষের হৃদয়তন্ত্রীতে জাগানো ভাবনা কথামালায় আবদ্ধ করে আমি সুরকারের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। সুরের ইন্দ্রজাল দশজনগুণী শিল্পীর সুললিত কণ্ঠে মাধুরী মÐিত হয়ে উঠেছে। কথামালায় সুরারোপ এবং কণ্ঠদান করে সুরকার ও শিল্পীবৃন্দ আমাকে সম্মানিত করেছেন এবং কৃতজ্ঞতায় বজ্জুবদ্ধ করেছেন।

অনেক ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া লাল টিপ নিয়ে আমার মায়ের সবুজ আঁচল আকাশ জুড়ে উড়ছে। তিরিশ লক্ষ শহীদের চ‚ড়ান্ত আত্মদানে মুক্ত স্বদেশ ভুমি সুখ ও সমৃদ্ধির পত্র পল্লবে সুশোভিত হোক এবং তার পলিতে পললে আমাদের দেশ প্রেমের মজবুত শেকড় নামুক এই আমার প্রত্যাশা।

দেশের গান আমার মায়ের সবুজ আঁচল

Mahbubবিশিষ্ট গীতিকার মাহবুব আহমেদের দশটি দেশাত্মবোধক গান নিয়ে ইমপ্রেস অডিওভিশন প্রকাশ করেছে একটি গানের সিডি। ‘আমার মায়ের সবুজ আঁচল শিরোনামে’ এই গানের সিডি ইতোমধ্যে ব্যাপক আলোচিত হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে লিখেছেন মাসুদ আহমেদ।

মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় অবলম্বন তার মাতৃভুমি। কোনো রাজনৈতিক অধিবাসের প্রায় সকল অধিবাসী মাতৃভুমিতেই বসবাস করেন। যারা দেশত্যাগি তারাও ঐ দেশমাতৃকার স্মৃতি ধারণ করে বাঁচেন। গীতিকবি মাহবুব আহমেদ দেশ মাতৃকাকে উপজীব্য করে এই সিডির ১১টি গীতি কবিতা রচনা করেছেন। পরে সুরারোপিত হয়ে দেশের বিশিষ্ট এবং উদীয়মান কণ্ঠশিল্পীদের কণ্ঠে এগুলো সুশ্রাব্য সংগীতে পরিণত হয়েছে। ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’, ‘মুক্তির-মন্দির-সোপান তলে’, ‘পলাশ ঢাকা কোকিল ডাকা’ এবং ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ এর দীর্ঘসূত্র ধরে মাহবুব আহমেদ এই গীতি কবিতাগুলোকে সমসাময়িকতায় যুক্ত করে রচনা করেছেন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিবর্তনের ধারায় সময়ের ক্রমানুবর্ত অনুযায়ী প্রথমে এসেছে ৩০ লক্ষ শহীদের লাশের কথা। এসেছে হাজার বছর ধরে পদ্মা, মেঘনা, যমুনার ঢেউ-এর সঙ্গে দেশ প্রেমের ঢেউ এবং আত্মত্যাগের করুণ গাঁথা। চরম ভোগান্তি, যন্ত্রণা ইত্যাদির পর গীতিকবি প্রশ্ন করেছেন ভোরের ফুল ফুটতে কত দেরী? রবির উদয়ের মধ্য দিয়ে আশাবাদের পরিণতি দিয়ে গানটি শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় গানটিতে প্রস্তাবনাটি চমৎকার এবং সর্বব্যাপী। কারণ এখানে আকাশ জুড়ে পাতা রয়েছে মায়ের সবুজ আঁচল এবং নিচে মাটির উপর রয়েছে তার লাল টিপ আঁকা। কবির নিসর্গমনষ্কতা এই গীতি কবিতাটিতে উচ্চমানে প্রস্ফ‚টিত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে বাংলা ভাষার প্রসার, দেশের আকাশ, পাহাড়-চ‚ড়া, সীমান্ত অঞ্চল, সাগর এবং মহাদেশ পেরিয়ে বিরাজমান। আমাদের এই প্রিয় জনপদের ভাবমূর্তিকে কবি গ্রোথিত এবং প্রোথিত করতে সক্ষম হয়েছেন। তার মাধ্যম হয়েছে মর্মস্পর্শী উপমা ও উৎপ্রেক্ষা। ‘৭১ এর দিনগুলি’ গানটিতে মনোময়, স্মৃতিমেদুরতা বা ইংরেজিতে ডাউন মেমোরী লেন ভিজিট খুব শিল্পসম্মতভাবে এসেছে। হাইনরিক বোল তাঁর একটি বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘ইউরোপীয় সমাজের জন্য এক সময়ে ৪টি শব্দ যেকোনো মানুষকে মুহূর্তে আকৃষ্ট করত। সেগুলো হচ্ছে গীর্জা, রুটি, বাইবেল এবং যুদ্ধ।’ সেই সূত্রে বলা যায় ৭১, বাংলাদেশের মানুষদেরকে কয়েকটি শব্দের সঙ্গে চিরস্থায়ী সংযোগ ঘটিয়েছে। সেগুলো হলোÑ রাইফেল, গ্রেনেড, বন্ধুরপথ, ভয়ভীতি পায়ে দলে যুদ্ধ জয়ে উন্মাদনা, রাতের আঁধার, শূন্য ভিটায় সম্ভ্রম হারা নারী এবং অশ্রæ। গীতি কবি এই গানটিতে ৭১ এর সেই আতঙ্কের দিন এবং রাতগুলোকে অব্যর্থভাবে আঁকতে পেরেছেন। ‘বাংলার আকাশে সাতটি ধ্রæবতারা’তে সাতজন বীরশ্রেষ্ঠর মুক্তিযুদ্ধে অবদানের কথা তুলে ধরা হয়েছে। পদ্মা, মেঘনা এবং যমুনার কুল কুল প্রবহমান জলরাশিতে এই বীরশ্রেষ্ঠদের মর্যাদা ও অবদান যে চিরকাল ধ্বনিত হবে মাহবুব তার চিত্রকল্পটি এই গানটিতে এঁকেছেন। ‘পাষাণের ভারে পড়েছে ঢাকা’ তে মেঠোপথ, রাখালী বাঁশির সুর, সূর্যের রক্তিম আভা, আপন ডোর বাঁধার স্বপ্ন আশাবাদের মাধ্যমে রস উত্তীর্ণ হয়েছে। ‘বাংলাদেশের হৃদয় জুড়ে সমুদ্র উত্তাল’ গানটিতে সময় ও সাগরের ঢেউ এবং বিশালতা ও বিস্তৃতির সঙ্গে ১৬ কোটি মানুষের পরম সম্ভাবনার উজ্জ্বল চিত্র ফুটে উঠেছে। ৭১ এর তুলনায় আমাদের এই অধিবাস ও অধিবাসীরা প্রতিটি ক্ষেত্রে যেভাবে সমৃদ্ধি, অগ্রগতি এবং সুনাম অর্জন করে চলেছে এই গানে তারই প্রকাশ ঘটেছে। ‘বিধাতার নিজ হাতে গড়ার’ গানটিতে হিমালয়, সুন্দরবন, অনঘ পাহাড়, দিগন্ত ইত্যাদির নিসর্গচিত্র শিল্পরূপ লাভ করেছে। তেমনি ‘একটি বাংলা অক্ষর মানে’তে আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন, প্রাণ দানের মাধ্যমে একটি বর্ণমালার মর্যাদার প্রতিষ্ঠা লাভ ইত্যাদি জাতীয় জাতির সম্বিত স্থান লাভ করেছে। এই গানটির বাদ্য যন্ত্র ব্যবহারে একটি শচীন সুলভ আবহ রয়েছে। ‘আমি শুনি শুধু বিজয়ের গান’ এ আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও শ্বেতশুভ্র এক ঝাঁক পায়রা, চর্যাপদ ইত্যাদি বিষয়গুলো স্থান পেয়েছে। এখানে আরো আছে খেলাধুলা, সমুদ্র এবং হিমালয় বিজয়ে বাংলাদেশের অপূর্ব সাফল্য। ‘ক্রিকেট ক্রিকেট’ একটি চমৎকার সমসাময়িক উপজীব্য ভিত্তিক গান। ক্রিকেটের যে তড়িৎ গতি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই গানটি ছন্দ, গতি, ব্যঞ্জনা এবং মার্চ পাস্ট-এর দ্যোতনাতে ভরপুর। দৃশ্য বর্ণনায় রয়েছে চুম্বক আকর্ষণ, তেজ, উদ্দীপন, উচ্ছ¡াস এবং আলো। যেমন ‘মারছক্কা বল উঠেছে আকাশে’ ও ‘উল্লাসে কাঁপছে দেশ’।

