Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

এবার আরও জমজমাট কৃষকের ঈদ আনন্দ!

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট থেকে ফিরে মোহাম্মদ তারেক
ঘড়ির কাটা তখন সকাল আটটা। আমাদের গাড়ি এসে থামল ময়মনসিংহের মৎস্য অধিদপ্তরের বাংলোর সামনে। গাড়ি থেকে নেমে প্রথমেই প্রকৃতির দিকে চোখ গেল। অসম্ভব সুন্দর একটি সকাল। কোনো বৃষ্টি নেই। মিষ্টি রোদ গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে। ডালে ডালে বাতাসের খেলা। আলপনার মতো ছায়া পড়ছে সবখানেই। রাস্তা-ঘাটে সকালের গরমটা যেন একটু কম। হলুদ রংয়ের ছেঁড়া ঘুড়ির কাগজের মতো বিভিন্ন জায়গায় পড়ে আছে রোদের টুকরো। আজকের সকাল হৈচৈ-এ মেতে উঠেছে। সেই সুখের সকালে আমরা সবাই ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে আবার রওয়ানা হলাম হালুয়াঘাটের ঔটি গ্রামের উদ্দেশ্যে। গাড়ি আপন গতিতেই এগোচ্ছে সেই কখন থেকে। কিন্তু এই পথ যেন শেষ হচ্ছে না। গন্তব্যে পৌঁছাতে মনে হচ্ছে আরো সময় লাগবে। অবশেষে আমাদের গাড়ি এসে থামলো ঔটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে। এরই মধ্যে শুটিংস্পটে পৌঁছে গেছেন অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ও পরিচালক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ ও আদিত্য শাহীন। দূর থেকে ভেসে আসছে মাইকের আওয়াজ। ঘোষণা করা হচ্ছেÑ অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে কৃষকের ঈদ আনন্দ অনুষ্ঠানের খেলাধুলা শুরু হবে। অনুষ্ঠান দেখার জন্য চারদিক থেকে দলে দলে মানুষ ছুটে আসছে কংস নদীর পাড়ে। পাশেই নানান পসরার মেলা বসেছে। মানুষের ভিড় আর ভিড়। ভিড় ঠেলে মঞ্চের দিকে গেলাম। শাইখ সিরাজ কিছু একটা বলছেন আর সবাই মনযোগ দিয়ে শুনছেন। তিনি দেখিয়েও দিচ্ছেন কিছু বিষয়। পাশে দাঁড়ানো সকলে মনোযোগ দিয়ে বুঝেও নিচ্ছেন।
ঘড়ির কাটা তখন সকাল ৯টা ৪০ মিনিট। শাইখ সিরাজ মাঠে প্রবেশ করার সাথে সাথে হাজার হাজার উৎসুখ মানুষ করতালি দিয়ে তাকে স্বাগত জানায়। শুরু হলো অনুষ্ঠানের দৃশ্যধারন পর্ব। শাইখ সিরাজ দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, বহু ঐতিহ্যে ভরপুর এই জনপদ থেকে স্বাগত জানাচ্ছি। ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক। এরপর শুরু হল কৃষকদের নিয়ে বিভিন্ন খেলা।
ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার ঔটি গ্রামের কিংস নদীর পাড়ে বসেছিল কৃষকের ক্রীড়া উৎসব। আর এই উৎসবের ভেতর দিয়েই অনুষ্ঠানে কৃষকের প্রাণের মানুষ শাইখ সিরাজ মালা গেঁথেছেন ময়মনসিংহের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সমৃদ্ধির জায়গাগুলো নিয়ে। নতুন করে দর্শকদের সন্ধান দিয়েছেন আমাদের কীর্তিমান মানুষগুলোর ব্যাপারে। ময়মনসিংহের অনেক জানা-অজানা চিত্র উঠে এসেছে এবারের কৃষকের ঈদ আনন্দ অনুষ্ঠানে। একই ভাবে এবারের কৃষকের ঈদ আনন্দ অনুষ্ঠানে সংযোজিত হয়েছে আকর্ষনীয় ও নতুন কিছু খেলা।
শাইখ সিরাজ বলেন, পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের তীরবর্তী ময়মনসিংহের মানুষের অর্থনীতির মূল ভিত্তিই কৃষি। প্রাচীনকাল থেকেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এ অঞ্চল। ধান, পাট, সরিষা, বেগুনের পাশাপাশি মাছ চাষেও বিপ্লব এনেছে এখানকার কৃষক। এ জেলার অসংখ্য সফল উদ্যোক্তা ও চাষির কল্যাণেই মাছ চাষে বাংলাদেশ আজ পৃথিবীতে চতুর্থ আসনে পৌঁছেছে। এই জেলার কলসিন্দুরের মেয়েরা সাহস আর দৃঢ় মনোবল দিয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে বিশ্ব প্রাঙ্গণে। এছাড়া এই ময়মনসিংহে রয়েছে বাংলার প্রাচীণ লোকগাঁথা ময়মনসিংহ গীতিকার উৎস্যভূমি। প্রাচীন কবি কান হারি দত্ত, কবি চন্দ্রাবতী, ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বার, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, প্রখ্যাত সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শিল্পী মিতালী মুখার্জীসহ অসংখ্য কীর্তিমান মানুষের জন্ম ময়মনসিংহে। এখানে জন্ম নিয়েছেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অনেক সূর্য সৈনিক। এই ময়মনসিংহে রয়েছে প্রাচীন অনেক স্থাপনা ও কীর্তি। এখানেই দেশের কৃষি শিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। প্রেম ও আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য এই ময়মনসিংহেরই নারী কবি চন্দ্রাবতী ইতিহাস হয়ে আছেন। প্রতিবছর ঈদ আনন্দের একটি নির্দিষ্ট থিম থাকে। এবার কৃষি ঐতিহ্যের আরেক কীর্তিময়ী নারী জোতিষী খনা কে থিম করা হয়েছে। সবদিক থেকে ময়মনসিংহকেই এবার এই আয়োজনের জন্য উপযোগী মনে হয়েছে।
বছরে দুই ঈদে শাইখ সিরাজ কৃষকদের নিয়ে ঈদ আনন্দ অনুষ্ঠান নির্মাণ করেন। অনুষ্ঠানে কৃষকদের নিয়ে আনন্দ-বিনোদনের পাশাপাশি থাকে সমাজ উন্নয়নমূলক বিভিন্ন ভাবনার কথা। যার ফলে অনুষ্ঠানটি হাসি আনন্দের পাশাপাশি সমাজ উন্নয়ন ভাবনায় সংশ্লিষ্ট মহলকেও সজাগ করে তোলে। প্রতিটি অনুষ্ঠানে থাকে একটি থিম। যার ভিত্তিমূলে থাকে কৃষক সমাজ। প্রতিবারের মতো এবারও কৃষকের ঈদ আনন্দের পরিবেশ ও পরিবেশনায় বেশ খানিকটা ভিন্নতা পাওয়া যাবে। যা দর্শকের জন্য হবে অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক ও শ্বাসরুদ্ধকর।

