সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2001-2021 - আনন্দ আলো
আকাশ পথে আধঘণ্টার ব্যবধান। অর্থাৎ ত্রিশ মিনিট। এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যেতেও এর থেকে বেশি সময় লাগে। আধঘণ্টার পথ। কিন্তু ব্যবধান অনেক। ঢাকা থেকে কলকাতা যাবেন। টিভি খুলে বাংলাদেশকে পাবেন না। টিভিতে তন্ন তন্ন করে বাংলাদেশকে খুঁজে হয়রান হবেন। আধঘণ্টার ব্যবধানে বাংলাদেশ নেই। বাংলাদেশকে খুঁজে পাবেন না। অথচ কলকাতা থেকে ঢাকায় নেমে আপনার একবারও মনে হবে না আপনি ভারতের বাইরে আছেন। বরং কলকাতায় ভারতের যে টিভি চ্যানেলগুলো সহজ ভাবে দেখা যায় না ঢাকায় সেগুলো সহজ ভাবেই দেখতে পাবেন। টেলিভিশন দেখার ক্ষেত্রে এই যে বৈষম্য তা চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। একে অবশ্য অনেকে বৈষম্য বলতে নারাজ। তারা বলতে চান আকাশ সংস্কৃতির কথা। আকাশ থেকে উড়ে আসা সংস্কৃতি। রোধ করা যায় না। কিন্তু কলকাতা রোধ করে কীভাবে? আকাশ পথে ঢাকা আর কলকাতা ত্রিশ মিনিটের ব্যবধান। কলকাতায় গিয়ে বাংলাদেশের একটিও টিভি চ্যানেল খুঁজে পাবেন না। আর ঢাকায় কলকাতারই টিভি চ্যানেল দেখার অবারিত সুযোগ। মনে হবে ঢাকায় নয় কলকাতাই বসে আছেন।
বলছিলাম আকাশ সংস্কৃতির কথা। আকাশ থেকে ভেসে আসা সংস্কৃতি। যার সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির কোনো মিল নেই। যা কিছু সুন্দর তা গ্রহণ করতে আমাদের কোনো বাধা নেই। কিন্তু আমরা আকাশ সংস্কৃতির নামে যা গ্রহণ করছি তা আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মোটেই যায় না। পাশের দেশের টেলিভিশনের একাধিক টিভি সিরিয়াল আমাদের এখানে বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে পরিবারের মহিলা সদস্যরা এসব সিরিয়ালের দারুণ ভক্ত। প্রতিটি সিরিয়ালই পারিবারিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেখা। কিন্তু সিরিয়ালগুলোর মূল সুর পরস্পরের প্রতি শত্রুতা, পরকীয়া আর একে অপরকে বিপদে ফেলার চেষ্টা। নাটকের পাত্র-পাত্রীরা সব সময় সেজেগুজে থাকে। ঘরে-বাইরে ঘোড়ার মতো দাঁড়িয়ে কথা বলে। কে কার বিরুদ্ধে কতগভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারে তারই যেন প্রতিযোগিতা চলে। যদিও এটি কলকাতার সমাজ ব্যবস্থার চিত্র নয়। কিন্তু দর্শককে আকৃষ্ট করতে হবে বলে এই প্রচেষ্টা। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, পাশের দেশের অবাস্তব কাহিনি সমৃদ্ধ টিভি সিরিয়াল দেখতে দেখতে আমাদের দেশে পারিবারিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে যেন একটা চির ধরেছে। মন্দ লোকের চরিত্রটিই যেন সবার আদর্শ হয়ে উঠছে।
অথচ আমাদের রয়েছে প্রায় ৩০টি টিভি চ্যানেল। যেখানে রাতদিন ২৪ ঘণ্টা প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের কথা বলা হয়। বাংলাদেশকেই দেখানো হয়। ঈদ উপলক্ষে প্রতিটি টিভি চ্যানেল বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান মালার আয়োজন করেছে। কারও ৫ দিন, কারও ৭দিন ব্যাপী অনুষ্ঠান মালা রয়েছে। টিভি নাটক তো আছেই। আরও আছে টেলিফিল্ম, সিনেমা, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, টকশো, ঈদের ধারাবাহিকসহ নানামুখী অনুষ্ঠান। প্রতি ঈদেই টিভি চ্যানেলগুলোর এত আয়োজন থাকে। তবুও দেশে একশ্রেণির দর্শক পাশের দেশের টিভি খুলে বসে থাকেন। প্রিয় পাঠক, এবার আসুন না আমরা সকলে মিলে ঈদের আয়নায় নিজের দেশটাকে অন্তর দিয়ে দেখি। টিভি চ্যানেলগুলো অনেক পরিশ্রম করে আপনাদের জন্য নানামুখী অনুষ্ঠানমালা সাজিয়েছে। অনুষ্ঠানগুলো আপনাদের জন্যই প্রচার হবে। তখন আপনি যদি অন্যদেশের টিভি চ্যানেল খুলে বসে থাকেন তাহলে তো হবে না। এই ঈদে দেশের টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখুন। অনুষ্ঠানের ভালো-মন্দ নিয়ে কথা বলুন। একটা জবাবদিহিতার পরিবেশ সৃষ্টি করুন। এক্ষেত্রে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির ভূমিকা অনেক। দেশের টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখার ক্ষেত্রে তিনিই একটা ভূমিকা নিতে পারেন।
