Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

গোল্ডেন গার্ল মাবিয়া ও শিলা

সৈয়দ ইকবাল: পুরো দেশ তাঁদের দু’জনকে গোল্ডেন গার্ল হিসেবেই এখন চিনে। দেশের জন্য তাঁরা শুধু সন্মানই নিয়ে আসেনি বরং দেশকে বিশ্বের দরবারে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছেন। চলতি বছর ব্রাজিল অলিম্পিক থেকে বাংলাদেশকে প্রথম স্বর্ণ উপহার দেয়ার স্বপ্ন দেখছেন সাফ গেমসে ভারোত্তোলনে স্বর্ণজয়ী মাবিয়া আক্তার সীমানত্ম। আর নতুন নতুন সাঁতারু গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছেন সাফ সাঁতারে জোড়া স্বর্ণজয়ী মাহফুজা খাতুন শিলা। এসএ গেমসের দ্বাদশ আসরে বাংলাদেশের প্রথম স্বর্ণপদক আসে ভারোত্তোলনে মাবিয়া আক্তার সীমানত্মর হাত ধরে। আর সাঁতারে ১৯ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গে দু’টি স্বর্ণপদক জিতে নিয়েছেন মাহফুজা শিলা।

স্বর্ণ পদক জয়ের পর মাবিয়া শুধু নিজেই কাঁদেননি, কাঁদিয়েছেন দেশের কোটি মানুষকেও। মাবিয়া বলেন, যখন আমার সামনে আমাদের জাতীয় পতাকা উঠেছে এবং জাতীয় সঙ্গীত বেজেছে তখন এমনিতেই অনেক কান্না চলে আসে। কাঁদতে চাইনি। তারপরও অনেক কান্না আসে। আসলে ঐ সময়ের অনুভূতির কথা বলে বোঝাতে পারবো না। নিজের স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে মাবিয়া বলেন, অলিম্পিকে বাংলাদেশের কোনো মেডেল নাই। তাই আমি চেষ্টা করবো আমার বাংলাদেশকে অলিম্পিকে একটা মেডেল দেয়ার।

মাবিয়া এই স্বর্ণ জয়ের আগে মালয়েশিয়ায় ২০১৩ সালে কমনওয়েলথ ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপে রুপা জিতেছিল। ২০১৪ সালে উজবেকিসত্মানে আফ্রো-এশিয়া কাপে রুপা এবং ঐ বছরই থাইল্যান্ডে কিংস কাপে ব্রোঞ্জ জিতেন মাবিয়া। আর ২০১২ সালে নেপালে প্রথম দক্ষিণ এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে জিতেছিল ব্রোঞ্জ। পুনেতে গত বছর কমনওয়েলথ চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের প্রতিযোগীকে হারিয়ে সোনা জিতেন তিনি। মাবিয়ার বাবার নাম হারুনুর রশীদ। যিনি খিলগাঁওয়ে একটা মুদির দোকান আছে। দুই বোন আর এক ভাইয়ের মধ্যে মাবিয়া সবার ছোট। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছেন মাবিয়া। সামনেই এসএসসি পরীক্ষা দেবেন বলে জানান। পড়াশুনার গল্প বলতে গিয়ে মাবিয়া বলেন, ‘আমি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি, তখন টাকার অভাবে আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। এরপর মামা বক্সার কাজী শাহাদাৎ হোসেন খেলার জগতে নিয়ে আসেন। ভার তুলেই বাংলাদেশ আনসারে চাকরি পেয়েছি। পরিবার থেকে কেমন সহযোগিতা পাচ্ছেন এমন প্রশ্নে মাবিয়া জানান, পরিবারের সবাই আমাকে এই খেলায় বেশ উৎসাহ দেয়। প্রতিবেশীরা বাবাকে বলে, ধন্যি মেয়ের ধন্যি বাবা। পড়াশোনা, অনুশীলন একই সঙ্গে কীভাবে চালিয়ে যান? উত্তরে মাবিয়া বলেন, এ জন্য ফেডারেশন আমাকে অনেক সাহায্য করে। আমাদের সেক্রেটারি মহিউদ্দিন স্যার, কোচ শাহরিয়া সুলতানা, শহীদ স্যার, বিদ্যুৎ ভাই, উনারা যদি অনুশীলন না করাত, আমি এতো দূর আসতে পারতাম না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই পুরস্কার আমার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি অলিম্পিকে খেলার স্বপ্ন দেখছি। এসএ গেমসে জিতেছি, এরপর কমনওয়েলথ ও এশিয়ান গেমসেও পদক জিতে দেশকে আরো সন্মানিত করতে চাই।  মাবিয়া একটু সময় পেলেই গান শুনে বলে জানান। কুমার বিশ্বজিৎ তার প্রিয় শিল্পী। এই শিল্পীর গাওয়া ‘যেখানে সীমানত্ম তোমার, সেখানে বসনত্ম আমার…’ তাঁর খুব প্রিয় গান। কথা কথায় বললেন, ‘আমার ডাকনাম সীমানত্ম। আমার নামের সঙ্গে এই গানের কথায় মিল আছে তো, তাই গানটি এতো প্রিয়।’