কংস নদীতে ভেলা বাইচ

ভেলা বাইচ উত্তেজনা পূর্ণ এবং আনন্দ দায়ক একটি খেলা। এই খেলায় ছয় জন তরুণ কৃষক অংশ নেন। দুটি কলা গাছ বাঁশ দিয়ে জোড়া লাগানো। অংশগ্রহণকারীরা দুই গাছে দু পা দিয়ে ভেলা চালাবে। সবার হাতে লাঠি বা বৈঠা দেয়া আছে। বৈঠা দিয়ে মাটিতে ধাক্কা দেয়া যাবে না। নৌকা নিয়ে নদীতে আছেন শাইখ সিরাজ। ক্যামেরাম্যানরাও প্রস্তুত। বাঁশিতে ফুঁ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় কংস নদীতে ভেলা বাইচ প্রতিযোগিতা। পানির ¯্রােতের বিপরীতে কলা গাছের ভেলা নিয়ে নদীর এপাড় থেকে ওপাড়ে যাওয়া, সত্যি বড় কষ্টের এই খেলা। পথ যত কষ্টের হোক, যত দুর্গম হোক তা পেরিয়ে যেতে পারে বাঙালি। এই পর্বটি নিশ্চয়ই দেশবাসীকে বহু কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতার কথা মনে করিয়ে দিবে।