এই গানগুলোতে গীতি কবি মাহবুব আহমেদ-এর গভীর দেশপ্রেম, প্রখর ইতিহাসবোধ, নিসর্গমনষ্কতা এবং জাতীয় চেতনাকে অব্যর্থভাবে পর্যবেক্ষণ-এর লক্ষভেদী ক্ষমতা এবং ব্যক্তিগত নান্দনিক শিল্পবোধ উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে। এগুলোতে সুরারোপ করে কণ্ঠ শিল্পীর নির্বাচন এবং সংগীত পরিচালনার মাধ্যমে গানে পরিণত করবার দায়িত্বটি ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি করেছেন। দেশের প্রখ্যাত এবং তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত কণ্ঠ শিল্পীরা এই গানগুলোকে কণ্ঠে ধারণ করেছেন। সুবীর নন্দী (বাংলাদেশের হৃদয় জুড়ে সমুদ্র উত্তাল) এবং সাবিনা ইয়াসমিন ও ফেরদৌস আরা’র পরে উদীয়মান সাদেকা বোরহানের গীত গানটি তুলনামূলক ভাবে সুশ্রাব্য হয়েছে। এই গীতিকবি যুদ্ধ বিধ্বস্ত ও রক্ত বিধৌত দেশমাতৃকার আত্মার কান্না নিয়ে সৃষ্টি করেছেন একেকটি শিল্পকলা। উপমা, রূপক ও প্রতীকের যুতসই ব্যবহারে তাঁর রচনা হয়েছে প্রাঞ্জল। মুক্তির পথ হিসেবে ভোগান্তি, আত্মত্যাগ ও মৃত্যুর চিত্র এই গানগুলোতে পাওয়া যাবে। ৭১ এর সেই দিনগুলোর অনুভুতি, স্মৃতি ও ছবিকে ভাষায় রূপান্তরের কাজটি বিশিষ্টভাবে হয়েছে। কবির মেধা ও অনুভুতির আলোক প্রভায় এবং প্রাণবন্ত কাব্য ভাষায় সেই সময়ের প্রতিচিত্রটি পাঠকরা শুনতে পাবে। তাঁদেরকে এই গীত রচনার কৌশলের সহজিয়া এবং সজীবভাব ৭১ এর ইতিহাসকাতর করে তুলবে। এই গীতিকবির রচনা কৌশল শান্ত এবং অন্তর্মুখী, ফলে গানগুলোতে কোনো হৈচৈ বা শব্দ নিনাদ স্থান পায়নি। গানগুলোর এক মুখিনতা নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধের আরম্ভেরও আরম্ভ, ভাষা সংগ্রাম, প্রকৃত যুদ্ধ, যন্ত্রণা, বিজয় অর্জন এবং তার পরবর্তী ৪৪ বছরের বিষয় ভিত্তিক অর্জন ও সম্ভাবনার চিত্র গানগুলোতে স্থান লাভ করেছে। এই সিডির শ্রোতাদের বহুল শ্রবণ কাম্য।