Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

ফিরে এলো খাদি

সৈয়দ ইকবাল

এ যেন ঐতিহ্যের এক নান্দনিক পসরা! আধুনিকতার ছোঁয়ায় শেকড়কে মনে করিয়ে দেয়া এই আয়োজন সত্যিই অনন্য। র‌্যাম্প শো-এর মাধ্যমে বাঙালির খাদি বস্ত্রকে আবার জনপ্রিয় করার এই আপ্রাণ চেষ্টা ফ্যাশন সচেতন নর-নারীর কাছে এক অন্য রকমের আবেদন তৈরি করেছে। খাদি মানেই ধবধবে সাদা বা ঘিয়ে রঙের একখÐ বস্ত্র- এই ধারণা নিয়ে বসে থাকার দিন বোধকরি শেষ হয়ে গেছে। অন্তত দেশি ডিজাইনাররা সেই আভাসই দিলেন। টুকটুকে লাল, কমলা, সোনালি, সবুজ, কালো- কোন রং নেই খাদি কাপড়ের পোশাকে! ভবিষ্যতে খাদি যে নতুন সম্ভাবনা জাগাবে তার আভাস পাওয়া গেল এবারের ‘ট্রেসেমে খাদি, দ্য ফিউচার ফেব্রিক শো ২০১৭’ শিরোনামে খাদি উৎসবের রানওয়েতে। দুই দিনের এই শোতে নানা রঙের নতুন ডিজাইনের খাদি বস্ত্র দেখালেন ডিজাইনাররা।

সম্পর্কিত

ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশ (এফডিসিবি) আয়োজিত খাদি উৎসব এবার তৃতীয় বছরে পা দিয়েছে। দেশ-বিদেশের মোট ২৭ জন ডিজাইনারের মধ্যে প্রথম দিন রানওয়েতে দেখা গেছে ১৩ জন ডিজাইনারের পোশাক। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে শৈবাল সাহা, ফারাহ আনজুম বারি, শাহরুখ আমিন, এমদাদ হক, নওশিন আফসানা ফেরদৌসী, ফাইজা আহমেদ, সারাহ্ করিম ও ফারাহ দিবার নকশা করা খাদির পোশাকে দেখা যায় নতুন ধারা। তাঁরা খাদির পোশাকে নকশা করেন শীতলপাটি, গয়নার কারুকাজ, ক্যালিগ্রাফি ও রিকশাচিত্রে অনুপ্রাণিত হয়ে। এ ছাড়া ভারতের সৌমিত্র মÐল, নেপালের রসনা শ্রেষ্ঠা, ভুটানের চিমমি চোডেন ও জুনের নকশা করা পোশাকেও মঞ্চে হাঁটেন মডেলরা। ফ্যাশন শোর মডেলদের সাজিয়েছেন ফারজানা শাকিল এবং কোরিওগ্রাফার ছিলেন ইমু হাশমী।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই এফডিসিবির সভাপতি ডিজাইনার মাহিন খান অনুষ্ঠানে আগত সুধীজনকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রেম ও সংস্কৃতির সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িয়ে আছে খাদি বস্ত্র। পুরনো সেই খাদির সুদিন আবার ফিরিয়ে আনতেই নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের পছন্দমতো নকশায় রাঙানো হয়েছে পোশাকগুলো।’ এবারের খাদি উৎসবের টাইটেল স্পনসর ইউনিলিভারের ব্র্যান্ড ট্রেসেমে। সহযোগিতা করেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, বেঙ্গল গ্রæপ লিমিটেড, মাইক্রোসফট বাংলাদেশ, সেনোরা, বার্জার, আইপিএবি, দ্রæক এয়ার ও দ্যা ওয়ে ঢাকা।

দ্বিতীয় দিনের আয়োজন

খাদি উৎসবের দ্বিতীয় দিনেও ছিল জমকালো সব আয়োজন। দেশের এবং দেশের বাইরের সব ডিজাইনারদের ডিজাইন করা পোশাক নিয়ে চলে র‌্যাম্প শো। ৪ নভেম্বর দ্বিতীয় দিনের প্রদর্শনীতে লিপি খন্দকার ও চন্দনা দেওয়ান মোটিফ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন রিকশার হুড ও রিকশাচিত্রের নকশা। রিফাত রেজার তৈরি পোশাকে আসে ক্যালিগ্রাফি। কুহু প্লামন্দোন পোশাকের মোটিফ হিসেবে বেছে নেন পুরোনো আমালের সোনার গয়নার নকশা। শাঁখা-কড়ির নকশা করেন মারিয়া সুলতানা। বিপ্লব সাহা খাদিতে তুলে ধরেন পানাম নগরের গ্রিলের নকশা, ইজমাত নাজ রিমার নকশা ছিল কাঠের কারু কাজে। পোশাকে পটচিত্র বেছে নেন তেনজিং চাকমা, রুপো শামস হাতপাখার নকশা তুলে আনেন। মাহিন খানের নকশায় দেখা যায় শীতলপাটির মোটিফ। ভারতের হিমাংশু শনি ও সৌমিত্র মন্ডল, নেপালের রসনা শ্রেষ্ঠা, মালয়েশিয়ার জ্যাকলিন ফং, শ্রীলঙ্কার নিলান হারাসগামা, থাইল্যান্ডের মায়ে টিটা ও ভুটানের চিমমি চডেন তাঁদের নিজেদের ঐতিহ্যবাহী নকশার পোশাক তুলে ধরেন।