যুদ্ধ চলছে

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে আমরা পেয়েছি প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে। অগণিত মানবিক স্মৃতি, নির্যাতনের স্মৃতি, সাফল্য ও গর্বের স্মৃতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু মহান স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও কী আমরা থিতু হতে পেরেছি? আমরা যেন আবার লিপ্ত হয়েছি অনাকাক্সিক্ষত এক যুদ্ধে। ঈর্ষা আর হানাহানির পঙ্কিল পথে এ যুদ্ধে যেন নিজের সঙ্গে নিজেরাই… মুখোমুখি। দুই কৃষকের মধ্য বালিশ লড়াইয়ের মাধ্যমে শাইখ সিরাজ ওই বাস্তব সত্যটি তুলে ধরেছেন। যা দেশের মানুষকে কিছুটা হলেও ভাবাবে। আত্মজিজ্ঞাসার জন্ম দিবে।

মেয়েদের ফুটবল খেলা

Krishi-3খেলা শুরু হয়েছে। ফুটবল খেলা। ছোট মাঠে বড় ফুটবলের খেলা। খেলছে ময়মনসিংহের কলসিন্দুরের মেয়ে ফুটবলাররা। যারা কি না অনূর্ধ্ব-১৪ বাংলাদেশ দলের হয়ে আন্তর্জাতিক মহিলা ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন। এই কলসিন্দুরের ১০ জন মেয়ে শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতে নাম ছড়িয়েছে। সেই কলাসিন্দুরের স্কুলের ৭ জন করে মেয়ে ফুটবলার লালদল ও নীলদলে বিভক্ত হয়ে খেলছে। ছোটগোল বারে ৫ মিনিট করে ১০ মিনিট খেলা হয়েছে কোনো পক্ষই গোল করতে পারেনি। খেলা ড্র হওয়ায় দুই দলকেই ৭ হাজার টাকা ভাগ করে দেয়া হয়। সঙ্গে আরো দেয়া হয় স্কুল ব্যাগ।

খেলাধুলা ও প্রতিযোগিতা প্রসঙ্গে

বরাবরের মতোই এবারো কৃষকের ঈদ আনন্দ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন কৃষক-কৃষাণীরা। এছাড়া অংশ নিয়েছেন কলসিন্দুরের মেয়ে ফুটবলাররা। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে তিন ইউনিয়নের আগ্রহী কৃষকদের ভেতর থেকে কয়েক দফা বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত করা হয় চ‚ড়ান্ত প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণকারীদের। অধিকাংশ কৃষকের কাছেই গ্রামীণ জীবনের এসব খেলাধুলা অনেকটাই অজানা। ‘চতুর্মুখিটান’ আনন্দদায়ক ও উত্তেজনাপূর্ণ একটি খেলা। এই খেলায় চার প্রতিযোগী অংশ নেন। দুই দলে ভাগ হয়ে প্রতিযোগীরা লড়াই করেন খাবার নেয়ার জন্য। প্রত্যেকদলের কোমরে বাঁধা আছে একটি করে গামছা। খাবার নেয়ার জন্য লড়ছে সবাই। কেহ কারো নাহি ছাড়ে সমানে সমান। এই প্রতিযোগিতার বিজয়ী পুরস্কার হিসেবে পায় ওয়ালটন ট্যাব। তৈলাক্ত কলাগাছ বেয়ে ওঠা কৃষকের ঈদ আনন্দের এক অদ্ভুত ও আনন্দ দায়ক প্রতিযোগিতা। ইতিপূর্বে দেশের বিভিন্ন জেলায় কৃষকের ঈদ আনন্দ আয়োজনে এই প্রতিযোগিতাটি ছিল। বেশ কয়েকটি জেলার কলা গাছ বেয়ে ওঠার মতো কঠিন প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি কৃষকরা। এবার ঔটি গ্রামের কৃষকরা প্রায় আধঘণ্টা ব্যাপী প্রাণান্ত চেষ্টা করেও তৈলাক্ত কলা গাছে উঠতে পারেননি কেউ। ‘আটার নিচে গুপ্তধন দৌড়ে আনো মানিক রতন’ প্রতিযোগিতায় এই পর্বটি মজাদায়ক খেলা। প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় ৫০ বছর বয়সী ছয় বৃদ্ধ
কৃষক। প্রতিযোগিতার শুরুতেই প্রত্যেকের দুই হাত গামছা দিয়ে বেঁধে দেয়া হয়। কিছুটা দূরে ৬টি মাটির পাত্রে আটার নিচে রাখা আছে চকলেট। দৌড়ে গিয়ে মুখ দিয়ে চলকেট আনতে হবে। বাঁশি ফুঁ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা যখন আটার ভেতর থেকে চকলেট মুখে নিয়ে ফিরল, তখন আর তাদের চেনা যায় না। তাদের চোখেমুখে আটার প্রলেপ। যেন অন্যগ্রহের মানুষ।

