Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আসুন একদল স্বপ্নবাজ সামাজিক উদ্যোক্তার কথা শুনি

তারুণ্যই শক্তি। তারুণ্যই আগামীর স্বপ্ন নির্মাণ করে। আমাদের এই বাংলাদেশে প্রতিটি সেক্টরে তারুণ্যই উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা রাখছে। সাহিত্য, সংস্কৃতি, খেলাধুলা এমনকি রাজনৈতিক অঙ্গনেও তারুণ্যের জয় জয়কার। আমাদের টেলিভিশন মাধ্যম আজকে এই যে এত বিস্তৃতি লাভ করেছে তার পেছনেও কাজ করছে তারুণ্যের অফুরান শক্তি ও মেধা। সংবাদপত্রসহ প্রচার মাধ্যমের অন্য সকল ক্ষেত্রেও তারুণ্যের মেধাই সাহস যোগাচ্ছে। উদ্যোক্তা পর্যায়েও তারুণ্য উঠে আসছে স্বমহিমায়। তারই এক অনন্য দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো আনন্দ আলোর এই বিশেষ প্রতিবেদনে। বিল্ড বাংলাদেশ অকৃত্রিম আন্তরিকতায় এই তরুণদের খুঁজে বের করেছে এবং তাদের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন নির্মাণে সহায়তা দান কারীর ভূমিকা কাজ করছে। প্রিয় পাঠক, আসুন ৮ তরুণ উদ্যোক্তার স্বপ্নের ভেলায় ঘুরে আসি একবার। সাথে রয়েছে আনন্দ আলোর রিপোর্টিং বিভাগের কর্মীরা।

মাশরেকার ক্রিয়েটিভ কানেকশন্স

MAshrekerপাটের পরিচয়ই ছিল বাংলাদেশের সোনালি আঁশ। অথচ এই পরিচয় আজ নানা প্রতিকুল পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে। পাটের এতিহ্য ফিরিয়ে আনার জন্যই দীর্ঘদিন ধরে আমি মাশরেকা বিনতে মোশাররফ কাজ করছি পাট নিয়ে। আমার কোম্পানির নাম ‘ক্রিয়েটিভ কানেকশন্স’। আমাদের যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে। আমরা সবসময়ই চাই পাট পণ্য নিয়ে বাংলাদেশের একটি নিজস্ব ব্র্যান্ড তৈরি করতে, যেন পৃথিবীময় পাটের পণ্য বলতে বাংলাদেশের পণ্যই বুঝে সবাই।

বাংলাদেশের পাটের পণ্য বলতে সবাই বুঝে পাটের তৈরি বাজারের ব্যাগ। পাট দিয়ে অন্যান্য দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিস এখন বাংলাদেশে অনেকেই করছে, তবে বিচ্ছিন্ন ভাবে। আমরা তৈরি করছি সম্ভাব্য সকল পণ্য যা পাট দিয়েই বানানো সম্ভব। পাটকে আমরা অতি জরুরি হিসেবে তুলে ধরতে চাই সাধারণ মানুষের কাছে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমরা তৈরি করছি টেবিল রানার, কুশন কাভার, পর্দা, টেবিল ম্যাট, ল্যাপটপ ব্যাগ, পার্টি ব্যাগ, স্কার্ফ এবং প্রতিনিয়তই আমরা চেষ্টা করছি আরও নতুন কিছু বানানোর। এই সকল পণ্য দেশে-বিদেশে বহুল চাহিদা সম্পন্ন, পরিবেশবান্ধব এবং দৃষ্টিনন্দন।

আমরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল যেমন মংলা, নরসিংদী, খুলনা, কমলগঞ্জ, কামরাঙ্গিরচর এবং ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় মেয়েদের বিনামূল্যে এই সব পণ্য বানানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। এই মেয়েরা পরবর্তীতে আমাদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পায় অথবা তারা নিজেরাই কিছু পণ্য তেরি করে উপার্জনের পথ খুঁজে নিতে পারে।

