Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আনন্দ আলোয় ছোটকাকু প্রিয় নির্মাতার সঙ্গে সারাদিন

হঠাৎ টেলিফোন। মোবাইল মনিটরে নামটা দেখে চমকে উঠলাম। কারণ এতো সকালে তিনি সাধারনত আমাকে ফোন করেন না। নিশ্চয়ই জরুরি কিছু… নাকি আমার কোনো কাজ দেখে কথা বলার জন্য ফোন করেছেন। মুহূর্তেই পুরনো দিনের এক মধূর স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠলো। যাকে নাটক, চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়ায় বলা হয় ফ্লাশব্যাক।
এটিএন বাংলায় আমার একটি নাটক প্রচারিত হয়েছে। স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ নাটক। নাম-মিনিস্টার। টিভিতে নাটকটি দেখেই দেশ বরেণ্য নাট্যকার, নির্মাতা, চিত্রশিল্পী ও অভিনেতা আফজাল হোসেন আমাকে ফোন দিয়েছেন। “একটু আগে এটিএন বাংলায় যে নাটকটি প্রচার হলো সেটিকি তোমার নাটক?”
আফজাল হোসেনের কথা শুনে আমি যেন একটু ভরকে গেলাম। একে ঠিক ভয়ও বলা যাবে না। একটু যেনো অপ্রস্তুত। নাটকটি কি তার পছন্দ হযনি? ইতস্তত ভঙ্গিতে বললামÑ জ্বি আমার নাটক। আমার কথা শুনে তিনি খুশি হয়ে বললেন, “হ্যা, নাটক শেষে পরিচালকের জায়গায় তোমার নাম দেখলাম। আগে বুঝতে পারিনি। হঠাৎ টেলিভিশন খুলে দেখি একটা নাটক চলছে। প্রথমে বুঝিনি এটা কার নাটক! কাহিনী ও অভিনয় সৌকর্য এতটাই মনের মাঝে গেথে গেল যে এর পরিচালক কে তা দেখার জন্য পুরো নাটকটি দেখলাম। শেষে দেখি তোমার নাম। আরে, এতো আমাদের রেজানুর। তোমাকে অভিনন্দন একটি ভালো নাটক বানানোর জন্য। সত্যি সত্যি কাজটি ভালো হয়েছে। ফজলুর রহমান বাবু অসাধারণ অভিনয় করেছে…” গুণী নির্মাতা আফজাল হোসেনের সেদিনের সেই একটি ফোন কল আমার নাটক নির্মাণ ভাবনায় অনেক গতি ও প্রেরণা এনে দিয়েছিল।
অবচেতন মনে এ রকমই কোনো কাজের আবারও প্রশংসা পাবার আশায় ফোন রিসিভ করলাম। আফজাল হোসেন বললেন, কেমন আছো রেজানুর?
জ্বি ভালো।
তোমাদের আনন্দ আলোয় একটা স্টুডিও আছে না?
জ্বি আছে। কেন?