ঈদের ছুটিতে অনেকে বিদেশে পাড়ি জমান। ভাবটা এমন নিজ দেশে দেখার কিছু নাই। যাই দেখে আসি অন্যদেশ। অথচ এই ধারণা ভুল। বাংলাদেশে অনেক দর্শনীয় স্থান আছে সেখানে না গিয়ে আমরা অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমাই। এই ঈদের ছুটিতে আসুন না আমরা নিজের দেশটাকে আগে দেখি। যেতে পারেন পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে। ঘুরে আসতে পারেন রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, সেন্টমার্টিন, কুয়াকাটা, জাফলং, পাহাড়পুরসহ দেশের দর্শনীয় এলাকা থেকে। ভ্রমণে একা না যাওয়াই ভালো। পরিবারের তরুণ সদস্যদেরকে দেশের ঐতিহ্যমণ্ডিত এলাকা থেকে ঘুরিয়ে আনুন। এর ফলে তাদের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগ্রহ হবে। যা এই মুহূর্তে খুবই জরুরি।
পারিবারিক মূল্যবোধ নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবারের তরুণ সদস্যরা বড়দেরকে ভক্তি শ্রদ্ধা করছে না। এমন অভিযোগও উঠেছে। এক্ষেত্রে ছোটদের চেয়ে বড়দের ভূমিকা অনেক। ঈদের ছুটিতে ছেলে-মেয়েদেরকে গ্রামে নিতে যেতে চেষ্টা করুন। গ্রামেই রয়েছে আমাদের নাড়ির টান, সেটা বোঝানো বড়দেরই কর্তব্য। ঈদের ছুটিতে আপনি আরও একটি কাজ করতে পারেন। আপনার স্কুল অথবা কলেজের প্রিয় শিক্ষক, শিক্ষিকার সঙ্গে একবার দেখা করে আসতে পারেন। সঙ্গে রাখতে পারেন ছেলে-মেয়েদেরকেও। ঈদের আয়নায় প্রিয় শিক্ষককেও শ্রদ্ধা জানাতে পারেন।
ঈদের এই ছুটিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিতে পারেন সহজেই। অনেক দিন পর নিজ গ্রামে এসেছেন। মেধাবী ছেলে-মেয়েদের একত্র করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুরস্কৃত করতে পারেন। মাননীয় সংসদ সদস্যরাও এক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা নিতে পারেন। ভাবুন তো একবার দেশের ৩০০ জন সংসদ সদস্য ঈদ উপলক্ষে নিজ নিজ এলাকায় একজন করে হলেও মেধাবী তরুণ-তরুণীকে পুরস্কৃত করার উদ্যোগ নিলেন। সারাদেশে ৩০০ জন তরুণ-তরুণী পুরস্কৃত হবে। এটা হতে পারে সংসদ সদস্যের পক্ষ থেকে ঈদের উপহার। প্রতিজন সংসদ সদস্য বাৎসরিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই ব্যবস্থাকে গুরত্বপূর্ণ করে তুলতে পারেন। প্রতি ঈদে এলাকার এক বা একাধিক মেধাবী তরুণ-তরুণীকে খুঁজে বের করা হবে। ঈদ আনন্দের অংশ হিসেবে তার হাতে তুলে দেয়া হবে বিশেষ পুরস্কার।
ঈদে গ্রামে বেড়াতে যাবেন। একবার হলেও খোঁজ নিন আপনার প্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অথবা ক্লাবের প্রতি। অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরিতে বই নাই। ইচ্ছে করলে কিছু বই দিতে পারেন আপনার প্রিয় স্কুলের লাইব্রেরিতে। আপনার প্রিয় ক্লাবটিকেও যথা সম্ভব সাহায্য করুন। আপনি উদ্যোগী হলেই দেখবেন আরও অনেকে এগিয়ে আসবেন।
একটি আয়নায় অনেগুলো মুখ। কিন্তু মুখগুলো চেনা নয়। অচেনা। এই আয়নার প্রয়োজন নাই। আরেকটি আয়না। মুখগুলো চেনা। অনেক আপন। এই আয়নাটিই প্রয়োজন।
আসুন সকলে ঈদের আয়নায় দেশকে দেখি। লাল সবুজের বাংলাদেশ। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি…