Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

তুমি কি কেবলই ছবি…

নাসির আলী মামুন
নাটক সিনেমার কথা উঠলেই প্রয়াত কথাসাহিত্যিক নির্মাণের মহান কারিগর হুমায়ূন আহমেদের কথাই মনে পড়ে বারবার। হুমায়ূন আহমেদের জীবদ্দশায় শুধু ঈদই বা বলি কেন আমাদের যে কোনো উৎসব পার্বণে টিভি অনুষ্ঠানের তালিকায় প্রায় প্রতিটি টিভি চ্যানেলে হুমায়ূন আহমেদের নাটক অথবা সিনেমা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতো। কে কার আগে হুমায়ূন আহমেদের নাটক নিতে পারবেন তার প্রতিযোগিতাও শুরু হয়ে যেতো। একথাতো সত্য, হুমায়ূন আহমেদ শুধু আমাদের বাংলা সাহিত্য নয়, আমাদের বাংলা টিভি নাটকের ক্ষেত্রেও একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছেন। জীবন ঘনিষ্ঠ হাসির নাটকের প্রবক্তা তো তিনিই। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা ঘটনা রসময় করে এমন ভাবে তুলে ধরতেন মনে হতো নিজের অথবা আশে-পাশের দেখা কোনো পরিবারের বাস্তব ঘটনা দেখছি। হুমায়ূন আহমেদ নেই কিন্তু তার নাটকের ধারায় কেউ কেউ নাটক নির্মাণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হচ্ছেন। অনেকটা অন্ধ অনুকরণের মতোই। হুমায়ূন আহমেদের জীবদ্দশায় তোলা নানা ঘটনার আলোকচিত্র ধারণ করেছেন বিশিষ্ট আলোকচিত্র নাসির আলী মামুন। তার তোলা ছবিগুলো দেখলেও সহজে বোঝা যাবে হুমায়ূন আহমেদের কাজের ধারা কেমন ছিল…
প্রায় চার দশক আগে কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানকে কেন্দ্র করে পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির ঝুঁকিপূর্ণ একটি কাজ শুরু করেছিলাম। ভেবেছিলাম কয়েক মাসের মধ্যে শেষ করতে পারব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এমন বিমূর্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো যে, সেটি করতে আমার আনন্দ এবং প্রবল আগ্রহ কয়েক মাসের কাজটিকে টেনে নিয়ে গেল দীর্ঘ নয় বছরে। বোহেমিয়ান সুলতানের জীবনে অনুপ্রবেশ করবার অনুমতি পাই এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যে ভীষণ প্রতিভাবান এই ব্যক্তিটির বন্ধু হয়ে যাই। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং উদাসীন একটি বিচ্ছিন্ন জীবন তিনি আমার ক্যামেরার সামনে উপস্থাপন করেন। যে জীবন সে সময়ে এই উপমহাদেশে ছিল অনুপস্থিত। শেকলবিহীন আদম সন্তানকে ক্যামেরায় ধারণ করেছি নানা অ্যাঙ্গেলে নিবিড়ভাবে। নড়াইলে তাঁর গ্রামের বাড়িতে দিন-রাত যাপন করেছি বহুবার। সখ্য ও সান্নিধ্যের বিচিত্র এক সম্পর্ক হয়েছিল, যার সাক্ষী শুধু আমি ও আমার ক্যামেরা। তিনি শুধু আমাকে অনেক সময়ই দেন নি, আমার ক্যামেরার সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন তাঁর জীবনের আলো-আঁধারির সমস্ত কুঠুরিগুলো।