দুই দিনই অনুষ্ঠান শুরু হয় নায়লা আজাদের দলের নৃত্যনাট্য খদ্দর আন্দোলন দিয়ে। ফ্যাশন শোর ফাঁকে ফাঁকে তা কয়েকটি পর্বে উপভোগ করেন দর্শক। দ্বিতীয় দিনের আয়োজনের শুরুতে তাঁতশিল্পী আসলাম মিয়াকে জানানো হয় বিশেষ সম্মাননা।

খাদি উৎসবের ফ্যাশন শো অংশটি ছিল আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য। তবে ফ্যাশন শোতে অংশ নেয়া দেশ-বিদেশের সব ডিজাইনারের পোশাক নিয়ে আয়োজন করা হয় প্রদর্শনীর। গত ১০ ও ১১ নভেম্বর এই প্রদর্শনী সবার জন্যই উন্মুক্ত করা হয়। প্রদর্শনী থেকে পোশাক কিনেছেন ফ্যাশন সচেতন নর-নারীরা।

২০১৫ সাল থেকে খাদি কাপড়ের জনপ্রিয়তা বাড়াতে ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশ (এফডিসিবি) আয়োজন করে আসছে খাদি উৎসবের। এ আয়োজনে বাংলাদেশের তো বটেই, বিদেশি ডিজাইনাররা খাদি কাপড়ের পোশাক নিয়ে হাজির হন। শোয়ের পর নির্দিষ্ট দিনে প্রদর্শনীর মাধ্যমে বস্ত্র বিক্রিও করা হয়।

সব সময়ে খাদি

একটা সময় শুধু শীতকালে খাদি পরার চল থাকলেও এখন সারা বছর এই কাপড় পরা যায়। বিয়ে বাড়ি বা দাওয়াতে পরে যাওয়ার মতো খাদির শাড়ি, পাঞ্জাবি, শেরওয়ানি, কামিজ, টপ, কেইপ, স্কার্ট- সবই তৈরি হচ্ছে। আজিজ সুপার মার্কেট থেকে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস- সবখানেই খাদির পোশাক চোখে পড়ে কমবেশি। এই সময়ে তরুণ প্রজন্মের পছন্দের বিষয়টি মাথায় রেখে সেভাবেই নকশা করা হচ্ছে খাদি পোশাক। চান্দিনা উপজেলা সদর, মাধাইয়া, কলাগাঁও, বেলাশ্বর, সাইতলা, বাখরাবাদ, পিইর ও গোবিন্দপুর এবং দেবীদ্বারের বরকামতা ও ভানী প্রভৃতি গ্রামের অনেক পরিবার বংশপরম্পরায় খাদি কাপড় তৈরি করে আসছে। এসব খাদি কাপড় প্রায় সব ঋতুতেই ব্যবহার করা যায়।

ইতিহাস থেকে

খাদি শব্দটি এসেছে খদ্দর থেকে। শব্দটি গুজরাটি। খদ্দর শব্দটিকে জনপ্রিয় করেছেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেস নেতা মহাত্মা গান্ধী। ১৯২০-এর দশকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম কার্যকর রাজনৈতিক হাতিয়ার ছিল বস্ত্র বর্জন। ব্রিটিশদের পণ্য ব্যবহার করবে না ভারতবাসী। অন্য সবকিছুর মতো কাপড় বর্জন করে তারা পরবে নিজেদের তৈরি কাপড়। ফলে সে আন্দোলনের রেশ ধরেই খাদি বস্ত্রের ‘পুনর্জাগরণ’ ঘটে। এটা ছিল চমৎকার একটি উৎপাদন ও বিপণন পদ্ধতি। গ্রামীণ অর্থনীতি তথা কুটির শিল্পের প্রসারে এ পদক্ষেপ ছিল তারিফযোগ্য। এই কাপড় সম্পূূর্ণ হাতে কাটা সুতা টানা ও পড়নে ব্যবহার করে হাতে চালিত তাঁতে বোনা কাপড়ই বিশুদ্ধ খাদি। কিন্তু সেইখাদি বস্ত্র এখন দুর্লভ। আমাদের দেশের সমতল ভূমিতে এ খাদি বস্ত্র নেই বললেই চলে। তবে বিশুদ্ধ খাদি এখনও একটু-আধটু মেলে পাহাড়ে আদিবাসীদের মধ্যে। ভারতে অবশ্য তৈরি হয়। সেখানে খাদি নিয়ে প্রচুর কাজও হচ্ছে। হচ্ছে এর চর্চা ও আধুনিকায়ন। স্মরণ করা যেতে পারে ১৯৯৮ সালে ভারতের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে খাদি নিয়ে দারুণ কাজ হয়েছে সফলভাবে। সেই সময়ে তারা সুপার মডেল নাওমি ক্যামবেলকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করে খাদির প্রমোশনে। এক সময় ‘মায়ের দেয়া মোটা কাপড়’কে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা গর্ব ও সম্মানের বস্তু হিসেবে গায়ে জড়িয়েছেন, সময়ের পালা বদলে সেই খাদি বস্ত্রই হয়েছে ফ্যাশন স্টেটমেন্ট।