Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আমার গানের ভুবন-নকীব খান

জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক নকীব খান। ৪৭ বছরের সঙ্গীত জীবন তার। এই দীর্ঘ সময়ে অসংখ্য জনপ্রিয় গান গেয়ে মন জয় করেছেন শ্রোতাদের। ১৯৮৫ সাল থেকে ব্যান্ড দল রেনেসার সঙ্গে পথে হাঁটছেন। শুরু করেছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ব্যান্ড সোলস এর সাথে। বর্তমানে রেনেসার পঞ্চম অ্যালবামের কাজ নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। গানের পাশাপাশি তিনি নেসলে বাংলাদেশ-এর করপোরেট অ্যাফেয়ার্স ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। সুইজারল্যান্ড-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স ও বাংলাদেশ সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট সোসাইটির সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। অটিষ্টিক শিশুদের একটি সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত তিনি। আধুনিক, ক্লাসিক্যাল এবং লোকগীতি সব ধরনের গানের এক উজ্জল তারকা নকীব খানের সঙ্গে কথা হয় সম্প্রতি হেমন্তের এক বিকেলে। তারই চম্বুক অংশ প্রকাশ করা হলো লিখেছেনÑ মোহাম্মদ তারেক
আনন্দ আলো: রেনেসা ৩৩ বছর পূর্ণ করেছে আপনার অনুভ‚তি কেমন?
নকীব খান: ৩৩ বছর ধরে আমরা মিউজিকে আছি এটা অনেক ভালো লাগার একটা ব্যাপার। সবচেয়ে বড় কথা আমরা যখন শ্রোতাদের সামনে যাই কিংবা স্টুডিওতে লাইভ শো করি তখন ভক্তদের কাছ থেকে যে ভালোবাসা পাই তা দেখে মনে হয় ৩২ বছরে আমাদের অর্জন অনেক। আমরা কিছু ভালো গান উপহার দিতে পেরেছি। দর্শক এখনো সেই গান গুলোর জন্য আমাদেরকে মনে রেখেছে।
আনন্দ আলো: এই দীর্ঘ পথ চলায় শ্রোতাদের প্রত্যাশা কতটা পূরণ করতে পেরেছেন বলে মনে করেন?
নকীব খান: আমরা অনেক ভাগ্যবান যে নিজস্ব পছন্দ ও রুচিবোধে তৈরি গান দিয়েই শ্রোতাদের কাছাকাছি আসতে পেরেছি। জনপ্রিয়তার কথা কখনোই চিন্তা করিনি। বরং কথা ও মেলোডির ওপর জোর দিয়েছি সব সময়। এত দীর্ঘ সময় ধরে শ্রোতারা আমাদের সঙ্গে আছেন, আমাদের গান শুনছেন, তাদের ভালোবাসা পেয়েছি। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। আর ব্যর্থতা যদি বলেন, তাহলে বলব আমাদের অ্যালবামের সংখ্যা কম। ৩৩ বছরে আমরা মাত্র ৪টি অ্যালবাম প্রকাশ করতে পেরেছি। দর্শকদের চাহিদা আমাদের কাছে অনেক। সেটা আমরা পূরণ করতে পারিনি।
আনন্দ আলো: গানে এলেন কীভাবে
নকিব খান: বাবা মোহাম্মদ আইয়ুব খান চট্টগ্রামের কাজেম আলী হাইস্কুলের আমৃত্যু প্রধান শিক্ষক ছিলেন। গানের খুব ভক্ত ছিলেন। মা আক্তার জাহান খানও গানের অনুরাগী ছিলেন। নানা ‘কাওয়াল’ ছিলেন। কলকাতা থেকে তার লং প্লে বেরিয়েছিল। বড় ভাই মোহাম্মদ জিলু খান চট্টগ্রাম বেতারের নামকরা সুরকার ছিলেন। তিনি ভালো গাইতেও পারতেন। ‘বালার্ক’ নামে তাদের একটা ব্যান্ড দল ছিল। ব্যান্ডের বাদ্যযন্ত্র গুলো আমাদের স্কুল কম্পাউন্ডের বাসায়ই থাকত। তারা প্র্যাকটিস করতেন। ভাই গান গাইতেন, বাজাতেন এসব দেখে দেখেই আমার আর ছোট ভাই পিলুর গান শেখা শুরু। কেজি ওয়ান থেকে গান গাই। গাইতে গাইতে গায়েন হয়েছি। ফোর ফাইভে পড়ার সময় চট্টগ্রাম বেতারে ছোটদের নাটকে অভিনয় করতাম। একসময় মনে হলো গানই আমার জীবন। দুই-তিন বছর অভিনয়ের পর ফের গান গাওয়া শুরু করলাম।
আনন্দ আলো: ব্যান্ড সোলস এর সঙ্গে যুক্ত হলেন কীভাবে?