ভবিষ্যতে পাটের পণ্য সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে সহজলভ্য করা এবং বৈদেশিক মুদ্রা দেশের জন্য অর্জন করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। তাছাড়া পাটের বস্ত্রসামগ্রী তৈরি করার লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।

আমাদের লাইট অফ হোপ

ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের একটি জরিপ বলছে এখন যেসব শিশু প্রাইমারি লেভেলে পড়ছে তার ৭০-৮০ ভাগ শিশু ভবিষ্যতে এমন একটি চাকরিতে ঢুকবে যার অস্তিত্বই এখন নেই। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত শিশুদের ভবিষ্যতের পৃথিবীর জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলা যেন তারা তাদের মেধা দিয়ে সমাজে এবং ব্যক্তিগত জীবনের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে। টেকনোলোজির কল্যাণে পৃথিবী এখন এত দ্রæত পরিবর্তন হচ্ছে যে আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা সেই তুলনায় অনেক পুরনো এবং অনেকাংশে শিশুদের আগামীর জন্য প্রস্তুত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। সামনের ১৫-২০ বছরে সেটি আরও অনেক বেশি দৃশ্যমান হবে। তাহলে কীভাবে আমরা আমাদের শিশুদের প্রস্তুত করবো?

লাইট অফ হোপের জন্ম এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে যেয়েই। লাইট অফ হোপ মূলত ৪-১০ বছর বয়সী শিশুদের Future Skill বা ভবিষ্যতের দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করছে। লাইট অফ হোপের কাজগুলো মূলত ৪টি ভাগে ভাগ করা। প্রথম হচ্ছে শিশুদের ভবিষ্যৎ স্কিল বাড়ানোর জন্য উপযুক্ত কন্টেন্ট তৈরি করা আছে। এখন যেসব কন্টেন্ট আছে সেগুলো সব বিভিন্ন বিষয় যেমন বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞানে কীভাবে ভালো করা যাবে সেগুলো চিন্তা করে বানানো। লাইট অফ হোপ ‘গুফি’ নামে একটি আন্তর্জাতিক প্লাটফর্ম তৈরি করছে যেখানে অভিভাবক, শিক্ষকরা তাদের শিশু অথবা শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন কন্টেন্ট (ই-বুক, ভিডিও, গেমস, অ্যাপ ইত্যাদি) পাবে যার দ্বারা শিশুদের ক্রিয়েটিভিটি, প্রবেøম সল্ভিং স্কিল, emotional intelligence, moral values ইত্যাদি বাড়ানো যাবে এবং সেগুলো তারা যাচাইও করতে পারবে।

এই প্লাটফর্মের জন্য তৈরি কোর্স এবং কন্টেন্ট নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘কিডস টাইম’ নামের একটি ব্র্যান্ড। কিডস টাইমের সেন্টারগুলোতে ৪/১০ বছর বয়সী শিশুদের বিভিন্ন কোর্স অফার করা হচ্ছে যার দ্বারা শিশুদের এই ভবিষ্যৎ স্কিলগুলো তৈরি হচ্ছে। এই কোর্সগুলোতে শিশুরা শেখে কীভাবে তারা একটি গল্প তৈরি করতে পারবে, সেই গল্পের বইয়ের ছবি তারা নিজেরাই আঁকে। এরপর সেই শিশুদের লেখা বইগুলোকে ই-বুক হিসাবে ওয়েবসাইটে দিয়ে দেয়া হচ্ছে যেন যেকোনো অভিভাবক চাইলে সেই বইগুলো ডাউনলোড করে নিজেদের শিশুদের পড়াতে পারেন। ইতোমধ্যে ঢাকায় কিডস টাইমের ৪টি সেন্টার খোলা হয়েছে এবং চট্টগ্রাম ও সাভারে শাখা খোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কিডস টাইম সেন্টারগুলোকে এমনভাবে সাজানো হচ্ছে যেন শিশুরা নিজেদের ইচ্ছামতো তাদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে।

