Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

থিয়েটার-এর তৃতীয় পুরুষ

আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষ করে নাটকের জগতে আব্দুল্লাহ আল মামুন একটি ইতিহাসের আয়না। এই আয়নায় চোখ ফেললেই আমরা নিজেদের অর্জনের অনেক স্মৃতিকাব্য খুঁজে পাই। দেশে একটা সময় এমনও হয়েছে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও আব্দুল্লাহ আল মামুনের লেখা নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। কালজয়ী এই নাট্যকারের আলোচিত নাটক ‘তৃতীয় পুরুষ’ মঞ্চে এনেছে থিয়েটার তোপখানা। সম্প্রতি শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে নাটকটির উদ্বোধনী শোয়ের আয়োজন করা হয়। এ উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট নাট্যজন আতাউর রহমান, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সেক্রেটারী জেনারেল আখতারুজ্জামান ও নাটকের নির্দেশক প্রবীর দত্ত বক্তৃতা করেন।

‘তৃতীয় পুরুষ’ আব্দুল্লাহ আল মামুনের লেখা একটি নিরীক্ষাধর্মী নাটক। নাটকে মাত্র দুটি চরিত্র। আশির দশকের মাঝামাঝি নাটকটি লিখেছিলেন আব্দুল্লাহ আল মামুন। নাটকে এক অধ্যাপকের বিধবা স্ত্রীর জবানীতে উঠে আসে ভয়াবহ হত্যাকান্ড ও মুক্তিযুদ্ধের নানা অভিজ্ঞতা। শহীদ অধ্যাপককে নিয়ে পরবর্তী সময়ে কথিত মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবসা, বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং ফায়দা লোটার অভিনব কৌশলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন অধ্যাপকের স্ত্রী।

অধ্যাপকের স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করছেন বিশিষ্ট অভিনেত্রী শিরিন বকুল। অন্য আরেকটি চরিত্র যার নাম ইমাম, অভিনয় করছেন জিয়াউল ইসলাম কাজল ও দীপক রায়। প্রযোজনা অধিকর্তা হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট অভিনেতা হাফিজুর রহমান সুরুজ।

উদ্বোধনী শোতে বিপুল সংখ্যক দর্শক নাটকটি উপভোগ করেন।

আমরা কী ভুলে যাচ্ছি আব্দুল্লাহ আল মামুনকে!

কিংবদন্তি নাট্য ব্যক্তিত্ব আব্দুল্লাহ আল মামুনকে কি আমরা ভুলতে বসেছি? যদি তাই না হয় তাহলে তার আদরের মেয়ে দীবা নার্গিস কেন এতো আক্ষেপ করবেন? থিয়েটার মঞ্চে এনেছে আব্দুল্লাহ আল মামুনের লেখা নাটক ‘তৃতীয় পুরুষ’।

নাটকটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপলক্ষে থিয়েটার প্রকাশিত এক প্রচারপত্রে দীবা লিখেছেন- তাঁর জনমটাই ছিল নাটকীয়। যে দিন তিনি জন্মেছিলেন ঠিক ঐ একই দিন এলাকার কুখ্যাত ডাকাতের মৃত্যু তাঁর জন্মাটা করেছিল নাটকীয়। চল্লিশের দশকের সামাজিক এবং ধর্মীয় ঘেরাটোপের মধ্যে থাকা সত্তে¡ও নবম শ্রেণিতেই তাঁর প্রথম পূর্ণাঙ্গ নাটক লেখা ও পরিচালনায় হাতেখড়ি। সেই বিশেষ দিনটিতে তিনি এটাও জানতে পারলেন তাঁর বাবাও স্কুল জীবনে “সিরাজ-উদ-দৌলা” নাটকে অভিনয় করেছিলেন। তাঁর বাবা আজীবন পেশায় ছিলেন শিক্ষাজীবী। সেদিন তিনি এটাও উপলব্ধি করেছিলেন নাটক তাঁর রক্তে মিশে আছে। নাট্য-অন্তপ্রাণ এই মানুষটি আমার বাবা আবদুল্লাহ আল মামুন। শৈশবে যাঁর দেখা পেতাম শুধু ছুটির দিনগুলোতে। তখন থেকেই বুঝেছি তিনি আর পাঁচ জনের মতো নন। অফিস-এর পরে দিনের বাকি সময়টা আমার বাবা হয় নাটক লিখেছেন বা নাটকের জন্যই কিছু করেছেন। সেটা হয় পরিচালনা নয় মহড়া বা গান রচনা সেটাও নাটকের জন্যই। তাঁর জীবন সঙ্গিনী বা সন্তানেরা বরাবরই তার ভালোবাসার তালিকায় ছিল দ্বিতীয় স্থানে। সত্তর, আশির দশকে নাটক শব্দটা আসলেই আব্দুল্লাহ আল-মামুন হয়ে যেতেন সেই আলোচনার মুখ্য ব্যক্তি। পরবর্তীতে টেলিভিশন তাঁর ব্যস্ততার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, সেটাও ছিল ঐ সময়ের প্রয়োজন। কি ভীষণ জনপ্রিয় একজন অভিনেতা, নাট্যকার এবং পরিচালক, প্রায় সবাই তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুবর্ণ সুযোগের অপেক্ষায় থাকতো। নাটক পাগল আমার বাবা অসংখ্য অভিনেতা তৈরি করেছেন। নতুন পরিচালকদের জন্য পথ নির্মাণ করেছেন। নব্য নাট্যকারদের দিয়েছেন দিক নির্দেশনা। ২০০৮-এর ২১ আগস্ট এই পৃথিবীতে দেহগত ভাবে তাঁর দিন শেষ। আমরা চার ভাইবোন তাঁর ঔরসজাত সন্তান, উনি আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে জড়িয়ে আছেন। আমার বাবা যাদের তৈরি করে গেছেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁরা সফল। তাঁদের অনেকেই ছিলেন আমার বাবার খুব কাছের, খুব ভালোবাসার। আমাদের চেয়ে বেশি বৈ কম না। এরাও কমবেশি নাটক নিয়েই কাজ করে চলেছেন। তাঁদের কাজের ভিতর বা তাদের কথায় আমার বাবার কথা খুঁজে পাইনি। এখনো পাই না। কোনো অভিযোগ নয় এটা দুঃখ বোধ। গত কয়েক বছর ধরে কুঁড়ি থেকে চব্বিশের কোঠায় যারা আছে, তাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি তারা আব্দুল্লাহ আল-মামুনের কাজের সঙ্গে পরিচিত নয়। তাঁর কাজের ব্যাপ্তি এ বয়সীদের জানানো কি সম্ভব? আমি তাঁর সন্তান, আমার বাবার কাজকে বাঁচিয়ে রাখা, বাংলাদেশের নাট্যচর্চার ইতিহাসে আমি তুলে ধরব বারবার, যখনই সুযোগ আসবে। কিন্তু তিনি যাদের তৈরি করেছেন, যাদের স্থান তাঁর কাছে ছিল তাঁর সন্তানদের মতো, তাঁরা কি কখনও তাদের নাট্যগুরুর কথা পরবর্তী প্রজন্মকে জানাবার দায়িত্ব নেবে! দিবে কি তাঁকে তার প্রাপ্য গুরুদক্ষিণা!