Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

ঈদের ছবি বিবর্তনের কাল

একটা সময় ছিল ঈদ আসার আগেই ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা নিয়ে সারাদেশে হৈচৈ শুরু হয়ে যেতো। সিনেমা হল গুলোয় ধোঁয়া-মোছার কাজ শুরু হয়ে যেতো আগে থেকেই। সিনেমা হল সাজানো হতো রঙিন কাগজ দিয়ে। পরিচালক, প্রযোজকদের পাশাপাশি বুকিং এজেন্টরাও অনেক ব্যস্ত হয়ে উঠতেন। দৈনিক পত্রিকার পাতায় পাতায় সিনেমার বড় বড় বিজ্ঞাপন ছাপা হতো। শহরের গুরুত্বপুর্ণ রাস্তার মোড় সহ ব্যস্ত এলাকার দেয়ালে দেয়ালে শোভা পেতো নতুন সিনেমার পোস্টার। শহরে মাইকিং শুরু হতো পুরোদমে-সুখবর, সুখবর… আপনারা এতো দিন যে সিনেমাটির জন্য অপেক্ষা করেছেন এবারের ঈদে আসছে সেই ছবি… সুখবর, সুখবর…
তখনকার দিনে বিনোদন বলতেই তো ছিল সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা। আর রেডিওতে গান অথবা নাটক শোনা। দু’চারটি বিনোদন পত্রিকা ছিল। সিনেমার তারকাদের গোপন খবর ছাপা হতো ওইসব পত্রিকায়। ফলে কাটতিও ছিল বেশ। পত্রিকার প্রথম পাতায় জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকার বড় বড় ছবি ছাপা হতো। ‘হাওয়া থেকে পাওয়া’ শিরোনামে তারকাদের নিয়ে মুখরোচক খবরও থাকতো। বিনোদনের অন্যকোনো বিকল্প না থাকায় এই সব পত্রিকার পাঠক সংখ্যাও ছিল বেশ। ঈদ সহ অন্যান্য উৎসব পার্বনে একদিকে সিনেমা হল, অন্যদিকে রেডিও বেশ আদরনীয় হয়ে উঠতো প্রায় প্রতিটি অগ্রসরমান পরিবারে। মজার ব্যাপার হলো সিনেমা হলের মালিক অথবা ম্যানেজার, এমনকি হল কাউন্টারে বসা টিকেট বিক্রেতাও বেশ সমীহ পাওয়া ব্যক্তি ছিলেন। কারণ তাদের সাথে সদ্ভাব থাকলে ভীড় এড়িয়ে নতুন সিনেমার টিকেট জোগাড় করা সহজ হতো।
বর্তমান সময়ে এসব যেন আজগুবি গল্পের মতো। সিনেমা হলে টিকেট বøাকারদের ঠেকানোর জন্য প্রায়শই হলের সামনে পুলিশ মোতায়েন করতে হতো। বর্তমান সময়ে একথা অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইবেন না। এজন্য সময়টাই বেশ গুরুত্বপুর্ণ। যখনকার কথা বলা হচ্ছে তখনকার দিনে বিনোদনের ক্ষেত্র বলতেই ছিল সিনেমা আর রেডিও। ফলে দল বেঁধে পরিবারের লোকজন সিনেমা দেখতে সিনেমা হলে যেতো সিনেমা দেখে এসে পারিবারিক বৈঠকে ‘ভালো মন্দ’ আলাপ করতো। রেডিওতে সিনেমার গান শোনাও ছিল অনেকের বিনোদন।
আজকের দিনে এসব কথা ভাবলে বড়ই অবিশ্বাস্য লাগে। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে সিনেমার টিকেট কেনার স্মৃতি বর্তমান সময়ে ছেলে-মেয়েদের নেই বললেই চলে। কারণ এখন তো টিকেট কেনার জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়ানোর দরকার পড়ে না। কারণ হলে গিয়ে সিনেমা দেখার সেই আগ্রহ এখন অনেকের মাঝেই দেখা যায় না। এজন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিস্তৃতিকে দায়ী করেন অনেকে। হাতে যদি থাকে একটি আধুনিক মানের মোবাইল ফোন তাহলেই তো শুধু দেশ নয় পুরো