Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

প্রতারক সুন্দরী!

রেজানুর রহমান: ব্যাপারটা এখন আর শুধুমাত্র সুন্দরী প্রতিযোগিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখানে নীতি, নৈতিকতা, আদব-কায়দা, শিষ্টাচার, পারিবারিক মূল্যবোধের বিষয়গুলোও বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অনেকে নারীর সৌন্দর্য নিয়ে প্রতিযোগিতা করার ব্যাপারে আপত্তি তুলেছেন। আমরা এ ব্যাপারে ভিন্ন পোষণ করছি। প্রগতির পতাকা হাতে নিয়ে শুধু পুরুষেরা নয় নারীর ও সমানভাবে এগিয়ে যাক- এই ভাবনা ও বিশ্বাসকে আমরা সব সময় সমান গুরুত্ব দেই। সেই বিবেচনায় সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা নিয়ে আমাদের কোনোই দ্বিমত নেই। দ্বিমত শুধু এক জায়গায় তাহলোÑ নারীর সৌন্দর্য যেন কখনও বিক্রয়যোগ্য পণ্য হয়ে না দাঁড়ায়। যে নারী সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ হবে সে যেন যথার্থ অর্থে অন্য নারীর জন্য আইডলে পরিণত হয়। অগ্রসরমান মেয়েরা, আমাদের মেধাবী মেয়েরা যেন উৎসাহ ও আগ্রহ নিয়ে প্রকাশ্যে বলতে পারেÑ আমিও হতে চাই তার মতো… তাদের মতো…
সাম্প্রতিক সময়ে এভ্রিল নামে একটি মেধাবী মেয়ে আমাদের শোবিজে অত্যন্ত পরিচিতি পেয়েছে। এইতো পনের দিন আগেও তাকে তার কতিপয় বন্ধু ও কাছের মানুষ ছাড়া আর কেউ চিনতো না। হঠাৎ কী এক সুন্দরী প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এভ্রিল শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট অর্জন করলেন। হঠাৎ দেখা দিল বিপত্তি। ঘটনা কী? ঘটনা হলো এভ্রিল বিয়ে করেছিলেন। বিবাহিত মেয়ে কি করে মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ হয়? এভ্রিলের মুকুট কেড়ে নেয়া হলো। বিষয়টি নিয়ে দেশের প্রচার মাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখনও চলছে ব্যাপক আলোচনাÑসমালোচনা। বিজয়ীর মুকুট কেড়ে নেয়ার পরও এভ্রিলকে নিয়েই আলোচনা চলছে সবখানে। পত্রিকা খুললেই এভ্রিল। টিভি চ্যানেল সমূহের বিনোদন মূলক অনুষ্ঠান মানেই এভ্রিল। অর্থাৎ ‘এভ্রিল’ জ্বরে আক্রান্ত আমাদের শোবিজ।
প্রিয় পাঠক, আজকে এভ্রিলকে নিয়ে এই যে এত আলোচনা, সমালোচনা এ ব্যাপারে আপনাদের প্রতিক্রিয়া কি? অভিভাবকদের উদ্দেশে একটা প্রশ্নÑ ধরা যাক আপনার মেধাবী মেয়েটি এভ্রিলের মতোই হতে চায়। আপনি হয়তো তার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন। সিদ্ধান্তটি তার মোটেও পছন্দ হলো না। সরাসরিই বলি, আপনি তার পছন্দের বাইরে বিয়ে দিতে চাইলেন। সে প্রতিবাদ করে বাসা থেকে পালিয়ে ঢাকা শহরে চলে এলো। তার অনেক শুভাকাক্সক্ষী জুটলো। সে বাইক চালাতে পারে। বাইকে ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে যখন যেখানে খুশি চলে যায়। ফটোগ্রাফার বন্ধুকে ডেকে এনে পারিবারিকভাবে দেখার অযোগ্য খোলামেলা ছবি তুলে সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দিল। তার খ্যাতি এখন জগৎ জোড়া। আপনি কে তাকে সাপোর্ট করবেন? যদি উত্তর না হয় তাহলো পাল্টা প্রশ্নÑ কেন তাকে সাপোর্ট করবেন না? ছেলে হলে তো সাপোর্ট করতেন। মেয়ে বলেই কী তার এত দোষ? ছেলে আর মেয়েতে এত বিভাজন কেন? এভাবে তো ভাই প্রগতির পথে হাঁটা যাবে না।
