Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

চলো যাই শিল্পকলায়…

রেজানুর রহমান:
অনেকেই কলকাতার নন্দন সম্পর্কে উচ্ছ¡সিত মন্তব্য করেন। কলকাতার নন্দন মানেই সাংস্কৃতিক জাগরনের একটা উম্মুক্ত এলাকা। মঞ্চ কর্মীদের পাশাপাশি চলচ্চিত্র কর্মীদেরও মিলন মেলা বসে প্রতিদিন। হলে হলে চলছে নাটক অথবা সিনেমার প্রদর্শনী। যার যা দেখার তাই দেখার জন্য টিকেট কেটে ঢুকে যাচ্ছে নির্ধারিত হলের ভিতর। বাইরে তখন বসে যায় সংস্কৃতি কর্মীদের নির্ভেজাল আড্ডা। আর আড্ডা মানেই তো শুধু বিনোদন নয় মূলত সৃজনশীল আড্ডার মাধ্যমেই জন্ম নেয় নতুন নতুন ভাবনা।
কলকাতায় যারা বেড়াতে যান তাদের অনেকেরই ভ্রমণ কর্মসূচির অংশ থাকে নন্দনে ঘুরতে যাওয়া। পাশাপাশি নাটক ও সিনেমা দেখা। যারা সংস্কৃতিকর্মী নন তাদেরও এধরনের কর্মসূচি থাকে। ঢাকায় ফিরে এসে কেউ কেউ কলকাতায় নাটক, সিনেমা দেখার ভিডিও অথবা স্থিরচিত্র দেখিয়ে বন্ধু-স্বজনদের কাছে বাহবা নিতে চান। কিন্তু এদের অনেকেরই দেশের মঞ্চ নাটক, সিনেমা দেখার ব্যাপারে ব্যাপক অনীহা। অথচ কলকাতার নন্দনের মতো না হলেও ঢাকার সেগুনবাগিচায় দেশ বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব লিয়াকত আলী লাকীর নেতৃত্বে আমাদের শিল্পকলা একাডেমি যে ভাবে সাংস্কৃতিক জাগরনের প্রয়াস চালাচ্ছে তা প্রশংসা করার মতো। যারা সাম্প্রতিককালে শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে গিয়েছেন তারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন আমাদের শিল্পকলা একাডেমি এখন দারুন ব্যস্ত। নানামুখি সাংস্কৃতিক আয়োজনে মুখর শিল্পকলার গোটা প্রান্তর। প্রতিদিন বিকেলের পর শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। সম্প্রতি এক শুক্রবারে গিয়েছিলাম শিল্পকলা একাডেমি চত্বরে। বিকেল ৫টা। শিল্পকলা একাডেমির ভিতরের অংশের খোলা মাঠে অনেক মানুষের ভীড়। ঘাসের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে অনেকে। পাশেই সুদৃশ্য এক স্থাপনার ভেতর বসেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের খাবারের স্টল। দক্ষিণ এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী উপলক্ষে বাংলাদেশ সহ ২৪টি দেশের চারুশিল্পীদের আন্তর্জাতিক চিত্রকলা প্রদর্শনী চলছে শিল্পকলা একাডেমিতে। এই প্রদর্শনীকে কেন্দ্র করে বসেছে কর্পোরেট স্টাইলে খাবারের দোকান। সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশক সমিতির ব্যানারে নাটকের বইয়ের একটি স্টল বসেছে খাবারের স্টলের পাশেই এককোনায়। হাটতে হাটতে উঠে গেলাম দক্ষিণ এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী এলাকায়। শিল্পকলার চিত্রশালা ভবনের বিশাল আঙিনায় বসেছে চিত্রকলার নন্দিনিক এই প্রদর্শনী। চিত্রশালার ৪তলা ভবনের প্রতিটি ফ্লোর জুড়ে বসেছে বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশের চারুশিল্পীদের এই সময়ের শ্রেষ্ঠ কাজ গুলো। একেকটি চিত্রকর্ম যেন একেকটি বিস্ময়ের রাজ্য। কোথাও রংতুলির উজ্জ্বল্য আবার কোথায় ভিডিও মাধ্যমের খেলা। আবার কোনো কোনো গ্যালারীতে শিল্পীর ভাবনা জুড়ে আলো ছড়াচ্ছে নানা ধরনের স্থাপনা। কোনটা রেখে কোনটা দেখি এই অবস্থা। যারা প্রদর্শনী দেখতে এসেছেন তারা সকলে অভিভ‚ত। মোবাইলের ক্যামেরায় ছবি তুলছেন অনেকে। সেলফি তোলার হিড়িকও চোখে পড়ল। একদল তরুণকে পেলাম প্রদর্শনী স্থলে। প্রশ্ন করলামÑ কেমন দেখলে তোমরা? সকলের অভিন্ন উত্তরÑ খুব সুন্দর! এখানে না এলে বুঝতেই পারতাম না আমাদের শিল্পকলা একাডেমি এখন অনেক বড় হয়েছে। অনেক বড় বড় কাজ করছে।
হ্যাঁ, পাঠক আমাদের শিল্পকলা একাডেমি সত্যি সত্যি অনেক বড় হয়ে উঠেছে। যদি মঞ্চ নাটকের কথাই বলি… ছোটো বড় মিলিয়ে প্রতিদিন ৩টি হলে সন্ধ্যায় মঞ্চ নাটকের প্রদর্শনী চলে। এছাড়া রয়েছে, নাচ গান ও চিত্রকলার ক্ষেত্রে নানামুখি আয়োজন। ভেতরের অংশে খোলা মাঠে একটি উম্মুক্ত মঞ্চ বানানো হয়েছে। যদিও এই মঞ্চটি সক্রিয় নয়। খোলা মাঠের মাথায় রয়েছে একটি স্থায়ী খাবারের দোকান।
