Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আবারও নতুন মুখ পুরনোদের কি হবে?

রেজানুর রহমান:
চলচ্চিত্রে আবার নতুন মুখের সন্ধান করা হচ্ছে। সাতটি ক্যাটাগরিতে যেমন নায়ক, নায়িকা, পার্শ্ব অভিনেতা, পার্শ্ব অভিনেত্রী, খলনায়ক, কৌতুক অভিনেতা ও শিশু শিল্পী খুঁজে নেওয়া হবে। খবরটা শুনে চলচ্চিত্র পাড়ারই একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি অবাক হয়ে বললেনÑ কেন রে ভাই, হঠাৎ আবার নতুন মুখ কেন? আমাদের চলচ্চিত্রে কী শিল্পীর অভাব পড়েছে? আমাদের রয়েছে পর্যাপ্ত সংখ্যক অভিনেতা-অভিনেত্রী। যাদের অনেকে চলচ্চিত্রে কাজের সুযোগ না পেয়ে অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। যারা এখনও চলচ্চিত্রকে ভালোবেসে চলচ্চিত্র পাড়ায় ঘোরাফিরা করেন তাদের কথা না ভেবে আবার কেন নতুন মুখ? তার মানে এখন যারা চলচ্চিত্র পাড়ায় ঘোরাফিরা করছেন তারা কি যোগ্য নন? পুরনোদের কথা না ভেবে আবার কেন নতুন মুখ খোঁজার এই উদ্যোগ? পুরনো যারা এখনও চলচ্চিত্রে টিকে আছেন তাদেরকে কি আমরা সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে পেরেছি? ধরা যাক, নতুন মুখের সন্ধানে’ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এক ঝাক নতুন তারকাকে খুঁজে বের করা গেল। আমরা কি এবার বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি আমাদের চলচ্চিত্র বদলে যাবে? নতুন মুখের সন্ধান করে আমরা যাদেরকে খুঁজে বের করবো তাদেরকে গাইড করবে কে? এরকম অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে চলচ্চিত্র পাড়ায়।
যদি প্রশ্ন করা হয় চলচ্চিত্র পাড়া বলতে আমরা ঢাকার কোন অঞ্চলকে বুঝি? আজ থেকে ৩০/৩৫ বছর আগে কেউ যদি এই প্রশ্ন করতেন তাহলে তার উত্তর হতো বেশ সহজ। কারণ তখনকার দিনে আমাদের চলচ্চিত্র পাড়া বলতে অনেক বড় ও বিস্তৃত অঙ্গণকে বুঝাতো। এফডিসির বাইরে কাকরাইল, মতিঝিল সহ ঢাকার বিস্তৃত এলাকায় চলচ্চিত্র নির্মাণের একাধিক প্রতিষ্ঠান ছিল। শুধুমাত্র কাকরাইলেই ছিল সিনেমা নির্মাণের অনেকগুলো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। গুলিস্তান সিনেমা হলকে কেন্দ্র করেও অনেক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল।
আর এখন? সিনেমা পাড়া বলতে বুঝায় সবেধন নীলমনি এফডিসি। আগের সেই জৌলুস নেই। টিম টিম করে কখনও বাতি জ্বলে আবার জ্বলে না। ইদানিং দেখা যাচ্ছে সেখানে ছবি নির্মাণের চেয়ে দুই পক্ষের রেষারেষির আতংকই বেশি। চলচ্চিত্র নির্মাণ যদি হয় একটি সাংগঠনিক ব্যবস্থা তাহলে এক্ষেত্রে বিশ্বস্ততা ও ঐক্যবদ্ধ থাকাটাই অধিক জরুরি। একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অনেক গুলো ধাপ পার করতে হয়। প্রথম দরকার নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ ছবির প্রযোজনা সংস্থার গুরুত্ব অনেক। ধরা যাক প্রযোজনা সংস্থা তৈরি একটি ছবি নির্মাণ করার জন্য। এবার প্রয়োজন একটি ভালো স্ক্রীপ্ট এবং একজন দক্ষ পরিচালক। তারপরই আসে অভিনেতা-অভিনেত্রীর প্রশ্ন। এবার আগের ধাপ গুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করলে আমরা কি পাব? হয়তো প্রযোজনা সংস্থা তৈরি আছে। কিন্তু দক্ষ পরিচালক কি আছে? আছে কি ভালো পাÐুলিপি? চলচ্চিত্র নির্মাণ ব্যবস্থাকে বলা হয় ডিরেকটরস মিডিয়া। এখানে পরিচালকই গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তি। তিনিই ক্যাপ্টেন অব দ্য শিপ। বর্তমান সময়ে কয়জন পরিচালককে আমরা সেই অর্থে সম্মান দিচ্ছি? আগে পরিচালকের নামের টানে দর্শক সিনেমা হলে ছুটে যেতো। এখন কি সেই পরিবেশ আছে? একটি ভালো চলচ্চিত্রের জন্য একটি ভালো পাÐুলিপি দরকার। কিন্তু আমরা কি এব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছি কখনও?
Manna-Shakibবাস্তবতা হলো, আমাদের চলচ্চিত্র একটি গন্তব্যহীন পথে হেঁটে চলেছে। আমাদের সবই আছে আবার অন্য অর্থে আমাদের কিছুই নাই। একটা সময় আমরা আফসোস করে বলতাম, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া চলচ্চিত্র বাঁচবে না। এখন সরকারের নানামুখি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার পরও চলচ্চিত্রকে সেই অর্থে এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না। এজন্য আমাদের চলচ্চিত্রঙ্গনে নানামুখি বিভাজনকেই দায়ী করেছেন অনেকে। কয়েকদিন আগে এফডিসিতে দুটি সংগঠনের মধ্যে মারামারি ঘটনায় সৃষ্ট অপ্রীতিকর পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরে একজন বিশিষ্ট অভিনয় শিল্পী বললেন, চলচ্চিত্রে নতুন মুখ খোঁজার উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। কিন্তু আমার একটি প্রশ্ন আছে। নতুন মুখ খুঁজে নিয়ে আমরা কি করবো? তাদেরকে কি নতুন করে বিভাজন প্রক্রিয়ায় ফেলে দিব? নতুন যারা আসবেন তাদের জন্য তো একটা সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এই পরিবেশ তৈরি করবেন প্রযোজক, পরিচালক শিল্পী সহ চলচ্চিত্র পরিবারের অন্য সবাই। নতুনদের জন্য একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য চ‚ড়ান্ত করতে হবে। তা না হলে নতুন মুখ খুঁজে নেওয়ার পরও কাজের কাজ কিছুই হবে না।
বিভিন্ন সূত্রের মতে, আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গণ বর্তমান সময়ে নানামুখি বিভাজন ও সমস্যা সংকটে বিব্রত সময় পার করছে। সবাই মুখে বলেন ‘আমরা চলচ্চিত্রের একটি বিরাট পরিবার।’ কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার কোনো বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় না। আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গণ বর্তমানে নানা দল, উপদলের কোন্দলে জর্জরিত। কেউ কাউকে মানেন না। শ্রদ্ধা ভালোবাসা ও সহমর্মিতার সেই পরিবেশ এখন আর নাই বললেই চলে। এমন পরিস্থিতিতে নুতন মুখের সন্ধান করে কতটা এগুনো যাবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যায়।
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির কথাই যদি ধরি। সমিতির নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের পর সমিতির কর্মকাÐ যেমন আলোচিত হয়েছে তেমনি সমালোচিতও হয়েছে। চলচ্চিত্র পরিবারের অন্যতম সদস্য বাপ্পারাজ যখন বলেন, “আমাদের চলচ্চিত্রে অনেক বাজে লোক ঢুকে গেছে। তারা আমাদেরকে যুদ্ধে নামিয়ে তালি বাজিয়ে তাদের ফায়দা লুটতে চায়। আমরা আমাদের ইন্ড্রাস্টিকে আবার ফেরৎ পেতে চাই। আমাদের ইন্ড্রাস্ট্রি এখন ফিল্মের লোকের হাতে নাই। বাইরের লোকের হাতে চলে গেছে। এফডিসিতে নাটকের শুটিং হয় বিজ্ঞাপনের শুটিং হয়। কিন্তু চলচ্চিত্রের শুটিং হয় না”। তখন তো স্বভাবতই অনেক প্রশ্নই মনে জাগে।
Ditiএকথাতো বোধকরি কেউই অস্বীকার করবেন না আমাদের চলচ্চিত্রে পরিচালক, প্রযোজক ও শিল্পীদের অনেকের মাঝেই সখ্যতা নাই। বিশেষ করে শাকিব খান, ওমর সানি ও মৌসুমীর সাথে শিল্পী সমিতির বর্তমান নেতৃত্বের বৈরিতা মোটেও দূর হয়নি। শিল্পী সমিতির নির্বাচনে জয়ী হবার পরও চিত্রনায়িকা মৌসুমী তার দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষনা দেন। শিল্পী সমিতির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মৌসুমীর জায়গায় দায়িত্ব পালন করছেন চিত্র নায়িকা নিপুন। এর ফলে শিল্পীদের মধ্যে বিভাজনের চিত্রটা প্রকট হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে নতুন করে যে সব শিল্পী আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গণে পা ফেলবেন তারা কি আদৌ স্বস্থিদায়ক পরিবেশ পাবেন?