আমাদের দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শিক্ষকতার মান নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। অথচ তাদের জন্য কোনো প্রফেশনাল স্কিল ডেভেলপন্টে ট্রেনিং নেই। লাইট অফ হোপ থেকে ‘টিচার্স টাইম’ নামে একটি প্লাটফর্ম তৈরি করা হয়েছে যেখানে শিক্ষকদের নানা ধরনের প্রফেশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট বিষয়ে ট্রেনিং করানো হয়। ইতোমধ্যে ৫০০ জনেরও বেশি শিক্ষক আমাদের সহায়তা পেয়ে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে আরও ভালোভাবে শিশুদের শেখাচ্ছেন।

ভবিষ্যতের উপযোগী করে শিশুদের তৈরি করার জন্য লাইট অফ হোপ বিভিন্ন স্কুল এবং শিক্ষা নিয়ে কাজ করে এমন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে কাজ করছে স্কুল এবং প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার সার্বিক মান উন্নয়নে। এর মধ্যে আছে শিশুতোষ বই দিয়ে স্বল্পমূল্য স্কুলে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোবাইল বিজ্ঞানাগার, সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম করে দেয়া এবং শিক্ষকদের  প্রশিক্ষণ। ইতোমধ্যে দেশের ১০০টিরও বেশি স্কুলের সাথে লাইট অফ হোপ এই কাজগুলো করছে যার মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে ৪০ হাজারেরও বেশি শিশু।

মাত্র দুই বছরের মাথায় নিজেদের কর্মকাÐ এত বড় আকার ধারণ করবে এমনটি ভাবিনি আমরা ৪ বন্ধু। ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে কাজের জন্য মিলেছে নানা ধরনের সম্মাননা। কিন্তু এখন কেবল শুরু হয়েছে কাজÑ এটাই মনেকরি আমরা। লক্ষ্য হচ্ছে এমন একটা ভবিষ্যৎ মুখি শিক্ষার মডেল তৈরি করা যেটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের ভবিষ্যতের পৃথিবীর জন্য প্রস্তুত  করবে এবং যেটি ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশের বাইরে অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে দেয়া যাবে। লাইট অফ হোপের তৈরি করা বিভিন্ন কন্টেন্ট ইতোমধ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্কুলগুলোতে ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশে বসে বাংলাদেশি একটি দল প্রাথমিক শিক্ষাকে ভবিষ্যৎ উপযোগী করে তুলতে আন্তর্জাতিকমানের একটি মডেল তৈরি করছে সেটি আমাদের জন্যও গর্বের একটি বিষয়।

আগ্রহীরা লাইট অফ হোপ এবং তাদের বিভিন্ন প্রোডাক্ট এবং সার্ভিস সম্পর্কে জানতে এই ওয়েবসাইটগুলো ভিজিট করতে পারে। www.lightofhopebd.org, www.kidstimebd.com, www.teacherstimebd.com, www.sputnique.xyz