নকিব খান: ১৯৭৩ সালে ‘সুরেলা’ নামের ব্যান্ড দলের নাম বদলে হলো ‘সোলস’। কি-বোর্ডিষ্ট হিসেবে যোগ দিলাম ১৯৭৪ সালে। বালার্কের কি বোর্ড, ড্রামসহ সব বাদ্যযন্ত্র সোলস কিনে নিল। এসব বাদ্যযন্ত্র দিয়েই সোলসের যাত্রা শুরু হয়। তপন চৌধুরী তখন সোলসে। রনিদা, সাজেদ, লুলু, নেওয়াজ ভাই, রুডিসহ আরো অনেকে ছিলেন। আমরা একসঙ্গে গাই, অনুশীলন করি। তপনের অনেক গানে আমি সুর দিয়েছি। ১৯৭৮ সালে ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ তো কিংবদন্তি। এটি আমারই লেখা। জিলু ভাই আর আমি মিলে সুর করেছিলাম। এ ধরনের আরো অনেক গান সোলস-এ করেছি যে গুলো এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
আনন্দ আলো: নিজেকে গায়ক হিসেবে আবিস্কার করলেন কীভাবে?
নাকিব খান: সেজন্য তপনকে ধন্যবাদ দিতে হয়। সোলসে আমি মূল গায়ক ছিলাম না, তপনই ছিল। ফলে বেশির ভাগ গানই তাকে গাইতে দেয়া হতো। আমারও গায়ক হওয়ার কোনো শখ ছিল না। কি-বোর্ড বাজাতাম। গানে সুর করতাম। ব্যাপারটা উপভোগও করতাম। ১৯৮০ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে সোলসের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি শোর আগে হঠাৎ তপন খুব অসুস্থ হয়ে গেল। শেষমুহূর্তে আসতে পারল না। ফলে তার আমার গান গুলো পুরো শোতে গাইতে হলো। দর্শক সেগুলো পছন্দ করার পর মনে হলো বোধ হয় আমি গাইতে পারব।
আনন্দ আলো: গিটারের জাদুকর আইয়ুব বাচ্চুকে কিভাবে খুঁজে পেয়েছিলেন?
Nakib-khanনকিব খান: লিড গিটারিস্ট সাজেদ বিদেশে চলে যাওয়ায় আমরা খুব বিপদে পড়লাম। চট্টগ্রাম শহরে ভালো লিড গিটার বাজায় এমন কাউকে খুঁজতে লাগলাম। তখনই আইয়ুব বাচ্চু আমার নজরে এলো। সে অন্য ব্যান্ডে বাজাচ্ছিল। দেখলাম ১৭ বছরের এই ছেলেটি বেশ ভালো বাজায়। চট্টগ্রামের প্রধান ব্যান্ড সোলস তখন তো সুপারহিট। সেও আমার সঙ্গে কাজ করতে চাইছিল। আমি বাচ্চুকে বললাম বাসায় আসো, এক সঙ্গে জ্যামিং করি। বাসায় আসলো। তার গিটার বাজানো দেখেই পছন্দ হলো। বলে দিলাম, তুমি আমাদের সঙ্গে বাজাবে। এরপর থেকে সে সোলস-এ লিড গিটারিস্ট হিসেবে বাজানো শুরু করল। এ দেশে বাচ্চুর মতো ভালো গিটারিস্ট খুব একটা নেই। অত্যন্ত মেধাবী এই ছেলেটি গায়ক হিসেবেও খুব জনপ্রিয় ছিল। তপন গাইলেও সুপার সোলসের ‘নদী এসে পথ সাগরে মিশিয়ে দিতে চায়’ আমার অন্যতম প্রিয় গান। এই গানে একটি লিড পিস আছে। তাতে বাচ্চু এত সুন্দর গিটার বাজিয়েছে যে সেটি তার সিগনেচার টিউন হিসেবে থেকে গেছে। সে সান্তানার গিটার বাদন খুব পছন্দ করত। এই গানটিতে সে তার প্রভাবে একটি পিস বাজিয়েছে। পিসটির জন্যই গানটি জনপ্রিয় হয়ে গেছে। ১৯৮৩ সালে আমি সোলস ছেড়ে দেওয়ার পরও সে ছিল। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৯৮৪ সালে তাকেও তো ঢাকায় চলে আসতে হয়েছিল। ইংরেজি গায়কের প্রয়োজন ছিল বলে ১৯৮০ সালে সোলসে নাসিম আলী খান যোগ দিল। দেখলাম, ছেলেটি ভালো গায়। পিলুর বন্ধু, একই ক্লাসে পড়ে, ব্যান্ডে এক সঙ্গে বাজায়। যখন সোলসে ছিলাম আমাদের সমস্যা হয়নি। রেনেসাঁও তাই। ব্যান্ড দুটি টিম ওয়ার্ক, গণতন্ত্র ও সবার সমান অবদানের কারণে এখনো টিকে আছে।
আনন্দ আলো: রেনেসাঁর জন্ম?