নতুন মুখ মানেই নতুন নায়ক-নায়িকাকে খুঁজছি আমরা। কিন্তু আমাদের কি নায়ক-নায়িকা নাই? নীরব, ইমন, সাইমন, বাপ্পি সহ আমাদের এক ঝাক সম্ভাবনাময় নায়কের ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউ কি কখনও ভেবেছি? ওরা থাকতে আমরা নতুন নায়ক খুঁজছি। তার মানে ওরা কি ব্যর্থ? ওদেরকে নিয়ে আমরা কি বড় বাজেটের ভালো ছবি করার উদ্যোগ নিয়েছি কখনও? নাকি ওদেরকে আমরা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছি। এমন পরিস্থিতিতে নতুন যারা আসবেন তাদের ভবিষ্যৎ কি?
একটু পিছনে যাওয়া যাক। নতুন মুখের সন্ধানে প্রতিযোগিতা কিন্তু এবারই প্রথম নয়। এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আমরা বেশ কয়েকজন সেরা তারকাকে খুঁজে পেয়েছি। যারা আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গণকে নানা ভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। কাজেই এই প্রতিযোগিতার অবশ্যই একটা পজিটিভ দিক আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো সময়ের বাস্তবতায় এবার এই প্রতিয়োগিতা আমাদের চলচ্চিত্রে কতটুকু পজিটিভ প্রভাব ফেলবে? এর আগে একটি টিভি চ্যানেলের উদ্যোগে ‘সুপার হিরো ও সুপার হিরোহীন’ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। ওই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নীলয় ও শম্পা হাসনাইন সহ বেশ কয়েকজন নতুন মুখকে আমরা পেয়েছিলাম। তারা এখন কোথায়? নীলয়ের হাতে গোনা কয়েকটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। নীলয় চলচ্চিত্র প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। ব্যস্ত রয়েছেন টিভি নাটকের অভিনয় নিয়ে। শম্পা হাসনাইনকে চলচ্চিত্রের পর্দায় তেমন দেখা যায়নি। মডেলিং ও বিজ্ঞাপনে দেখা যায় তাকে। কিন্তু তাকে তো চলচ্চিত্রের জন্য খুঁজে নেওয়া হয়েছিল। বড় বাজেটের বড় ছবিতে তাদেরকে অভিনয় করার সুযোগ দিলে হয়তো চিত্রটাই বদলে যেত।
সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ হলো শুধু প্রযোজক, পরিচালক ও স্ক্রীপ্টের অভাবই নয়, একটি ভালো চলচ্চিত্রের অন্যান্য প্রয়োজন মিটানোর জন্য এখনও বিদেশে যেতে হয়। চলচ্চিত্রে শব্দ ধারন ব্যবস্থা এখনও আমাদের দেশে উন্নত করা যায়নি। গানের ক্ষেত্রে বিশেষ করে সম্পাদনা ব্যবস্থার গুণগত মান রক্ষার জন্যও আমাদেরকে এখনও বিদেশে যেতে হয়। এমন অবস্থায় নতুন মুখ এনে আমরা আসলে কি করব?
অনেকে হয়তো ভাবছেন, আমরা ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ কার্যক্রমের বিরোধীতা করছি। ব্যাপারটা মোটেই সেরকম নয়। নতুন মুখের আবির্ভাবে আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গণ আলোকিত হোক এটাই আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু সেজন্য কি আমরা প্রস্তুত? নতুনরা এসে যদি আমাদের চলচ্চিত্রের দৈন্যদশা দেখে, বিভাজন দেখে, পারস্পারিক রেষারেষি দেখে তাহলে কি তারা ভালো কাজের ক্ষেত্রে আস্থা পাবে? বিষয়টা চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সকলে ভাববেন আশাকরি।