ওই স্টুডিওতে আমি শুটিং করবো। ছোটকাকু সিরিজের একটা অংশের শুটিং। কাল সকাল ১১ টায় আসতেছি…
ফোনে কথা এটুকুই। আনন্দ আলোর স্টুডিওতে আফজাল হোসেন নাটকের শুটিং করবেন একথা শোনার পর আমাদের আনন্দ আলো পরিবারে রীতিমত একটা হৈ চৈ পড়ে গেল। আফজাল হোসেন বলে কথা। তাও আবার জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ছোটকাকুর শুটিং হবে আনন্দ আলোয়। শুরু হলো আমাদের রুদ্ধর্শ্বাস প্রতিক্ষা।
পরের দিন সকালেই পুরো শুটিং ইউনিট হাজির। রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামের কারণে প্রিয় নির্মাতা আফজাল হোসেন এলেন একটু দেরীতে। একজন গুণী নির্মাতার কাজ দেখার সৌভাগ্য হলো খুব কাছ থেকে। শুধু তাঁর নির্মাণ সৌকর্য দেখাই নয় ছোটকাকু সিরিজে একজন পত্রিকা সম্পাদক হিসেবে অভিনয় করার সুযোগও মিলল। সে কথায় পরে আসছি।
চঞ্চল মাহমুদ দেশের একজন নামকরা আলোকচিত্রী। শোবিজে তার অনেক ভক্ত। কারণ মডেল ফটোগ্রাফিতে তিনি একটা জাগরণের সৃষ্টি করেছেন। স্বস্ত্রীক তিনি আনন্দ আলোয় হাজির। ঘটনা কি? খোঁজ নিয়ে জানা গেল এবারের ছোটকাকু সিরিজে কাহিনীর প্রয়োজনে চঞ্চল মাহমুদও যুক্ত হয়েছেন। শুধু চঞ্চল মাহমুদই নন কাহিনীর প্রয়োজনে অভিনয়ে যুক্ত হয়েছেন চ্যানেল আই-এর তৃতীয় মাত্রা খ্যাত জিল্লুর রহমান এবং চ্যানেল আই-এর বিশিষ্ট প্রযোজক অনন্যা রুমা।
চঞ্চল মাহমুদ আমার বহুদিনের শুভাকাঙ্খী, বন্ধুও বটে। তাকে অনেক দিন পর কাছে পেয়ে আমি যখন অভিভ‚ত, আনন্দিত তখনই প্রিয় নির্মাতা আফজাল হোসেন বললেন, আমাকে ছোটকাকুতে অভিনয় করতে হবে। চরিত্র একজন পত্রিকা সম্পাদকের। পত্রিকাটি আনন্দ আলো। আনন্দ আলোর স্টুডিওতে দেশখ্যাত একজন মডেল তারকার ছবি তুলবেন চঞ্চল মাহমুদ। সম্পাদকের অফিস কামরায় ওই মডেল সহ একজন রিপোর্টারের উপস্থিতিতে একটি দৃশ্য ধারণ করা হবে। ঘটনা এটুকুই।
মঞ্চে অভিনয় করি। টিভিতে অভিনয় করাই। টিভিতে কখনও অভিনয় করার কথা ভাবিনি। একটা সময় নিজের সম্পর্কে একটা ধারণা ছিল, আমার চেহারাটা টিভিতে অভিনয়ের জন্য মানান সই নয়। টিভিতে অভিনয় করবে ফর্সা চেহারার মানুষ। আমি তো কালো। যদিও কথায় আছে কালোই জগতের আলো। কিন্তু শুরুর দিকে নিজের প্রতি ওই বিশ্বাসটা পোক্ত করতে পারিনি। পরে যখন প্রিয় অভিনেতা হুমায়ূন ফরীদি, হালের মোশাররফ করিম সহ আরও অনেক অভিনেতার অভিনয় দেখে নিজের প্রতি বিশ্বাসটা পোক্ত হলো তখন অনেক সময় পার হয়ে গেছে। অভিনয়ের দৌড়ে অনেক পিছনে পড়েছি। কাজেই টিভিতে অভিনয় নিয়ে আর ভাবিনি। কিন্তু প্রিয় নির্মাতা আফজাল হোসেন যেন আমার মাঝে নতুন প্রেরণার সঞ্চার করলেন। টিভি নাটকে অভিনয় করবো, তাও আবার দেশ বরেণ্য নির্মাতা আফজাল হোসেনের জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ছোটকাকুতে… ওহ! মাই গড… অস্থির লাগছে।