নকিব খান: ১৯৮৫ সালে ফয়সাল সিদ্দিকী বগি বিদেশ থেকে ফিরলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবি এর সাবেক এই অধ্যাপক আগে অ্যাবনরম্যাল থ্রি প্লাস টু ব্যান্ডে ছিলেন। আমি, পিলু, মোটো, মামুন ও বগি ভাই আলাপ করলাম আমরাতো একসঙ্গে বাজাচ্ছি, ব্যান্ড করিনা কেন? তখনো ব্যান্ডের কোনো নাম ছিল না। সোনারগাঁও হোটেলে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের বার্ষিক সভায় প্রথম শোটি নাম ছাড়াই হলো। দর্শকদের নাম দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন তারা অনেক নাম দিলেন। কিন্তু কোনোটিই পছন্দ হলো না। বিটিভির ‘ঝলক’ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে গাওয়ার আমন্ত্রণ এলো। টিভি প্রোগ্রাম করতে হবে তো, নাম দিতে হবে, তাই সবাই মিলে নাম দিলাম রেনেসা।
আনন্দ আলো: মিউজিককে পেশা হিসেবে নিলেন না কেন?
নকিব খান: রেনেসার আমরা কেউ মিউজিককে পেশা হিসেবে নেইনি। নিজের কথা বলতে পারি- বাবা মারা যাওয়ার পর ঢাকায় এসে ছবিতে, কনসার্টে বাজাতাম। সাবিনা ইয়াসমিন আপার সঙ্গে স্টেজে কি-বোর্ড বাদক হিসেবেও বাজাতাম। তখন মিউজিশিয়ান হিসেবে যে টাকা পেতাম, তা দিয়ে চলতাম, লেখাপড়া করতাম। একসময় মিউজিককে প্রফেশন হিসেবে নেওয়ার চিন্তাও করেছিলাম। কিন্তু ফিল্মে যখন বাজাতে গেলাম, তখন এই জগৎ এর পরিবেশ আমার ভালো লাগেনি। আমার মিউজিক্যাল ভাবনার সঙ্গেও এটি যাচ্ছিল না। এরপর চাকরিতে যোগ দিলাম। তবে গানেই ডুবে থাকি। আমাদের দেশে ‘ইন্টেলেকচুয়াল প্রাপাটি রাইট’ আইন আছে কিন্তু এর প্রয়োগ নেই। ফলে আমরা যতগুলো জনপ্রিয় গান আছে, তার একটিরও যদি রয়্যালিটি পেতাম আমাকে হয়তো তাহলে চাকরি করে খেতে হতো না।
আনন্দ আলো: নেসলেতে কী দায়িত্ব পালন করেন?
নকিব খান: সরকারি-বেসকারি বিভিন্ন কম্পানির সঙ্গে লিয়াজো মেইনটেন করতে হয়। পলিসি অ্যাডভোকেসি করতে হয়। করপোরেট কমিউনিকেশন বাড়ানোর দায়িত্বটাও আমার কাজের অন্তর্ভুক্ত। এসব কাজের জন্য অনেক ইউনিট আছে। সমন্বয়ের কাজটা আমাকে করতে হয়।
আনন্দ আলো: শিল্পী পরিচিতটা কী চাকরি জীবনে বাড়তি সুবিধা দেয়?
নকিব খান: শিল্পী পরিচিতি কাজের ক্ষেত্রে বেশ সহায়তা করে। আমাদের যেহেতু পাবলিক রিলেশনের কাজ, সে কারণে পরিচিতটা অনেক কাজে আসে। যখন কোনো মন্ত্রণালয়ে যাই বা কোনো ফোরামে যাই সবাই আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। তবে এর জন্য শুধু শিল্পী পরিচয়টা মুখ্য নয়, মানুষের মনে শ্রদ্ধা, আস্থার জায়গাটাও তৈরি করতে হয়। আমি যে বিষয়ে কথা বলছি, সে বিষয়ে যদি দক্ষ না হই, সেটি শুধু শিল্পী পরিচয় দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়।