২০০৫-এর কিংবদন্তি হুমায়ূন আহমেদের আগ্রহে প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন; তাঁর ওপর আলোকচিত্র নিয়ে একটি অ্যালবাম প্রকাশ করবেন বলে জানান। তাৎক্ষণিক রাজি হয়ে যাই আমি এবং শিল্পী সুলতানের উদার সময়ের প্রসঙ্গ তুলি আমি। আমার ইচ্ছেমতো যথেষ্ট সময় হুমায়ূন আহমেদ দেবেন বলে মাজহারুল ইসলাম জানান। অবিলম্বে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে নুহাশপল্লীতে যাওয়ার সুযোগ হয়। তাঁর প্রচÐ ভালো লাগার জায়গাটিতে সেদিন প্রচুর ছবি তুলে মনে হয়, তিনি আগামী দিনগুলোয় অনেক সময় দেবেন এবং আমার ক্যামেরার সামনে সমর্পণ করবেন নিজেকে নানাভাবে। তীব্র আগ্রহ নিয়ে কাজ শুরু করি এবং কয়েকমাস পরে বুঝতে পারি, হুমায়ূন ভাই খুবই ব্যস্ত। যথেষ্ট সময় আমার জন্য বরাদ্দ করা হয়তো তাঁর পক্ষে অসম্ভব। ব্যাপারটি এমন নয় যে, সব কাজ বাদ দিয়ে তিনি আমাকে সময় দেবেন। এমন একজন কৃতী ব্যক্তিত্বের ওপর ফটোগ্রাফির কাজ করতে যে বিষয়টি প্রধান তা হলো, তাঁর সমস্ত কর্মকাÐের সঙ্গে যুক্ত হওয়া এবং ক্রমাগত ছবি তুলে যাওয়া। সেটি সব সময় সম্ভব হচ্ছিল না। একসময় আমার মনে হলো, এ কাজটি করতে আমার দশ বছরও লেগে যেতে পারে। কিন্তু প্রকাশকের মাধ্যমে জেনেছিলাম, এত দীর্ঘ সময় হুমায়ূন আহমেদ অনুমোদন করতে চান না।
আমার পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির প্রতি হুমায়ূন আহমেদের উচ্চ ধারণা আমাকে আপ্লুত করে। তিনি প্রকাশ্যে আমার ছবির প্রশংসা করেছেন জেনেছি। কিন্তু তাঁর আগ্রহ থাকলেও আমাকে সময় দেয়া তাঁর পক্ষে সব সময় সম্ভব হয় নি। মাঝে মাঝে তাঁর সামনে ক্যামেরা নিয়ে হাজির হই, তার পর দীর্ঘ বিরতি। সেটি তাঁর ও আমারÑ দুজনের পক্ষ থেকেই হয়েছে। যে উদ্যম নিয়ে কাজটি শুরু করেছিলাম সেটি একতরফা আগ্রহে এসে থেমে থাকে। সে জন্যে আমাদের যোগাযোগটা পরিপূর্ণ হয় না। এমন একজন বর্ণাঢ্য ব্যক্তির জীবন ও কর্ম নিয়ে কাজ করা অত্যন্ত আনন্দের এবং কঠিন জেনেও আমি কয়েকবার যোগাযোগ করেও তাঁকে ধরতে পারি নি। নাটক, চলচ্চিত্র, পেইন্টিংস এবং ঈদসংখ্যা ও বইমেলার জন্য বরাদ্দকৃত সময়ের বাইরে তাঁর কোনো অবসর ছিল না। এই ব্যস্ততাই আমার কাজের জন্য যুৎসই মনে হয়েছিল। কিন্তু সেই ব্যস্ততার মুহূর্তগুলো ক্যামেরায় বন্দি করার বিষয়টি ব্যাটে-বলে মেলানো বড্ড মুশকিল ছিল। তাঁর সঙ্গে এইসব মুহূর্তে যোগাযোগ করা আমার পক্ষে অনেক সময় সম্ভব হয়নি। হয়তো তাঁর সৃষ্টিশীল সময়ে আমার সঙ্গে যোগসূত্রের কোনো উপযুক্ত সুযোগ তৈরি করা যায় নি। আমি জানতাম, তিনি চাইতেন আমি তাঁর বিভিন্ন মুহূর্তে ক্যামেরায় বন্দি করি। কিন্তু কে করবে যোগাযোগ! সেটি হয় নি।
Humayon-ahmed-1আমি ভেবেছিলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের ওপর কাজটি শেষ পর্যন্ত হবে না। কিন্তু তিনি যখন কোলন ক্যানসারের চিকিৎসা নিচ্ছিলেন নিউইয়র্কে, তখন যোগাযোগ হয় তাঁর সঙ্গে। দেখা করতে যাই তাঁর ওজোন পার্কের বাসায়। অনেক দিন পর দুজন মুখোমুখি। আমার ক্যামেরা দেখে অন্য এক হুমায়ূন আহমেদকেÑ যাঁর মাথায় সাহেবদের হ্যাট, কেমোথেরাপি নিয়ে চুলগুলো প্রায় উধাও। ক্লান্ত আশাহত মুখচ্ছবি। ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকার প্রবল আগ্রহ এখনো যাঁকে সৃষ্টিশীল রেখেছে তীব্রভাবে। ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তাঁর আঁকা চিত্রকর্ম। দেয়ালেও কিছু ঝোলানো। নিজের আঁকা পেইন্টিংয়ে স্বাক্ষর দিচ্ছেন তিনি। ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে আনন্দ ও বেদনার সেই দৃশ্য ধারণ করি। মরণব্যাধি ক্যানসার তাঁর চেহারায় যে-দৃশ্য এঁকে দিয়েছে সেটি যন্ত্রণা হয়ে আমার শরীরে যেন ঢুকে যায়। কী অসহনীয় পরিস্থিতি! তিনি কি বেঁচে যাবেন নাকি না-ফেরার দেশে চলে যাবেন এমন ভাবনা দেশবাসীর। বিপুল পাঠক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেÑ কখন নিজ দেশে সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন তিনি! সেদিন অনেক ছবি তুললাম। অতৃপ্ত আমার মন। যেভাবে তাঁকে আলোকচিত্রে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলাম একটি অ্যালবাম করবার লক্ষ্যে, সেটি যেন বাস্তবে হয়ে উঠল না।