Silaমনের মধ্যে পুষে রাখা জেদ কাউকে কত দূর এগিয়ে নিতে পারে, মাহফুজা খাতুন (শিলা) সেটি করে দেখালেন। ফেডারেশনের অবহেলা-বঞ্চনাকে শক্তির আধার বানিয়ে সবাইকে চমকে দিয়ে এসএ গেমসে জোড়া সোনা জিতলেন যশোরের মেয়ে। দারুণ এক আদর্শ হয়ে দাঁড়ালেন বাংলাদেশের অগুনতি নারীর সামনে। বদলে যাওয়া জীবনে এখন ব্যসত্মতার শেষ নেই। নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে শিলা জানান, ‘এই অর্জনের পর সত্যিই অন্যরকম লাগছে। চারপাশে তাকিয়ে দেখি আমার পৃথিবীটা এখন অন্য রকম। ২০১৪ সালে জাতীয় প্রতিযোগিতায় রেকর্ড করেছিল শিলা। ফেডারেশন থেকে অনেক অবহেলার শিকার হয়েছেন বলে শিলা জানান। কথায় কথায় তিনি বলেন, ‘বিশ্বাস আমার ছিলই। অবজ্ঞাই আমাকে শক্তি দিয়েছে। আমার সমসাময়িক অনেককে অলিম্পিকের ট্রেনিংয়ের জন্য নির্বাচিত হয়েছে দেখে কষ্ট পেয়েছি। একজন খেলোয়াড়ের স্বপ্ন থাকে অলিম্পিক। অথচ রেকর্ড গড়া টাইমিং নিয়েও আমি বিবেচনায় আসিনি। কোনো ট্যুরই না পেয়ে নৌবাহিনীকে জানিয়ে দেই, তাঁদের হয়েই শুধু খেলব। ন্যাশনাল টিমে নয়। এই এসএ গেমসের ক্যাম্পের প্রথম দিকে আমি আসিওনি। বাসায় চলে যাই। কোচ পার্ক আবার আসায় আমিও ফিরে আসি। পার্কের কথা শুনে কেনো এসএ গেমসে গেলেন? এমন প্রশ্নে শিলা বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কী পার্কই আমাকে স্বপ্ন দেখান। তিনি আমাকে বলেছেন আমার টাইমিংটা ভালো হয়েছে। স্বর্ণটা আমার পক্ষেই জেতা সম্ভব বলে বলেন তিনি। এরপর তো প্র্যাকটিস আর প্র্যাকটিস এবং ফাইনালি যা হবার তাই হলো। নিজের স্ট্রাগলের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াশোনা করছি। প্র্যাকটিসের সময় চট্টগ্রাম আর ঢাকা আমার অনেক দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে। বন্ধুরা নোট দিয়ে সহযোগিতা করেছে। এমনও হয়েছে বিকেলে খেলেই চট্টগ্রাম গিয়েছি রাতে। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে আমাকে। এক পর্যায়ে শিলা নিজের জীবনের অনেক কষ্টের একটি অধ্যায়ের কথা জানান। বললেন, ‘১৯৯৯ সালে শিশু একাডেমিতে সাঁতারে খেলতে এসে গোল্ড মেডেল পাই দু’টি। ২০০৮ সালে বাবা যখন অসুস্থ হয়ে যান, আম্মা মেডেল থেকে সোনাটা বের করে বিক্রি করে দেন। আব্বুর চিকিৎসা আর আমাকে কিছু টাকা দেন। পরে আম্মা বলেন, তুমি মন খারাপ করো না। ওটা আমি তোমাকে বানিয়ে দেব। আম্মা বুঝতে পারেন কাজটা ঠিক হয়নি। কিন্তু কিছু করার ছিল না তাঁর। এটা আসলেই আমার জীবনের একটা কষ্টের অধ্যায়। তবুও শানত্মনা যে, আমার ঐ অর্জন দিয়ে বাবার চিকিৎসা হয়েছিল।’ ভবিষ্যতে বাংলাদেশ দলের কোচ হওয়ার স্বপ্ন দেখেন শিলা। তিনি বলেন, আশা করি ন্যাশনাল টিমের কোচ হবো। যেহেতু আমি একজন খেলোয়াড়। আমার স্বপ্নই থাকবে ন্যাশনাল টিমের কোচ হওয়ার।