Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

বাবা আমরা দেশে কবে যাবো! মাসুদ সরকার

ভিনদেশে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে ছোট্ট মেয়ে। বড়ই আদুরে। ওর মুখের মিষ্টি কথা শুনলে যে কারও মন ভালো হয়ে যাবে। মেয়েটির কঠিন অসুখ হয়েছে। বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় সীমানত্ম এলাকায় তাদের বসবাস। বাবা স্কুল শিক্ষক। এলাকায় বেশ জনপ্রিয়। আর মা গৃহিনী। সুন্দর একটি সুখি সংসারে হঠাৎই অন্ধকারের কালো ছায়া ঘিরে ধরে। পরিবারের একমাত্র মেয়ের কঠিন অসুখ করেছে। দ্রুত হাসপাতালে নেয়া জরুরি। না হলে মেয়েটিকে হয়তো বাঁচানো যাবে না। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে দেশের ভেতর ভালো হাসপাতালে রোগীকে নিতে হলে অনেকটা পথ যেতে হবে। সময় লাগবে বেশী। তার চেয়ে নদীর ওপারেই তো ভারতের সীমানত্ম। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে পাওয়া যাবে ভালো হাসপাতাল। ভালো চিকিৎসা। পরিস্থিতি বিবেচনায় সিদ্ধানত্ম নেওয়া হয় নদী পেরিয়ে পাশের দেশেই নেওয়া হবে রোগীকে। নদী পথে ওপারে নেয়া হয় রোগীকে। কিন্তু ওপারে গিয়েই কঠিন বাসত্মবতার মুখোমুখি হয় বাংলাদেশের অসহায় এই পরিবার। যেহেতু তারা অবৈধ পন্থায় ভারতে ঢুকেছে কাজেই পরিচয় বদলাতে হবে। মুসলমান পরিচয় বদলে হিন্দুর পরিচয় দিতে হবে। বাধ্যহয়ে অসুস্থ মেয়েটির মা কপালে সিঁদুর পরেন। বাবা আচার ব্যবহারে প্রকাশ করেন তিনি হিন্দু। একদিন অসুস্থ মেয়ের কাছে অসহায় বাবা সব ঘটনা খুলে বলেন। মেয়েটির চোখে মুখে বিস্ময়- বাবা আমি মিথ্যা বলব?

মেয়েটির চিকিৎসার জন্য দুইলাখ টাকার প্রয়োজন। বাংলাদেশ থেকে আসার সময় মা সংসারের জমানো গয়নার পুটলি সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। সেই গয়না বিক্রি করতে গিয়ে কঠিন এক বাসত্মবতার মুখোমুখি হয় পরিবারটি।

অবশেষে হাসপাতালে অসুস্থ মেয়েটির অপারেশনের দিনক্ষণ ঠিক হয়। কিন্তু মেয়েটি আগের রাতেই মারা যায়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মেয়েটির ডেথ সার্টিফিকেট দেয়ার সময় মেয়েটির বাবাকে জানিয়ে দেন- এইখানে সই করুন। এর একটা ফটোকপি শ্বশানে দেখাতে হবে। তা নাহলে ওরা লাশ পোড়াবে না।

মেয়েটির বাবা এবার প্রতিবাদ করে। না, এই লাশ পোড়ানো হবে না। কবর দেয়া হবে। কারন এই লাশ মুসলমানের। বাবার কথা শুনে বিস্মিত হয় সবাই। হাসপাতাল ও প্রশাসনের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে মা ও বাবাকে গ্রেফতার করে কলকাতা পুলিশ। তখন বাবা পুলিশের কাছে একটি আকুতি জানায়- আমার মেয়েটি তার দেশে যেতে চেয়েছিল। লাশটা কি বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যাবে?

কী করুণ বাসত্মবতা। চিকিৎসার জন্য অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে বাবা মাকে পুলিশ জ্বীপে করে গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ছোট্ট মেয়েটির লাশ বাংলাদেশের মাটিতে দাফন করার জন্য মিছিল যাচ্ছে গোরস্থানের দিকে।

গৌতম ঘোষ আনত্মর্জাতিক খ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক। বাংলাদেশের মানুষের অতি আপনজন। ‘পদ্মানদীর মাঝি’ নির্মাণের মাধ্যমে তিনি এদেশের চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষের প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তারপর দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে নির্মাণ করেন ইমপ্রেসের আলোচিত সিনেমা ‘মনের মানুষ’। এবার তিনি নির্মাণ করেছেন দেশ ভাগ নিয়ে মানবিক গল্পের ছবি ‘শঙ্খচিল’।

এই দেশে যারা বাংলা সিনেমার ব্যাপারে প্রায়শই নেতিবাচক কথা বলেন, আমাদের কিছুই নাই, আমাদের কিছুই হবে না এমন অস্থিরতা প্রকাশ করেন তাদরে উচিৎ শঙ্খচিল দেখা। অনেকে প্রায়শই বলেন, দেশে সিনেমার দর্শক কমে গেছে। এর কারণ ভালো গল্পের অভাব। তাদেরও উচিৎ একবারের জন্য হলেও শঙ্খচিল দেখা।

শঙ্খচিল এর গল্প এক কথায় অসাধারণ। ক্যামেরার ভাষা যেনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা বাসত্মব ছবি একের পর এক সাজানো। চোখ ফেরানো যায় না। আর শিল্পীদের অভিনয়? এক কথায় অনবদ্য। প্রসেনজিৎ, কুসুম সিকদার আর সাঝবাতি মিলে যে পরিবারটির ছবি এঁকেছেন গৌতম ঘোষ তা যেন বাসত্মবেরই প্রতিচ্ছবি। ছবিতে প্রসেনজিৎ ন্যায়নিষ্ঠ, নীতিবান শিক্ষকের চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন। তাঁর স্ত্রীর ভূমিকায় কুসুম সিকদারের অভিনয়ও দর্শকের মনে দাগ কেটেছে। তবে শঙ্খচিল এর অন্যতম আকর্ষণ সাঝবাতি নামের এক কিশোরী অভিনেত্রী। পরিবারের বড়ই আদুরে মেয়ে। বাবাকে যখন বাবা… আ… আ… বলে ডাক দেয় তখন হৃদয়ের গভীরে আনন্দ অনুভূত হয়। দেশের প্রতি অনেক টান এই কিশোরীর। হাসপাতালের বিছানায় অসুস্থ অবস্থায় সে একদিন বাবাকে জিজ্ঞেস করে- আমরা কবে দেশে যাব? তখন অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না চোখের কান্না থামাতে!

এমন একটি মানবিক বোধ সম্পন্ন ছবি উপহার দেয়ার জন্য গৌতম ঘোষকে অনেক ধন্যবাদ জানাই। সেইসাথে ধন্যবাদ বাংলাদেশের প্রযোজক হাবিবুর রহমান খান ও ইমপ্রেস টেলিফিল্ম এর প্রতি।