কয়েক মাস পর তিনি চিকিৎসকদের অনুমতি নিয়ে অল্প ক’দিনের জন্য দেশে ফিরে এলেন। নুহাশপল্লীতে দেখা করতে গেলাম। সারা দিন ছিলাম। তাঁর প্রত্যেকটি মুহূর্ত বন্দি করতে চেষ্টা করেছি।…. অসম্ভব অস্থির এই মানুষটি সবার সঙ্গে কথা বলছেন।… যে চাইছেন তাকেই দিচ্ছেন সাক্ষাৎকার। নানা অ্যাঙ্গেলে নুহাশপল্লীর রূপকারকে ক্যামেরায় আটকে রাখি। বুঝতে পেরেছিলাম, যে কাজটির জন্য তিনি আমাকে অনুমোদন দিয়েছিলেন ২০০৫-এ, সেটি ছোটগল্পের মতো অসমাপ্ত থেকে যাবে। ধানমন্ডির ‘দখিন হাওয়া’-য় কয়েকদিন গিয়ে শুধু ক্যামেরার সাটার টিপেছি। কোনো মুহূর্ত বাদ যায় নি। আমাকে অনেকগুলো ছবি এঁকে দিয়েছেন। আমার মুখের ছবি রচিত হয়েছে তাঁর হাতে। আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেছেন। তাঁর জীবনের শেষ ড্রইং। চোখে-মুখে হাসি আছে, দুষ্টুমিও আছে, কিন্তু নেই ‘জীবন’। যেটি তাঁকে অবারিত রাখত প্রতিদিন সেটি যেন উধাও হয়েছে ক্যানসারে। মুখাবয়বে ক্লান্তি ও বিষাদের চিহ্নগুলো খেলা করেছিল নিষ্ঠুরভাবে। ক্যামেরায় ফোকাস করতে আমার কষ্ট হচ্ছিল।
বাংলাদেশের তাঁর শেষ দিনে মাজহারুল ইসলামকে হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, মামুনের ছবি অ্যালবামটা যেন সবচেয়ে সুন্দর প্রডাকশন হয়…। এটি সেই অ্যালবাম যেটি নিয়ে তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল। যে কোনো কারণেই হোক সিংহভাগ আলোকচিত্র মানসম্পন্ন হয়নি। এটি আমার সীমাবদ্ধতা, ব্যর্থতা। ছবির বইকে ছবির মতো সরব হতে হয়। এটি যেন ছোটগল্পের মতো ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’Ñ এমন এক পর্যায়ে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে।
হুমায়ূন আহমেদকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করছি। তিনি যে মুহূর্তগুলো আমার জন্য রেখে গেছেন, সেগুলো হৃদয়ের আর্কাইভে ঠাঁই দিয়েছি গভীর কৃতজ্ঞতায়। আশির দশকের শেষ পর্যায়ে তাঁর ব্যক্তিগত নাইকন ক্যামেরাটি প্রায় চারমাস ব্যবহার করে কৃতার্থ হয়েছিলাম। আর আমার মুখের যে ড্রইংটি তিনি এঁকে দিয়েছিলেন, এরচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপহার আর কী হতে পারে! তিনি আমাদের সঙ্গে আছেন এবং থাকবেন। তিনি শুধু ছবি হয়ে নন, অগণিত বাঙালির হৃদয়ে জ্বলজ্বল করছেন নক্ষত্রের মতোন।
নাসির আলী মামুনের কথার সূত্র ধরে বলতে হয়, হুমায়ূন আহমেদ শুধুমাত্র আমাদের কাছে একটি ছবি নয়। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সৃষ্টিশীল কর্মের প্রেরণা। বাংলা সাহিত্যের মতো বাংলা টিভি নাটক তাঁর মেধাবী স্পর্শে বিকশিত হয়েছে। হুমায়ূনকে অনুকরণ নয় অনুসরণ করেই আমরা যদি পথচলি তাহলে বোধকরি কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারব। জয় হোক বাংলা টিভি নাটকের।