Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আলোচিত সুলতান সুলেমান

বলিউড, টালিউড, হলিউড  কেন্দ্রিক স্টুডিওগুলো থেকে প্রচুর ইতিহাস-আশ্রয়ী, ইতিহাস দ্বারা অনুপ্রাণিত কিংবা ইতিহাসকেন্দ্রিক নাটক-সিনেমা ও ডকুমেন্টারি নির্মাণ করা হয়েছে। ইতিহাসভিত্তিক সিনেমাগুলো দর্শকপ্রিয়তাও পেয়েছে। ইতিহাসের প্রতি মানুষের সহজাত আকর্ষণ অথবা পেছনে তাকাবার দায়বদ্ধতার এটাও একটা নজির। ধর্মীয় নেতা, বিদ্রোহী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা ও ব্যতিক্রমী চরিত্রের মানুষগুলোকে নিয়ে আমাদের দেশে ফকির মজনু শাহ, শহীদ তিতুমীর একমাত্র নয়, গান্ধী থেকে ম্যান্ডেলা পর্যন্ত অসংখ্য চলচ্চিত্র কিংবা ডকুমেন্টারি নির্মিত হয়েছে।

এরই ধারাবাহিকতায় অটোমান বা ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের অন্যতম দিকপাল মহান সুলতান সুলেমানকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে একটি টিভি সিরিজ। আরবের স্বাধীনতাকামী নেতা ওমর মোখতার কে নিয়ে যে সিনেমা তৈরি হয়েছে, তা স্বাধীনতাকামী যেকোনো মানুষকে আলোড়িত করে। তবে সিনেমা তৈরির সময় কাহিনি রচনাকারী, প্রযোজক, পরিচালক ভুলে যান না এর মধ্যে বিনোদন এবং কাহিনি কাব্যের রসদ না দিলে দর্শক টানবে না। মেরাল ওকেয় রচিত সুলতান সুলেমান নির্মাণের সময় সেই বাস্তবতাটি ভুলে যাননি। বিনোদন উপস্থাপন করতে গিয়ে শাসক সুলতান সুলেমানকে কিছুটা আড়ালে ঠেলে দেয়া হয়েছে। হেরেমের কুটচাল, দাস-দাসীদের দৈনন্দিন জীবনাচার এবং সুলতানদের স্নায়ুযুদ্ধ বিনোদন জোগান দেয়ার বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। হেরেমের ড্রেস কোড খোলামেলাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। সিরিজজুড়ে অন্দরমহলের প্রাধান্যের কারণে একজন সুশাসক, তুখোড় কূটনীতিক ও বিচক্ষণ সুলতানের পরিচিতি তুলনামূলক কম গুরুত্বের সাথে উঠে এসেছে। সিরিজগুলো ‘আকর্ষণীয়’ ও আদিরসাত্মক করার জন্য যত গোঁজামিলই দেয়া হোক না, তাতে দর্শক আকর্ষন একটুও কমেনি।

ইতিহাসের কালজয়ী এক মহানায়ক সুলতান সুলেমান। প্রথম সুলেমান অটোমান বা তুর্কি খলিফাদের মধ্যে সেই বিরল ব্যক্তিত্ব, যিনি একটানা ৪৬ বছর (১৫২০-১৫৬৬) সাম্রাজ্য শাসন করেছেন। তিনি সময় মেপে পথ চলেননি, সময় যেন তাকে অনুসরণ করেছে। ইউরোপীয় ইতিহাসবিদরা তাকে ‘গ্রেট’ এবং ‘ম্যাগনিফিসেন্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা মিলিয়ে অটোমান সাম্রাজ্যের তখনকার বিসৱৃতি ছিল তিন মহাদেশের বিরাট অংশজুড়ে।