লিপিং বাউন্ডারিজ অচলায়তন ভাঙার গল্প

সৈয়দা সাগুফে হোসেন লিপিং বাউন্ডারিজ’এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি জানালেন, আমাদের “লিপিং বাউন্ডারিজ” প্রোজেক্টটি কাজ করছে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যকার বিভাজন দূর করে তাদের দক্ষতার উন্নয়ন এবং সৃষ্টিশীলতা বিকাশের সুযোগ করে দিয়ে মূলধারার প্লাটফর্মে তাদের উপস্থিতি বৃদ্ধি করতে। বর্তমানে লিপিং বাউন্ডারিজ ৩টি আলিয়া মাদ্রাসায় বারো থেকে চৌদ্দ বছরের প্রায় ৩০০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ইংলিশ ল্যাগুয়েজ ডেভেলপমেন্ট, সফট স্কিল ডেভেলপমেন্ট ও কম্পিউটারে প্রোগ্রামিং এর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ছাত্রীদের গড়ে তোলা হয়। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের সাইকো- সোশ্যাল প্রোফাইলিং করে প্রয়োজন অনুযায়ী কাউন্সেলিং সাপোর্ট দেয়া হয় যাতে আত্মীক উন্নয়ন ও আত্মবিশ্বাস তৈরি করার মাধ্যমে তারা দৃঢ় ভাবেই ভবিষ্যৎকে মোকাবিলা করতে পারে। মাদ্রাসা ছাত্রদের নিয়ে সমাজে প্রচলিত ভুল ধারণা ও তাদের সীমাবদ্ধতা দূর করে তাদের মাঝে নেতৃত্বের গুণাবলী ফুটিয়ে তুলতে লিপিং বাউন্ডারিজ, বিওয়াইএলসি, গেøাবাল ডিগনিটি ডে এবং স্বর্ণকিশোরী সংস্থাগুলোর সাথে যুক্ত হতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ এবং প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। যাতে এই ছাত্রীরা অংশগ্রহণমূলক মূল ধারার প্লাটফর্মগুলোতে যেমন জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা, দ্যা স্পেলিং বি, লিডারশীপ প্লাটফর্মে গিয়ে নিজেদের প্রমাণ করতে পারে। গত বছরে প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে ৯০ জন শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে কোডিং এর উপর ছয় মাসের ট্রেনিং দেয়া হয় ও তাদের ডেভেলপ করা গেম-এর প্রদর্শনী করা হয়। তার আগে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের আঁকা কিছু চিত্র যেখানে তারা নারী হিসাবে নিজেদের কীভাবে দেখে তা তুলে ধরা হয় একটা প্রদর্শনীর মাধ্যমে। ভবিষ্যতে লিপিং বাউন্ডারিজ স্বনির্ভর হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম ওয়েরেবল আর্ট সোশ্যাল বিজনেস মডেলের মাধ্যমে। মাদ্রাসায় পড়া কিশোরী মেয়েদের তৈরি করা চিত্র দ্বারা অনুপ্রাণিত ডিজাইনে তৈরি হবে অলঙ্কার, যা বিক্রি করা হবে দেশে ও বিদেশে। এই প্রোজেক্টের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য মূলধারার সমাজ ব্যবস্থা ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মাঝে একটি সেতু হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে এই শিক্ষার্থীরা নিজেদের মেধার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটাতে পারে এবং তাদের সম্পর্কে প্রচলিত নেতিবাচক ধালণাগুলোকে তারা নিজেরাই দূর করতে পারে।

দ্য টেক একটি প্রযুক্তি শিক্ষালয়

শামস জাবের ‘দ্য টেক একাডেমির উদ্যোক্তা’। এটি একটি প্রযুক্তি শিক্ষালয়। পাশাপাশি একে প্রযুক্তি উদ্ভাবন কেন্দ্রও বলা যেতে পারে। প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে শামস জাবের যে ধারণা দিলেন অনেকটা এরকমÑ আমার প্রতিষ্ঠান থেকে মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবারের ৭ থেকে ১৭ বছরের প্রায় ২০০ শিশু প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের প্রশিক্ষণ শেষে তারা আমাদের ‘ইনভেশন ল্যাব-এ কাজ করার সুযোগ পায় এবং তাদের বানানো পণ্য বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করা হয়।

ভবিষ্যত পরিকল্পনা: আমরা আমাদের ছাত্রের ও প্রজেক্টের সংখ্যা বাড়িয়ে এদেশে স্কুল কলেজে ‘দ্যা টেক একাডেমী’কে একটি প্রচলিত ধারায় আনতে চাই।

অনেক স্বপ্নের ডাক্তার বাড়ি!