Mocho-1৩টি মঞ্চের প্রথমটি রয়েছে দুদক ভবনের সামনে দিয়ে শিল্পকলা একাডেমিতে ঢোকার মুখেই। এর নাম মূল হল অর্থাৎ জাতীয় নাট্যশালা। তার পাশেই ভবনের তৃতীয় তলায় রয়েছে এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হল। ভবনের ৬ষ্ঠ তলায় রয়েছে স্টুডিও থিয়েটার হল। অর্থাৎ প্রতিদিন কমপক্ষে ৩টি নাট্য দলের মঞ্চ নাটক দেখার সুযোগ রয়েছে শিল্পকলায়। এই ভবনের ৬ষ্ঠ তলায় রয়েছে একাধিক সেমিনার হল। এই হল গুলোতে ছুটির দিনে নাটক সহ সংস্কৃতির নানা বিষয়ে আলোচনা অথবা সেমিনারের আয়োজন করা হয়।
সেদিন শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে শিল্পকলার গোটা আঙিনায় তিল ধারনের ঠাই ছিল না। জাতীয় নাট্যশালায় বসেছিল আইডিএলসি নাট্যোৎসব। আবাসিক ভবন নির্মাণ ব্যবসায় জড়িত এই প্রতিষ্ঠানটি এবার ভিন্ন এক কনসেপ্ট নিয়ে ঢাকায় নাট্য উৎসবের আয়োজন করে। ৫ দিনের এই নাট্য উৎসবে ঢাকার ১০টি দল তাদের নাটক মঞ্চস্থ করে। দল গুলো হলো নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়, থিয়েটার, ঢাকা থিয়েটার, ঢাকা পদাতিক, প্রাচ্যনাট, প্রাঙ্গনেমোর, পালাকার, বটতলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার অ্যান্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগ এবং জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় নাটক ও নাট্যতত্ত¡ বিভাগ। অনলাইনের মাধ্যমে বিনামূল্যে উৎসবের নাটক দেখার সুযোগ করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ বিনামূল্যে মঞ্চ নাটক দেখার সুযোগ পেয়ে ব্যাপক দর্শক নাটক দেখার জন্য অনলাইনে টিকেট সংগ্রহ করেছে। দেশের মঞ্চ নাটকের ক্ষেত্রে এ এক নতুন ভাবনা। যদিও এই উদ্যোগটি নিয়ে মঞ্চ পাড়ায় এক ধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বিনে পয়সায় দর্শককে মঞ্চ নাটক দেখানোর এই উদ্যোগের বিরোধীতা করেছেন নাট্যকর্মীদেরই কেউ কেউ। এক সময় ‘দর্শনীর বিনিময়ে মঞ্চ নাটক দেখুন’ এই শ্লোগান তুলেছিল দেশের নাট্য আন্দোলনের পুরোধা সংগঠন নাগরিক। অথচ এই নাট্য সংগঠনটিও এবার বিনা টিকেটে দর্শককে নাটক দেখিয়েছে। ফলে বিতর্ক শেষ হয়নি। তবে উৎসবটিতে বিপুল সংখ্যক দর্শকের সমাগম ঘটে। উদ্যোক্তাদের বক্তব্যÑ আইডিএলসির আয়োজনে এবারের নাট্য উৎসবে যারা মঞ্চ নাটক দেখতে এসেছিলেন তাদের অনেকেই ঢাকার মঞ্চে নাটক দেখেন না। মঞ্চ নাটক সম্পর্কে তেমন ধারনাও রাখেন না। কাজেই তারা নাটক দেখতে এসে নিশ্চয়ই নতুন একটা ধারনা পেয়েছে। আগামীতে নিশ্চয়ই এরাই মঞ্চের ভালো দর্শক হবে।
দর্শনীর বিনিময়ে মঞ্চ নাটক দেখুন’ এই আহবান দেওয়া হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে। আবার ৪০ বছর পর বিনে পয়সায় নাটক দেখানোর উদ্যোগ মঞ্চ নাটকের প্রচার ও প্রসারে কতটুকু ভ‚মিকা রাখবে তা সময়ই বলে দিবে। তবে আইডিএলসির নাট্য উৎসবের ফলে মঞ্চ নাটক নিয়ে একটা সাড়া পড়েছে একথা বলা যায়। উৎসবের শেষ দিনে মঞ্চ নাটকের ৪দম্পতি যথাক্রমে আলী যাকের-সারা যাকের, রামেন্দু মজুমদার- ফেরদৌসী মজুমদার, ড. ইনামুল হক-লাকী ইনাম এবং নাসির উদ্দিন ইউসুফ-শিমুল ইউসুফ দম্পতিকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। এটি ভালো উদ্যোগ।
সেদিন শিল্পকলা চত্বরে ঘুরে মনে হলে সংস্কৃতি কর্মীদের অন্যতম মিলন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে আমাদের এই প্রিয় প্রতিষ্ঠানটি। কলকাতার নন্দনের চেয়ে কোনো অংশ কম নয়। যারা এখনও শিল্পকলায় যাননি তারা একবারের জন্য হলেও শিল্পকলা চত্বর থেকে ঘুরে আসতে পারেন। প্রতিদিন ৩টি হলে নাটক মঞ্চস্থ হয়। বিকেলের পর একাডেমির মূল গেটের পাশেই নির্ধারিত দিনের নাটক সমূহের নাটকের টিকেট পাওয়া যায়। কাজেই সময় সুযোগ করে ঘুরে আসুন একবার আমাদের নন্দন শিল্পকলা একাডেমি থেকে।