Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

না ফেরার দেশে লাকী আখন্দ

মোহাম্মদ তারেক

সংগীতের মাঝেই জীবনটাকে বেঁধেছিলেন তিনি। সুরের মায়াজালে জায়গা করে নিয়েছিলেন শ্রোতার অন্তরে। ২১ এপ্রিল শুক্রবার সেই সুরের বাঁধন ছিঁড়ে পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে। ফেরানো গেল না তাকে। সবাইকে কাঁদিয়ে ২২ এপ্রিল বিদায় নিলেন প্রিয় এই পৃথিবী ছেড়ে। রেখে গেলেন আপন সৃষ্টি আর সঙ্গে নিয়ে গেলেন ভক্ত অনুরাগী, শুভাকাক্সক্ষী ও সহযোদ্ধাদের উজাড় করা ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন কিংবদন্তি শিল্পী, সুরকার, গীতিকার, সংগীত পরিচালক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা লাকী আখন্দ।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাষ্ট্রীয়ভাবে গার্ড অব অনার প্রদান শেষে দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে দ্বিতীয় নামাজে জানাজার পর মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দ্বিতীয় দফা জানাজা শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয় তাকে।

শহীদ মিনারে লাকী আখন্দের মেয়ে মামিন্তি বলেন, আমার বাবা দেশের জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। যুদ্ধ করেছেন। গানের মাধ্যমে সবাইকে আনন্দ দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি দেশ ও সংগীতকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। অসুস্থ অবস্থায়ও সুর করেছেন, দেশের কথা ভেবেছেন। তার জন্য সবাই দোয়া করবেন। এটুকুই প্রত্যাশা করি।

দীর্ঘদিন ধরেই ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন লাকী আখন্দ। থাইল্যান্ডের ব্যাংককে ছয় মাসের চিকিৎসা শেষে ২০১৬ সালে দেশে ফেরেন তিনি। এরপর আবারও ব্যাংককে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার কথা ছিল তার কিন্তু অর্থ সংকটে সেটি আর হয়নি। এরপর চলতি বছর ৫ ফেব্রুয়ারি আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। দীর্ঘ আড়াই মাস বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার পর বাসায় ফিরেছিলেন লাকী আখন্দ। বাসায় ফিরে যথারীতি সময় দিচ্ছিলেন গানে। কিন্তু ২১ এপ্রিল দুপুর নাগাদ তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। সন্ধ্যার আগে তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নেয়া হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬১ বছর।

লাকী আখন্দ আধুনিক বাংলা গানের বরপুত্র। সবার প্রিয় একজন মানুষ। তার দুর্দান্ত কণ্ঠশৈলী, অনুপম সুর সৃষ্টি আর জাদুকরী সংগীত পরিচালনার মুন্সিয়ানায় দেশের সংগীতকে অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। বাংলা গানের এক নতুন ধারা সূচনা করেছিলেন তিনি। শৈশবেই তার সংগীত শিল্পী হিসেবেই আত্মপ্রকাশ ঘটে। লাকী আখন্দের জন্ম ১৯৫৫ সালে পুরান ঢাকায়। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে এইচএমভি পাকিস্তানে সুরকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ১৬ বছর বয়সে সুরকার হিসেবে কাজ করেছেন এইচএমভি ভারত এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রেও। স্বাধীনতার পর পর নতুন নতুন উদ্যমে বাংলা গান নিয়ে কাজ শুরু করেন লাকী আখন্দ। যেমন নিজে গেয়েছেন, তেমন অন্যদের দিয়ে গাইয়েছেনও। তার সৃষ্টিতেই ভাই হ্যাপি আখন্দ গেয়েছেন বিখ্যাত গান ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’, ‘নীল নীল শাড়ি পরে, ফেরদৌস ওয়াহিদের কণ্ঠে জনপ্রিয় হয়েছে ‘মামুনিয়া’, আগে যদি জানতাম, কুমার বিশ্বজিৎ গেয়েছেন যেখানে সীমান্ত তোমার, আইয়ুব বাচ্চু গেয়েছেন কি করে বললে তুমি, বিতৃষ্ণা জীবনের আমার, জেমসের কণ্ঠে লিখতে পারি না কোনো গান আজ তুমি ছাড়া, ভালোবেসে চলে যেও না, সামিনা চৌধুরীর কণ্ঠে কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে, আমায় ডেকো না প্রভৃতি।

ষাট দশকের আধুনিক এবং ব্যান্ডের গানে লাকী আখন্দ ও হ্যাপি আখন্দ অনবদ্য দুটি নাম। অসংখ্য কালজয়ী গান দুজনকে উজ্জ্বল করে রেখেছে। হ্যাপি চলে গেছেন অনেক আগে। এরপর লাকী আখন্দই সুরের মায়াজালে আবদ্ধ রেখেছিলেন আমাদের। গানে গানে হ্যাপিকে বাঁচিয়ে রাখতেই তিনি গড়েছিলেন ব্যান্ড হ্যাপি টাচ। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি এ ব্যান্ড নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। পাশাপাশি চালিয়ে যাচ্ছিলেন নিজের মতো করে মিউজিক বিপণনের একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের পরিকল্পনা। তার স্বপ্ন ছিল শিল্পীদের আর যেন কাজের জন্য কারো দ্বারস্থ হতে না হয়। কিন্তু তিনি নিজেও জানতেন কাজটা অত সহজ নয়। তারপরও তিনি তার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু স্বপ্নটা আর পূরণ করে যেতে পারলেন না। তার আগেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরতরে চলে গেলেন অদেখার ভুবনে।