২০৩০ সালকে লক্ষ্য করে জাতিসংঘ প্রণীত “সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল” (এসডিজি) এর ৩য় ধারাটিই হলো সবার জন্য সকল বয়সে স্বাস্থ্যকর জীবন-যাপন নিশ্চিত করা। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন তো যে দেশে প্রিত ৪ হাজার জন রোগীর জন্য একজন ডাক্তার, সে দেশে এই লক্ষ্য অর্জন করা কতটা দুরূহ। তারপরও বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে স্বাস্থ্যখাতে একটু একটু করে এগিয়ে চলেছে সরকারি নানামুখী কার্যকর পদক্ষেপের জন্য। কিন্তু ২০৩০ সালের মধ্যে লক্ষ্য অর্জন করতে গেলে শুধু সরকারি উদ্যোগই যথেষ্ট নয়।

স্বাস্থ্যখাতে বেসরকারি উদ্যোগ বা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। কিন্তু তবুও সরকারী হাসপাতালগুলোতে রোগীদের উপচে পড়া ভিড়, শয্যা সংখ্যার তিনগুণের বেশি রোগীর হাসপাতালে অবস্থান, বহিঃবিভাগে প্রতি ৪৮ সেকেন্ডে একজন রোগীকে সেবা দিতে চিকিৎসকদের বাধ্য হওয়া প্রমাণ করে বেসরকারি উদ্যোগগুলো আদতে সাধারণ নি¤œ-আয়ের মানুষের ভরসার স্থল হয়ে উঠতে নিদারুণভাবে ব্যর্থ, যদি কারণ অনুসন্ধান করতে যাওয়া হয় তবে দেখা যাবে বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসা ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বেশি।

ডাক্তার বাড়ি- একটি সামাজিক স্বাস্থ্যসেবা উদ্যোগ যার জন্ম হয়েছে বেসরকারিখাতে অন্যায্যভাবে অতিরিক্ত খরচে স্বাস্থ্যসেবার ধারণার বিপরীতে একটি স্বল্পমূল্যের কিন্তু মানসম্মত সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা। এখানে আমরা সরকারি খরচের সমান খরচে ডায়াগনস্টিক বা রোগ নির্ণয়ের বিভিন্ন পরীক্ষা করে থাকি। এছাড়া রয়েছে খুবই কম খরচে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসা পাওয়ার ব্যবস্থা। ব্যবসায়িক স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে দরিদ্র জনসাধারণকে তাঁদের পক্ষে যে ব্যয় বহন করা সম্ভব তার মধ্যেই মানসম্মত চিকিৎসা সেবা দেয়াই ডাক্তারবাড়ির লক্ষ্য। ২০১৭ সালের স্পার্ক বাংলাদেশ এক্সিলেটরে এই উদ্যোগটি দুটি বিভাগের দুটিতেই পুরস্কার লাভ করে। এপ্রিলে পুরস্কার পাবার পরে স্পার্ক বাংলাদেশের সাহায্যে ২০১৭ এর অক্টোবর থেকে ডাক্তারবাড়ি তাঁদের প্রথম শাখা চালু করে মোহাম্মদপুরের শেখেরটেকে। বর্তমানে আদাবরে আরও একটি শাখাসহ দুটি শাখার মাধ্যমে এই অঞ্চলের দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকল্পে ডাক্তারবাড়ি কাজ করে যাচ্ছে। পর্যায়ক্রমে সারাদেশে ডাক্তারবাড়ির শাখা চালু হবে এটাই ডাক্তারবাড়ির ভবিষ্যৎ লক্ষ্য। এরজন্য প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতা। প্রয়োজনীয়  পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এটি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে একটি অনন্যসাধারণ উদ্যোগ বলে প্রতীয়মান হবে যার সুফল ভোগ করবে পুরো জাতি।