গিন্নি গেলেন ধরতে মাছ খাচ্ছে জামাই চুলার আঁচ

এটা ছিল আরেক মজাদায়ক খেলা। এই খেলায় তিন জোড়া দম্পতি অংশ নেন। মাঠের এক প্রান্তে মাছ কাটার বটি, মাটির চুলা, পাতিলসহ রান্নার সরঞ্জামি ও উপকরণ রাখা আছে মাটিতে। অপর প্রান্তে তিনটি টেবিলে সাদা পানির জারে আছে টাকি মাছ। তিন গিন্নি দৌড়ে গিয়ে পানি থেকে টাকি মাছ ধরে এনে, তা বটি দিয়ে কেটে চুলায় রান্না বসাবে। আর তাদের জামাইরা চুলায় আগুন দিচ্ছে। মাছ রান্না করার বিষয়টি নিয়ে প্রতিযোগিতা হতে পারে, সে বিষয়টি ছিল তাদের একেবারেই অজানা।
যারা এসব প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন তারা অভিনয় কায়দায় দারুণ শারীরিক কসরত ও পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। পুরস্করা হিসেবে পেয়েছেন কেউ মোটর সাইকেল, কেউ মাটি কাটার রিপার মেশিন, কেউ পাওয়ার টিলার, কেউ এলইডি টিভি, কেউবা ট্যাব, ডিনার সেটসহ নিত্যব্যবহার্য ও প্রয়োজনীয় নানা সামগ্রী।
শাইখ সিরাজের অনুষ্ঠানে ক্যামেরার গতিপথ অনেক সময়ই ব্যাকরণ মেলে চলে না। তবে বাস্তবতার বাইরে এতটুকুও যায় না তার ক্যামেরা। তার ক্যমেরায় সারাক্ষণই ধরা পড়ে দেশ, দেশের মানুষ আর দেশাত্মবোধ। এবার কৃষকের ঈদ আনন্দ অনুষ্ঠানে সেদিকটিই আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। দেশের সাধারণ কৃষকদের নিয়ে একটি বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান করার পাশাপাশি সচেতনতার একটি আয়নাও যে তৈরি করা যায় তা প্রকাশ পেয়েছে এবারের অনুষ্ঠানে। দর্শক অনুষ্ঠানটি দেখবেন, আনন্দের পাশাপাশি হাসবেন এবং ভাববেন অতীত ও বর্তমানকে নিয়ে, কোথায় ছিলাম, কোথায় আছি, কোথায় যাব ভবিষ্যতে এই ভাবনাও আচ্ছন্ন করে তুলবে দর্শককে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
কৃষকের ঈদ আনন্দ অনুষ্ঠানটি ঈদুল আযহার পরদিন বেলা সাড়ে ৪টায় চ্যানেল আইতে প্রচার হবে।