সুলেমান-১ জন্ম নিয়েছিলেন ১৪৯৫ সালের ২৭ এপ্রিল। তার পিতা সুলতান সেলিম-১, মা হাফছা সুলতান সনৱানের চরিত্র গঠন ও গুণগত লেখাপড়ার দিকে বেশি মনোযোগী ছিলেন। দাদী গুলবাহার খাতুনই ছিলেন কার্যত সুলেমানের প্রথম শিক্ষক এবং গাইড। মাত্র সাত বছর বয়সে সুলেমান তার দাদা সুলতান বায়েজিদ-২ এর কাছে ইসৱাম্বুলে গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শুরু করেন। পৃথিবী বিখ্যাত জ্ঞানতাপস খিজির ইফিন্দি বা আফেন্দি ছিলেন তার ওসৱাদদের মধ্যে অন্যতম। তার কাছেই সুলেমান ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব, রাষ্ট্রনীতি ও সমরকৌশল নিয়ে অধ্যয়নের সুযোগ পান। তারপর সুলেমান ১৫ বছর বয়স হওয়া অবধি ট্রাবজনে তার পিতার সাথে অবস্থান করেন। এই ট্রাবজনই ছিল তার জন্মস্থান। নেতৃত্বের যোগ্যতা, সততা, বুদ্ধি, জ্ঞান ও প্রতিভার গুণে মাত্র ১৫ বছর বয়সে সুলেমান গভর্নর নিযুক্ত হন। তাকে প্রথমে সরকি প্রদেশে, তারপর কারা হিসর, বলু এবং অল্প সময়ের জন্য কিফিতেও দায়িত্ব পালন করতে হয়। সুলতান সেলিম-১ ভ্রাতৃদ্বন্দ্বে জিতে ১৫১২ সালে ক্ষমতায় বসেন। তখন পিতার ইচ্ছানুযায়ী সুলেমান ইসৱাম্বুলে যাওয়ার আমন্ত্রণ পান এবং তার বাবার পক্ষ থেকে চাচাদের মধ্যে বিরোধ মেটানোর জন্য তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তখনো শাহজাদা সুলেমান সরুহান প্রদেশের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করছিলেন। পিতা সুলতান সেলিম-১ মারা গেলে সুলেমান ১৫২০ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে সর্বসম্মতভাবে অটোমান সাম্রাজ্যের খলিফা বা সুলতান মনোনীত হন।

সুলেমানের খলিফা বা সুলতান হওয়ার বিষয়টি কিংবদনিৱ হয়ে আছে। তার নামের প্রসৱাব আসে সাধারণ মানুষ, আম জনতার কাছ থেকে। সে সময় একজন লোকও খুঁজে পাওয়া যায়নি- যিনি তার নামে প্রসৱাব আসার পর দ্বিমত পোষণ করেছেন। পৃথিবীর কম শাসকই এতটা বিতর্কহীন ও সর্বসম্মতভাবে নির্বাচিত হতে পেরেছেন।

সবাই জানত, সুলেমান একজন প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, দৃঢ়চেতা, আত্মপ্রত্যয়ী ও ধার্মিক মানুষ। তিনি কখনো তার কমান্ড নষ্ট হতে দিতেন না। সুলতান সুলেমান তার জনগণের কাছ থেকে বিশ্বস্থতা ও আনুগত্য পাওয়ার ব্যাপারে দ্বিধাহীন ছিলেন। সুলতান এতটাই ধীমান ছিলেন, তার প্রতিটি বক্তব্য হত শিক্ষণীয় ও নির্দেশনামূলক। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে ভাবতেন। ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে এবং ক্রানিৱকালে কখনো ধৈর্য হারাতেন না। ১৫৬৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ৭১ বছর বয়সে সুলতান সুলেমান অভিযানে থাকা অবস্থায় হাঙ্গেরির সিগেতভার শহরে নিজ তাঁবুতে ইনেৱকাল করেন। তার এই মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক এবং বার্ধক্যজনিত। তাকে দাফন করা হয়েছিল অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল বা আজকের ইসৱাম্বুলে। তার সমাধিস্থলেই বিখ্যাত সুলেমানি মসজিদ নির্মিত হয়েছে। সুলেমানে ছিলেন অটোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সৎ এবং সাহসী শাসক। সুলতান মিথ্যা বলা পছন্দ করতেন না। কর্তব্যে অবহেলা মেনে নিতেন না, বাহুল্য কথা বর্জন করতেন, হালাল হারাম মেনে চলতেন। তার নির্দেশনা ও বক্তব্য হত নীতিবাক্যের মতো। সহজেই শত্রু-মিত্র চিনতে পারতেন। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার ব্যাপারে সুলতান এতটাই প্রখর ছিলেন যে, তার ওপর নির্ভরতায় কারো কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু দৃঢ়তা ও ব্যক্তিত্বের ছাপ কখনো ম্লান হত না। দেখতে সুলেমান ছিলেন সুদর্শন, দীর্ঘদেহী, ফর্সা এবং গাঢ় বাদামি ছিল তার চোখ, নাক ছিল খাড়া ও সরু। চোখের ভ্রূ ছিল জোড়া লাগানো। দীর্ঘ ছিল তার গোঁফ, দাড়ি ছিল সুন্দর, ব্যক্তিত্ব ছিল প্রখর ও অসাধারণ। তার কণ্ঠস্বর ছিল স্পষ্ট ও ভরাট। তাকে দেখলেই মনে হত আত্মবিশ্বাসী, বীর, দৃঢ়চেতা ও শক্তিধর। সৌভাগ্য ও অনুকূল পরিবেশ যেন সব সময় তার চার পাশে ঘিরে থাকত।