হাতের কাছেই ওষুধ ডটকম

আরেফিন অন্ধুব সহ তার বন্ধুরা ঔষধ ডটকম নামে একটি সৃজনশীল উদ্যোগ নিয়েছেন। আরেফিন বলেন, Ousud.com একটি অনলাইন ফার্মেসী যা মানুষকে তাদের নিজস্ব ওষুধ ব্যবস্থাপনা করতে এবং তাদের জীবনকে সহজ করে তুলতে সাহায্য করে। আমরা বাংলাদেশি ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানি থেকে সব ধরনের নির্ভেজাল ওষুধ এবং বিভিন্ন হেলথ প্রোডাক্ট সরাসরি সংগ্রহ করে গ্রাহকদের দরজায় পৌঁছে দেই। সেই সাথে আমাদের ধানমন্ডিতে অবস্থিত ফার্মেসীর মাধ্যমেও বিক্রয় করে থাকি। আমরা প্রেসক্রিপশন অনুসারে ওষুধ সরবরাহ করি এবং আমাদের গ্রাহকদের সময়মত সঠিক ওষুধ নিশ্চিত করি। একই সাথে আমরা অন্যান্য কোম্পানির সাথে যুক্ত হয়ে স্বাস্থ্য সেবামূলক কাজ করি।

Ousud.com এর লক্ষ্য নির্ভেজাল ওষুধ সরবরাহ এবং সহজলভ্য করার মাধ্যমে মানুষের জীবন উন্নত করা। আমরা মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য বিষয়ক জ্ঞান এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করে থাকি। আমাদের উদ্দেশ্য মানুষ যেন নিজের স্বাস্থ্যের উপর আরো নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে।

বাংলাদেশে ক্রনিক/দীর্ঘস্থায়ী রোগের সংখ্যা বাড়ছে। মানুষের স্বাস্থ্য বিষয়ক খরচের ব্যাপারে অনীহা লক্ষ্য করা যায়। এর ফলে মানুষ জানতেই পারে না যে রোগ তাদের মধ্যে বাসা বেঁধেছে, এবং রোগ প্রতিরোধের জন্য কি করা দরকার। বেশিরভাগ মানুষই নকল ওষুধ এর ব্যাপারে ধারণা রাখে না। বিভিন্ন ধরনের ফারমাসিটিক্যাল কোম্পানি, খুচরা বিক্রেতা এবং ফার্মেসী থাকতে বাজারে ওষুধের পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন ব্যাপার। একি সাথে অনেক ধরনের নকল ওষুধ বাজারজাত হওয়ার কারণে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি দিনদিন বেড়েই চলেছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে মানুষের স্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। একি সাথে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে আমাদের বিভিন্ন সমস্যা যেমন, ক্রনিক রোগ, ওষুধের সহজলভ্যতা এবং রাস্তার যানজট দিনদিন বাড়ছে। এই জন্য Ousud.com এর লক্ষ্য মানুষের সময় বাঁচানোর সঙ্গে সঙ্গে জীবনের মান উন্নয়ন করা।

আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে মানুষকে একটা ডিজিটাল প্লাটফর্ম দেয়া যার মাধ্যমে গ্রাহকরা নিজেদের স্বাস্থ্য বিষয়ক সেবা গ্রহণ করতে পারবে। এই প্লাটফর্মের মাধ্যমে গ্রাহকরা নিজেদের প্রেসক্রিপশন, বিভিন্ন ওষুধের তথ্য থেকে শুরু করে তাদের পূর্ববর্তী স্বাস্থ্য তথ্য দেখে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করতে পারবে।

Ousud.com এর আরেকটি লক্ষ্য হচ্ছে মধ্যবিত্ত জনগণের স্বাস্থ্য উন্নয়নে ভূমিকা রাখা এবং স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। মধ্যবিত্ত গ্রাহকরা সুলভমূল্যে ওষুধ এবং স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণ করতে পারে না এবং ফলে তারা স্বাস্থ্যকর জীবন বজায় রাখতে পারে না। অনেক সময় অর্থাভাবের কারণে ডাক্তারের কাছে যেতে পারে না, এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না।