পৃথিবীর বিনোদন ভাÐার পাওয়ার যাবে ওই ফোনে। সিনেমা, নাটক, গান, টকশো, খেলা, বিস্ময়কর তথ্যসহ যা দেখতে চান তাই পাবেন। কাজেই সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখার তাড়না অনেকের মাঝেই থাকে না। ফলে আমাদের দেশে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখার পারিবারিক সেই ঐতিহ্যও হারিয়ে যেতে বাসছে। তাহলে কি আমাদের দেশে সিনেমার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিৎ? এমন প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসছে বার-বার। আমাদের এই বাংলাদেশে এক সময় ১৩০০ সিনেমা হল ছিল। তখন সেই সংখ্যা আড়াইশতে নেমে এসেছে। দেশের অনেক জেলা শহরেও সিনেমা হল নাই। যদিও বা আছে, বেশ জরাজীর্ন পরিবেশ। বিব্রতকর পরিবেশের কারণে অনেকে ওইসব সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে যেতে চায় না। একটা বিবর্তনের কাল শুরু হয়েছে।
তবে আশার কথা, হল মুখি সিনেমা দর্শকের সংখ্যা আবার বাড়তে শুরু করেছে। গত ঈদে নতুন সিনেমা দেখার জন্য রাজধানীর অধিকাংশ সিনেমা হলে বেশ ভীড় ছিল।
ঢাকার বলাকা সিনেমা হলের একজন কর্মকর্তা বললেন, একথা সত্য ফেসবুক ও ইউটিউব সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যখন খুশি তখন যে কোনো দেশের যে কোনো সিনেমা দেখার সুযোগ রয়েছে। আর তাই দর্শক কষ্ট করে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখার আগ্রহ হারাচ্ছে। কিন্তু এটাই প্রকৃত সত্য নয়। আমরা দর্শকদের সাথে কথা বলে দেখেছি তারা সিনেমা হলের বড় পর্দায়ই সিনেমা দেখতে আগ্রহী। তবে সেই সিনেমাকে হতে হবে আধুনিক ও আকর্ষনীয়। পুরনো ফরম্যাট অর্থাৎ শুধুমাত্র পার্কের প্রেম সমৃদ্ধ সিনেমার দর্শক পাওয়া এখন খুবই মুশকিল। সিনেমায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের পাশাপাশি ভালো গল্পও দেখতে চায় দর্শক। কলকাতার ‘বেলাশেষে’ নামে একটি সিনেমার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বললেন, পারিবারিক জমজমাট কাহিনী সমৃদ্ধ সিনেমা দেখার ক্ষেত্রে অনেকের আগ্রহ রয়েছে। দুর্ভাগ্য জনক হলেও সত্য, আমাদের নির্মাতাদের অনেকেই সময়কে বিবেচনায় নিয়ে আধুনিক মনস্ক সিনেমা বানাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ফলে সিনেমা হলে দর্শককে আগ্রহী করে তোলা যাচ্ছে না।
স্টার সিনেপ্লেক্স এর একজন কর্মকর্তা বললেন, হলে বসেই সিনেমা দেখার মানুষের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু সময়ের বিবেচনায় দর্শক পছন্দের ছবি বানাতে আমরা মাঝে মাঝে ব্যর্থ হচ্ছি বলে দর্শককেও হারাচ্ছি। তিনি বলেন, গত ঈদে আমাদের সিনেমা হল গুলোতে দর্শকের উপস্থিতি বেশ ভালো ছিল। বিভিন্ন সিনেমা হলে দর্শক ভীড় করে নতুন সিনেমা দেখেছে। তাদের অনেকের সাথে কথা বলে বুঝেছি নতুন সিনেমায় একটি ভালো গল্প দেখতে চায় দর্শক। পাশাপাশি সিনেমায় তথ্যপ্রযুক্তির সন্নিবেশও প্রত্যাশা করে অনেকে।