সেলিম-২, বায়েজিদ, আবদুল্লাহ, মুরাদ, মেহমেদ, মাহমুদ, জিহানগির, মোসৱাফা- এই আট পুত্র সনৱানের জনক। সুলেমানের ছিল দুই কন্যা মিহরিমা ও রেজায়ি।

Sultan-Solaiman-1সিরিজে তুর্কি ভাষার ধ্বনিতত্ত্বের কারণে কিছু শব্দের উচ্চারণ পাল্টে যায়- যেমন খাতুন হয়ে যায় হাতুন, খুররম হয়ে যায় হুররম। আমাদের জানা অনেক শব্দ তুর্কি উচ্চারণে ভিন্নভাবে ধ্বনিত হয়। বাংলাদেশে সুলতান সুলেমান নামে দীপ্ত টিভিতে যে সিরিজটি প্রদর্শিত হচ্ছে তা ইংরেজি থেকে বাংলায় ডাবিং করা। পৃথিবীব্যাপী টিভি নাটকের ক্ষেত্রে বহুল আলোচিত এই সিরিজের মূলভাষা তুর্কি।

 ইব্রাহিম পাশা

সুলতান সুলেমানের উজিরে আজম ইব্রাহিম পাশা। সম্রাটের বিশ্বস্থ সহচর। আসল নাম ওকান এলবিক। তুরস্কের ইসৱাম্বুলে জন্ম ১৯৭৮ সালে। পেশায় অভিনেতা। এ পর্যন্ত ২০টির বেশি সিরিয়ালে কাজ করেছেন। চারটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। এই সিরিজের দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র ইব্রাহিম পাশা। অত্যন্ত তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন উজিরের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন। কিন্তু জীবনে খুবই অসুখী একজন মানুষ।

হেতিজা সুলতানা

জার্মানির হাম শহরে জন্ম সেলমা এরগেজ ওরফে হেতিজা সুলতানার। পড়াশোনা করেছেন মেডিসিন বিষয়ে। এছাড়া সাইকোলজি ও ফিলোসফি নিয়েও পড়াশোনা করেছেন। তিনি জার্মান ও তুর্কি নাগরিক। মডেলিং ও অভিনয় তার নেশা। অনেকগুলো ভাষা জানেন তিনি। তার মধ্যে আছে জার্মান, তুর্কি, ইটালিয়ান, ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চ। তিনি বিবাহিত। তার স্বামীর নাম কেনওজ। ২০০০ সাল থেকে মডেলিং ও অভিনয় করছেন। এ পর্যন্ত তিনি ৭টি ছবিতে এবং ৭টি টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করেছেন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে। সুলতান সুলেমান সিরিজে তিনি অভিনয় করেছেন সম্রাটের বোনের চরিত্রে। এই সিরিজে তাকে হাবা গোবা দেখালেও ব্যক্তি জীবনে অনেক স্মার্ট এবং তুরস্কের নামকরা মডেল তারকা।

বেগম সুলতানা

আসল নাম নেবাহাত চেহরে। জন্ম কৃষ্ণসাগরের কাছে উত্তর তুরস্কে ১৯৪৪ সালে। বর্তমানে তার বয়স ৭২। পেশা অভিনয়। ১৯৫০ সাল থেকে অভিনয় করছেন। এ পর্যন্ত বহু চলচ্চিত্র ও টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি গোল্ডেন অরেঞ্জ বিজয়ী তুর্কি অভিনেত্রী। এক সময় মডেলিং করেছেন ও গানও গেয়েছেন। ১৯৬০ সালে হয়েছিলেন মিস টার্কি। ১৯৬০ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত মিস ওয়ার্ল্ডেও অংশ নেন তিনি এবং ১৯৬৫ সালে মিস ইউনিভার্সে তুরস্কের প্রতিনিধিত্ব করেন। ব্যক্তি জীবনেও সুকঠিন ও সত্যবাদী একজন মানুষ। কোনো কিছুর সঙ্গে আপস করেন না। এই সিরিজেও তার চরিত্রে সেই বিষয়টি ফুটে উঠেছে।

মাহিদেব্রান

জার্মান ও তুরস্কের নাগরিক নূর ফাত্তাহগুলু। সুলতান সুলেমান সিরিজে তিনি অভিনয় করেছেন সম্রাট সুলেমানের প্রথম স্ত্রী মাহিদেব্রান এবং শাহাজাদা মোস্তফার মায়ের চরিত্রে। ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত সদালাপি ও সজ্জন ব্যক্তি নূর মডেলিংও করেছেন। পেশা অভিনয়। টিভি প্রেজেন্টার ও ফ্যাশন ডিজাইনারের উপর পড়াশোনা করেছেন। প্রথম বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সেটাও ভেঙেছে ২০১৫ সালে। এ পর্যন্ত ৬টি টিভি সিরিজ ও দুটি ফিল্মে অভিনয় করেছেন। তার জন্ম ১৯৮০ সালে।

নীগার কালফা

আসল নাম ফেলিজ এহমেদ। তিনি ম্যাসোডোনিয়া ও তুর্কি নাগরিক। অভিনয় তার পেশা। তুরস্কে তিনি একনামে পরিচিত ফেয়ারওয়েল রুমেশিয়া টিভি সিরিজের মাধ্যমে। তার দাদা একজন বিখ্যাত অভিনেতা ছিলেন। ম্যাসোডোনিয়া ও তুরস্ক থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি তুলতান সুলেমান-এ নীগার কালফা চরিত্রে অভিনয় করে ইউরোপ, আমেরিকায় ও এশিয়ায় সমাদৃত হয়েছেন। তিনি ম্যাসোডোনিয়া আলেবিনিয়া, সুইডেন, টার্কিস, ইংলিশ, সার্বিয়ান ও বুলগেরিয়ান ভাষায় অভিনয় করেছেন। এবং এই ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন। তিনি গ্রাজুয়েশন করেছেন সুইডেনে মেডিক্যাল স্কুলে এবং ম্যাসোডোনিয়ায় গ্রাজুয়েশন করেছেন ফাইন আর্টস-এ। তার একটি মাত্র সনৱান।

শাহজাদা মোস্তফা

আসল নাম মেহমেত গানসুর। জন্ম তুরস্কে ১৯৭৫ সালে। পেশায় অভিনেতা মডেল ও প্রযোজক। গানসুর গ্রাজুয়েশন করেছেন ইটালিয়ান হাইস্কুলে। তুর্কি, ইটালিয়ান ও আমেরিকান চলচ্চিত্র ও টিভি সিরিয়ালে অভিনয় করে খ্যাতি পেয়েছেন। প্রথম জীবনে একটি রেস্টুরেন্টে বারম্যান হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৯৮ সালে আস্কার ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রমেজিং অ্যাকটর-এর সেরা পুরস্কার পান। ২০০৩ সালে স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ড পান গোল্ডেন অরেঞ্জ ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। এ পর্যন্ত ১৮টি সিরিজ ও ফিল্মে অভিনয় করেছেন তিনি। গানসুর একজন মুসলিম। বিয়ে করেছেন ১৯৮৯ সালে।