আমরা স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্তভাবে দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন ডায়াবেটিস এবং ক্যান্সার-এর সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং বিনামূল্যে ওষুধ এবং টিকা বিতরণের ব্যবস্থা করে থাকি। এরসাথে ডায়াবেটিস এবং স্বাস্থ্যের অন্যান্য প্রাথমিক চেক আপ-এর জন্য প্রোগ্রাম আয়োজন করে থাকি। আমরা আশা করি ঙঁংঁফ.পড়স এর এই প্লাটফর্মের মাধ্যমে এই প্রোগ্রামগুলো পরিচালনা অব্যাহত রাখবো এবং স্বাস্থ্যসম্মত  জীবন যাপনের অবদান রাখবো।

ক্রিটিকালিংক তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসা…

ক্রিটিকালিংক নামে একটি ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবায় উদ্যোগী হয়েছে রাহাত হোসেন। তার মতে, প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয় ২০১৪ এর মার্চ মাসে। মার্কিন এক মেডিকেল ডাক্তার জেনিফের সাথে রাহাত শুরু করেন এই প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৪ থেকে ক্রিটিকালিংক ঢাকা শহরের ৮টি এলাকায় কাজ করছে। এলাকাগুলোÑ গুলশান, বনানী, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, পুরান ঢাকা, বারিধারা-বসুন্ধরা। এছাড়াও ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে বিভিন্ন এলাকায় ক্রিটিকালিংক কাজ করছে।

এ পর্যন্ত ৪৫০০ এর বেশি trainees ট্রেনিং নিয়েছেন এবং ১৫০০’র বেশি first responders কাজ করে যাচ্ছে। ক্রিটিকালিংক প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন এলাকায় মেডিকেল ক্যাম্প করে থাকে। যেখানে বিনা মূল্যে চিকিৎসা এবং ঔষধ প্রদান করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ক্রিকেট ম্যাচ এর সময় দর্শকদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান এবং বিভিন্ন লোক সমাবেশ-এ মেডিকেল সেবা প্রদান করে থাকে। প্রতি মাসে একটি ট্রেনিং প্রদান এর মাধ্যমে volunteers সংগ্রহ করা হয় এবং ক্রিটিকালিংক বিভিন্ন করপোরেট হাউসে first aid training প্রদান করে। এপর্যন্ত ২৪টি সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও মেডিকেল কলেজও ট্রেনিং করেছে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা তুলে রাহাত জানান, ভ‚মিকম্প সমস্যা মোকাবিলার পাশাপাশি আমরা disaster managemnet নিয়েও কাজ করবো।

ওমেন ইন ডিজিটাল

ওমেন ইন ডিজিটাল-এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন আছিয়া খালেদ নীলা। প্রতিষ্ঠানটি বেশ কিছু প্রশংসনীয় কাজ করে থাকে। যেমন: প্রযুক্তির মাধ্যমে ক্ষমতায়ন, ক্যারিয়ার কাউন্সিলিং, ওমেন ইন কমার্স, ট্রেনিং ও ওয়ার্কশপ মেন্টরিং সাপোর্ট, মহিলাদের জন্য প্রতিযোগিতা, মহিলা উদ্যোক্তার উন্নয়ন বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয়ে ১৫জন ইন হাউস ডেভেলপার আছে। আরও ১০ জন ডেভেলপার পার্ট টাইম হিসেবে কাজ করে। মহিলাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে ট্রেনিং দেওয়া প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম কাজ। যারা এই প্রতিষ্ঠান থেকে ট্রেনিং গ্রহণ করে তাদের কর্মসংস্থানের চেষ্টা করে প্রতিষ্ঠানটি।