Avril-2এই যে প্রগতির পথে হাঁটার কথা বলছি। এটাই সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। প্রগতির পথে হাঁটা মানে কি? আধুনিক যা কিছু তাকে গুরুত্ব দেয়া। সে কারণেই কি ছেলেরা ইদানিং যত পারে শরীর ঢাকছে আর মেয়েদের অনেকে যত পারে শরীর খোলার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে? শরীর খোলার মধ্যেও কি প্রগতির আলো আছে?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজন নারীর মন্তব্য পড়লাম। তিনি লিখেছেন নারীকে আপনি কোন চোখে দেখবেন সেটা নির্ভর করবে আপনার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। আমরা তার কথা মানছি। নারীকে দেখার ক্ষেত্রে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিটাই আসল। কিন্তু এক্ষেত্রে কি নারীর কোনো ভ‚মিকাই নাই? প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে বুক খোলা আপত্তিকর পোশাক পরে কোনো নারী হেঁটে যাবে, অশোভন ভঙ্গিতে সোফায় বসবে, পুরুষ তার দিকে একবারও তাকাবে না তাকি করে হয়? এভ্রিল মেধাবী মেয়ে এতে কোনো সন্দেহ নাই। বিয়ের তথ্য গোপন করে সে মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। এই বিষয়টিকেও আমরা খুব বড় করে দেখতে চাই না। কিন্তু এভ্রিল যে প্রক্রিয়ায় নিজেকে গড়ে তুলছে তা কি আমাদের সমাজ বাস্তবতা পারমিট করে? অনেকে হয়তো আবারও এভ্রিলের পক্ষেই দাঁড়াবেন। পুরুষ পারলে মেয়েরা কেন পারবে না। এই যুক্তিই তুলবেন। এভ্রিল বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন তিনি বেশ রাগী। হুট করে রেগে যান। তার মধ্যে একটা ডেমকেয়ার ভাব আছে। কে কি বলল তা নিয়ে কখনও ভাবেন না। তিনি তার পথে চলতেই অভ্যস্ত। এভ্রিলের সব কথার সঙ্গেই আমরা সহমত পোষণ করছি। কিন্তু সামাজিক বন্ধন বলে তো একটা কথা আছে। সবাই যদি এভ্রিল হতে চায় তাহলে কি সামাজিক বন্ধন থাকবে?

এবার আসি মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা প্রসঙ্গে। আয়োজক প্রতিষ্ঠান অন্তর শোবিজের দাব গোটা বাংলাদেশের ২৫ হাজার প্রতিযোগিনীর মাঝ থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বাছাই পর্ব শেষে সেরা ১০ প্রতিযোগিনীকে চ‚ড়ান্ত পর্বে যুক্ত করা হয়েছিল। চ‚ড়ান্ত পর্বে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন জাদু শিল্পী, জুয়েল আইচ, আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মডেল ও ডিজাইনার বিবি রাসেল, কর্পোরেট ব্যক্তিত্ব রুবাবা দৌলা, বিশিষ্ট আলোকচিত্রী চঞ্চল মাহমুদ ও বিশিষ্ট অভিনেত্রী শম্পা রেজা। দেশের অন্যতম পাঁচ গুণী ব্যক্তিত্ব মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ প্রতিযোগিতার চ‚ড়ান্ত পর্বের বিচারকার্যে অংশ নেয়ার পরও কেন আয়োজনটি প্রশ্ন বিদ্ধ হলো এই প্রশ্ন শোবিজের আকাশে এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে। অবশ্য শম্পা রেজা এ ব্যাপারে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে বিচারকদের অবস্থান কি ছিল তা পরিষ্কার করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রতিযোগিতার চ‚ড়ান্ত পর্বের ঘোষণার সময় বিচারকদের রায়কে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। অবশ্য তার এই কথার যথার্থ প্রমাণ পাওয়া গেছে প্রতিযোগিতার চ‚ড়ান্ত পর্বে বিজয়ীনির নাম ঘোষণার সময়। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক শিনা চৌহান মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ হিসেবে জান্নাতুল সুমাইয়া হিমির নাম ঘোষণা করেন। এসময় হিমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে মাথায় ক্রাউন নেয়ার জন্য এগিয়ে আসেন। কিন্তু পরক্ষণেই শিনা চৌহানকে পাস কাটিয়ে অন্তর শোবিজের কর্ণধার স্বপন চৌধুরী নিজেই নাম ঘোষণার দায়িত্ব নেন। হিমির পাশে দাঁড়িয়েই তিনি বলেন, আমাদের একটু ভুল হয়েছে…। আমি ভুলটি সংশোধন করে চ‚ড়ান্ত বিজয়িনীর নাম বলছি। মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ হয়েছেন জান্নাতুল নাঈম এভ্রিল। একটু আগে হিমির মুখে হাসি ছিল। নতুন ঘোষণায় সে রীতিমত ‘ভ্যাবাচ্যাকা’ খাওয়ার মতো হয়ে যায়। হিমির চোখে পানি। অন্যদিকে এভ্রিলের চোখে আনন্দ্রাশ্রæ। কিন্তু এভ্রিলের বিবাহের খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ায় একদিন বাদেই তার মুকুট ছিনিয়ে নেয়া হয়। জেসিয়া ইসলামের মাথায় নতুন করে তুলে দেয়া হয় মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের মুকুট। তাকে নিয়েও সমালোচনার ঝড় উঠেছে। তার ভাঙ্গা দাঁতের ছবিই সমালোচনার অন্যতম বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্মুখেরা তাকে ‘পেতনী’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন।
Avril-3প্রিয় পাঠক, আনন্দ আলো পরিবার ও বন্ধুর পত্রিকা। সুন্দরী হিসেবে নয় এভ্রিলকে আমরা পরিবারের সন্তান হিসেবে বিশ্লেষণ করতে চাই। অনেকে তাকে প্রতারক সুন্দরী বলছেন। এভ্রিল কী সত্যি সত্যি প্রতারক? যারা তাকে নিয়ে সুন্দরী প্রতিযোগিতার নামে প্রকাশ্য অনিয়ম করলেন এক্ষেত্রে তাদের কি কোনো দায় দায়িত্ব নাই? তারা কি প্রতারক নন? বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে এভ্রিল তার ১৬ বছরের বিয়ে মেনে নিতে পারেননি। যদিও এভ্রিলের বয়স নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সেই প্রসঙ্গে আমরা যেতে চাই না। একটি মেয়ের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি আমরা শ্রদ্ধা জানাতে চাই। ১৬ বছর বয়সে যদি এভ্রিলের বিয়ে হয়েই থাকে তাহলে দেশের প্রচলিত আইনে সেটা বিয়ে বলে গণ্য হবে না। কাজেই এভ্রিলের প্রতিবাদী ভ‚মিকার সঙ্গে সকলেই একমত পোষণ করতে পারেন। কিন্তু প্রতিবাদেরও ভাষা আছে… বিষয়টি বোধকরি আমরা আমলেই নিচ্ছি না।
প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো টেলিভিশন চ্যানেল, অনলাইন মিডিয়ায় এভ্রিল সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। সমাজের নানা অসঙ্গতির কথা তুলে ধরছেন। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করবেন বলে দৃঢ় সংকল্প দেখাচ্ছেন। তাকে নায়িকা বানিয়ে অচিরেই চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘোষণা আসবে বলে এমন কথাও শোনা যাচ্ছে। সবই আনন্দের খবর। কিন্তু একটা শংকা থেকেই যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেছে এভ্রিলের শরীরের কিছু খোলামেলা দৃশ্যের আলোকচিত্র। কথায় আছে নারীর শরীর যদি সহজেই বিক্রয়যোগ্য পণ্য হয় তাহলে সেই নারী যতই মেধাবী হোক তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কথাটা যেন আমরা মাথায় রাখি।