Choto-Kakuঅবশেষে ছোটকাকুতে আমার অভিনয় করার সুযোগ হলো। অভিনয় কতটুকু ভালো করতে পেরেছি তা বলবেন দর্শক। তবে শিখেছি অনেক কিছু। একটি ভালো নাটক নির্মাণের জন্য একজন পরিচালক কতটা নিষ্ঠাবান হতে পারেন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ নন্দিত অভিনেতা আফজাল হোসেন। তার কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরি। দৃশ্য মূলতঃ দুটি। দৃশ্য এক. আনন্দ আলোর স্টুডিওতে জনপ্রিয় মডেল তারকা মিলার ছবি তুলবেন বিশিষ্ট ফটোগ্রাফার চঞ্চল মাহমুদ। ফটো তুলতে তুলতেই মডেলের সাথে প্রয়োজনীয় কথা বলবেন তিনি। দৃশ্য দুই. আনন্দ আলোর সম্পাদকের কক্ষে সোফার ওপর বসে আছেন মডেল তারকা মিলা। মেকআপম্যান তার চুল ঠিক করে দিচ্ছে। সম্পাদক তার টেবিলে কাজ করছেন। একজন রিপোর্টার মিলার সাথে টুকটাক কথা বলছে। কথা শেষে মিলাকে স্টুডিওতে নেওয়া হবে ফটো তোলার জন্য…
মূলতঃ দৃশ্য এটুকু। বিকেলের মধ্যেই কাজ শেষ হবার কথা। কিন্তু সেদিন শুটিং শেষ হয়েছে রাত সাড়ে ১২টায়। কাছ থেকে দেখলাম একজন সুনির্মাতার নির্মাণ ভাবনার নানা আয়োজন। কোনো কিছুতেই ছাড় দিতে নারাজ তিনি। একটু কি খুতখুতে স্বভাবের তিনি? পছন্দের বাইরে এক চুল নড়বেন না। চঞ্চল মাহমুদ একজন জনপ্রিয় আলোকচিত্রী। তিনি তো আর অভিনেতা নন। অথচ তাকে দিয়েই সুন্দর অভিনয় করালেন আফজাল হোসেন। একবারে হচ্ছে না। বার বার চেষ্টা করাচ্ছেন। পরিচালক হিসেবে চেহারায় কোনো বিরক্তি নাই। বরং বেশী পরিমান শান্ত। যেনো কোমল হাতের নরম স্পর্শে কাদা মাটি দিয়ে নিপুন মগ্নতায় চরিত্র সৃষ্টি করছেন। এক সময় চঞ্চল মাহমুদের অভিনয় দেখে মনে হলোÑ আরে এতো একজন জাত অভিনেতাকে দেখছি…
ছোটকাকুতে অভিনয় করতে পেরে খুব খুশি চঞ্চল মাহমুদ। কথা প্রসঙ্গে হাসতে হাসতেই বললেন, প্রথমে ভেবেছিলাম ছবি তুলতে তুলতে মডেলের সাথে টুকটাক কথা বলবো… এ আর কি এমন শক্ত কাজ। কিন্তু ক্যামেরার সমনে দাঁড়িয়ে মনে হলো সত্যি সত্যি এটি শক্ত কাজ। কিন্তু আফজাল ভাইয়ের নির্দেশনার জাদুতে শেষ পর্যন্ত বোধকরি উৎরে গেছি! জীবনের নতুন এক অভিজ্ঞতা হলো।
আনন্দ আলোয় সেদিন সারাবেলা উপস্থিত থেকে আফজাল হোসেনের নির্দেশনায় অভিনয় দেখে ও অভিনয় করে জীবনের এক নতুন উপলব্ধি হয়েছে। তা হলো কাজ সে যে ধরনেরই হোক তার প্রতি প্রথমে প্রেম থাকতে হবে। কাজকে ভালোবাসতে হবে। ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসাই প্রতিদান দেয়।
আফজাল হোসেন আনন্দ আলোয় এসেছিলেন সকাল সাড়ে ১১টায়। মাত্র দুটি দৃশ্যের জন্য শুটিং করে ফিরে গেলেন রাত সাড়ে ১২টায়। এর মধ্যে একবারও শুটিং ছাড়া অন্য কিছু ভাবেননি। এমনকি খুব একটা প্রয়োজন ছাড়া কারও ফোনও ধরেননি। অন্যকে ফোন করেননি।
রাত সাড়ে ১২টায় যখন আনন্দ আলো অফিস থেকে আমরা নেমে যাচ্ছি তখন অনেকেই ক্লান্ত। কিন্তু আফজাল হোসেনের চেহারায় কোনোই ক্লান্তির ছাপ দেখলাম না। বরং তিনি বেশ ফ্রেশ মুডেই গাড়িতে উঠে বসলেন। এই না হলো আফজাল হোসেন!